ছবি: সুব্রত কুমার মণ্ডল।
বারো বছর পর। বাবার সঙ্গে আবার তাঁর দেখা। চোদ্দো বছরের মেয়েটি তখন থাকতেন ইরানে। মা পরভিনের সঙ্গে। আর তাঁর বাবা থাকতেন মুম্বইতে। চলচ্চিত্র দুনিয়ার এক নক্ষত্র তিনি। নাম নাসিরউদ্দিন শাহ। মেয়েটির নাম হিবা। ফারসি ভাষায় বাবাকে একটা চিঠি লিখেছিলেন তিনি। বাবা অবশ্য ভাষা না জানায় সে চিঠি পড়তে পারেননি। কিন্তু এই চিঠির সঙ্গে পরভিনের একটা নোট পড়ে বুঝেছিলেন যে কন্যা তাঁর কাছে আসার জন্য অনুমতি চাইছে।
আপত্তি করেননি। কিন্তু মন বিদীর্ণ হয়ে গিয়েছিল উত্কণ্ঠায়। কারণ মেয়ের সঙ্গে ভৌগোলিক দূরত্ব শুধু নয়, এই বারো বছরে তৈরি হয়েছিল হাজার আলোকবর্ষের সমান মানসিক দূরত্ব!
সেটা ছিল ১৯৮২-তে।
তার বত্রিশ বছর পর প্রকাশিত হল নাসিরউদ্দিন শাহ-র আত্মজীবনী ‘অ্যান্ড দেন ওয়ান ডে’। অনেক না জানা কথা। কিছু স্বীকারোক্তি। বইয়ের বিপুল সংখ্যক পাঠকের অন্যতম হলেন সেই হিবা। এখন তিনি মুম্বইনিবাসী। জনপ্রিয় সিরিয়াল ‘বালিকা বধূ’তে অল্প বয়সের দাদিসার চরিত্রে অভিনয় করা ছাড়াও তিনি বেশ কিছু ‘ইন্ডিপেন্ডেন্ট’ ছবিও করেছেন। করেছেন থিয়েটারও। জানুয়ারি মাসে কলকাতাতেও আসছেন একটি নাটক নিয়ে। নাম ‘ইসমত আপ্পাকে নাম’।
তবে বাবার আত্মজীবনীটা পড়তে তাঁর বেশ খানিকটা সময় লেগেছিল। “এতটাই ব্যক্তিগত কিছু কথা আছে সেখানে যে সময় তো লাগবেই। নিজেকে, আমার মাকে নিয়ে যে জায়গাগুলো লেখা সেগুলো একাধিকবার পড়েছি। পড়তে গিয়ে মনের মধ্যে গভীর ‘ক্যাথারসিস’ অনুভব করেছি,” স্বীকার করেন হিবা।
অনুভূতিটা অবশ্য অস্বাভাবিক নয়। বইয়ের গোটা একটা চ্যাপ্টার হিবাকে নিয়ে। যেখানে নাসিরউদ্দিন শাহ স্বীকার করেছেন কুড়ি বছর বয়সে বাবা হয়ে তিনি একদম খুশি হননি। বাবা হওয়ার আগে যে স্বল্প সময় তিনি সন্তান নিয়ে স্বপ্ন দেখতেন তা ছিল কাল্পনিক এক ছেলেকে নিয়ে, যার সঙ্গে তিনি কুস্তি করতেন বা বন্দুক আর ক্রিকেট নিয়ে চর্চা করতেন। হিবার জন্মের পরে অদ্ভুত ভাবে মেয়েকে হিংসা করতে শুরু করেন। শেষ পর্যন্ত এমন একটা সময় এসেছিল যখন মেয়ের প্রতি কোনও টানই অনুভব করতেন না তিনি।
কেন এই ব্যবহার? “মনের মধ্যে অনেক প্রশ্ন দানা বাঁধত ঠিকই। কিন্তু বুঝতে পারতাম না বাবাকে কী ভাবে জিজ্ঞাসা করব। এই বইটা পড়ে আমি আমার বাবার অনেক কাছে এসেছি,” জানান চুয়াল্লিশ বছর বয়সি অভিনেত্রী।
একবারও মনে হয়নি এতটা ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে আলোচনাটা বাড়ির চার দেওয়ালের মধ্যে রাখলেই ভাল হত? বই লেখার জন্য তো আরও অনেক বিষয় রয়েছে। অমিতাভ বচ্চনের সঙ্গে নাসিরউদ্দিনের সম্পর্ক... আজকালকার দিনের নতুন ধারার সিনেমা... এই সব বাদ দিয়ে ছাপার অক্ষরে হিবার জীবনের এই স্পর্শকাতর সত্যটা গোটা দুনিয়াকে জানাতে গেলেন কেন? “আসলে বইটা তো বাবা অনেক দিন ধরেই লিখছেন। কী কী বিষয় নিয়ে লিখবেন সেই স্বাধীনতাটা তাঁর থাকা দরকার,” জানান তিনি।
শাহ পরিবার: হিবা, রত্না, নাসিরউদ্দিন, ভিভান, ইমাদ।
ছোটবেলায় যখন ইরানে থাকতেন তখন বাবার অভাব বোধ করেননি? ভারতীয় চলচ্চিত্রে তাঁর অবদান সম্পর্কে কি জানতেন তিনি? “ইরানে আমরা শাহরুদ বলে একটা শহরে থাকতাম। উত্তর ইরানের শহর। আমাদের শহরে না হলেও গোটা দেশে তখন বিপ্লব চলেছে। ওখানকার আবহাওয়াটাই আলাদা ছিল। মেয়েদের মাথায় চাদর পড়তে হত। বাড়িতে বাবা মায়ের বিয়ের একটা ফোটো ছিল। জানতাম তিনি এক জন অভিনেতা...” বলতে বলতে গলার স্বর আস্তে হয়ে আসে। ইরানে সেই সময় আয়াতুল্লা খোমেইনির প্রত্যাবর্তন, বিপ্লব ইত্যাদির সঙ্গে যুঝতে হয়েছিল তাঁকেও। এই সবের মধ্যে নাসিরের অভিনীত কোনও ছবি দেখেছিলেন? “ইরান টেলিভিশনে তখন দুটো ভারতীয় ছবি দেখানো হয়েছিল। ফারসি ভাষায় ডাব করে। একটির নাম ‘দো আঁখে বারা হাত’ অন্যটি ‘দোস্তি’। আর দেখেছিলাম ‘শোলে’...” বলাই বাহুল্য তিনটের কোনওটাই নাসিরউদ্দিন-অভিনীত নয়।
তবে বাড়িতে নাসির প্রসঙ্গ যে উঠত না যে তেমনটা নয়। “আই ইউজড টু থিঙ্ক অ্যাবাউট মাই ফাদার। মা (যিনি নাসিরউদ্দিনের থেকে বয়সে চোদ্দো বছরের বড় ছিলেন) খুব কম সময় বাবার কথা বলতেন। কিন্তু যেটুকু বলতেন সেটা শ্রদ্ধার সঙ্গেই বলা। মা পেশায় চোখের ডাক্তার ছিলেন। ছবি আঁকা, মূর্তি গড়া সব কিছুই পারতেন। সেলাই করতেন খুব ভাল। মনে আছে ইরানের বাড়িতে বসে আমাদের টেলিভিশন সেটটা নিজেই সারিয়ে ফেলেছিলেন মা!” জানান হিবা।
দূরত্বের কারণে বাবার সঙ্গে ভুল বোঝাবুঝি হয়নি? “প্রথম প্রথম বেশ হোঁচট খেয়েছি। আস্তে আস্তে আমাদের বন্ডটা তৈরি হয়। বুঝতে পারি যে বাবার কাছে পরিবার ব্যাপারটা কতটা প্রাধান্য পায়। প্রথম যখন মুম্বইয়ে থাকব বলে পাকাপাকি ভাবে চলে আসি তখন শুধু ইংরেজি বুঝতে পারতাম। বাবা আমার বাচনভঙ্গি ঠিক করে দিয়েছিলেন। অনুবাদ করে দিতেন...” তখন হিবার বয়স ১৪। কিন্তু মুম্বইয়ে এসে ভর্তি হয়েছিলেন ক্লাস সিক্সে। “এমনকী বায়োলজিও পড়িয়েছেন আমাকে। বাবা খুব ভাল টিচার...” তা ছাড়াও টেনিস খেলতে নিয়ে যাওয়া, সাঁতার শেখানো সবই বাবার হাত ধরে। বাবা-মেয়ের বন্ধন গভীর হওয়ার পেছনে আরও এক জনের বড় অবদান আছে। তিনি নাসিরের দ্বিতীয় স্ত্রী। অভিনেত্রী রত্না পাঠক শাহ। হিবার ভাষায় ‘এঞ্জেল’।
এই রত্নাকে জুড়েও বেশ খানিকটা রয়েছে বইতে। শুধু যে তাঁদের দেখাসাক্ষাত্ বা বিয়ে প্রসঙ্গে তা নয়। একটা অ্যাকসিডেন্টের পর হসপিটালে ভর্তি হয়েছিলেন নাসির। চিত্ হয়ে শুয়ে থাকতে হত বিছানায়। কিন্তু সেই অবস্থায় শুয়ে শুয়ে ‘জয়েন্ট’ রোল করা যেত না। তখন যে তিনি সে কাজটা রত্না আর ওম পুরিকে দিয়েই করাতেন সেটাও লেখা হয়েছে বইতে। একটা সময় যে নাসিরউদ্দিন মহিলা সঙ্গের জন্যে ফকল্যান্ড রোডেও যেতেন সেটাও গোপন করা হয়নি বইয়ে। আবার ‘আর’ নামে এক মহিলার সঙ্গে যে তাঁর বিবাহবহির্ভূত সম্পর্কও ছিল সেটাও আছে জীবনীতে! সচরাচর ভারতীয় সেলিব্রিটিরা আত্মজীবনী লিখলে পরকীয়া, নেশা, যৌন পল্লিতে যাওয়া নিয়ে কোনও কথাই বলেন না। সেই সব জীবনীতে চমক থাকে ঠিকই কিন্তু এই ধরনের স্বীকারোক্তি বিরল।
মেয়ে হয়ে এই সব পড়তে কেমন লেগেছে? “বুঝেছি, বাবার জীবনটা খুব ‘কিউরিয়াস’ ভাবেই কেটেছে। তবে এই সব পড়েও ওঁর সম্পর্কে কোনও বিরূপ ধারণা তৈরি হয়নি। রাগ হয়নি। মনে হয়নি ওঁকে বিচার করি। খুব অবজেকটিভ লেখা। উপরি পাওনা হল ওঁর রসবোধ। আমি বাবার দৃষ্টিভঙ্গিটা বুঝতে পারি। বুঝি ওঁর জীবনে যা যা ঘটেছে সেটা জানতে গেলে বুঝতে হবে যে ওঁকে কত কিছুর সঙ্গে যুঝতে হয়েছে। হি ওয়াজ গোয়িং থ্রু সো মাচ!”
শুধু তাঁর বাবা নয়, যে মানুষটি একবার নাসিরউদ্দিনের প্রতিভাকে ঈর্ষা করে তাঁকে খুন করতে গিয়েছিলেন, রীতিমতো ছুরি চালিয়ে রক্তারক্তি কাণ্ড বাধিয়েছিলেন, সেই রাজেন্দ্র যশপালের বিরুদ্ধেও কোনও অভিযোগ নেই হিবার। “ঘটনাটা সম্পর্কে একটু জানতাম। বাকিটা জানলাম বইয়ে। বাবা ওঁকে স্নেহ করতেন। সহপাঠী ছিলেন। ওঁর প্রতিভার কথা বলেছেন। কোনও কারণে ওই রকম করে বসেছিলেন। তবে ওঁকে নিয়ে আমাদের রাগ নেই। যেখানেই থাকুন উনি যেন ভাল থাকেন...”
কিন্তু বইয়ের বাইরেও যে অনেক না বলা কথা রয়ে গিয়েছে সেগুলোর কী হবে? এই আত্মজীবনীর যে কোনও সিকোয়েল লিখবেন না তা স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন অভিনেতা। “আমার মনে হয় বাবা এত সুন্দর লেখেন যে ওঁর আরও লেখা উচিত। কী বিষয়ে লিখবেন সেটা না হয় উনি ঠিক করুন। তবে কলমটা যেন চলতেই থাকে...”
হিবার এই অনুরোধ কি নাসিরউদ্দিনের কলম শুনতে পাচ্ছে?