প্রিয়ঙ্কা দারুণ পাঞ্চটা কম

আছে সবই। অথচ ঘুসিটা যেন বলিউডে চলে গেল। লিখছেন জাগরী বন্দ্যোপাধ্যায়।পৃথিবীর আকার কী? গোল। ‘‘সেটা আর সবার জন্য ঠিক। তোমার জন্য নয়। আজ থেকে তোমার কাছে পৃথিবীটা চৌকো। এই বক্সিং রিংই তোমার পৃথিবী।’’ এমসি মেরি কমের পৃথিবী। ২০১২-র অলিম্পিকের পর থেকে যে মেয়েটির নাম সারা দেশ একডাকে চিনতে শিখল।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০৮ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ০০:০০
Share:

পৃথিবীর আকার কী? গোল।

Advertisement

‘‘সেটা আর সবার জন্য ঠিক। তোমার জন্য নয়। আজ থেকে তোমার কাছে পৃথিবীটা চৌকো। এই বক্সিং রিংই তোমার পৃথিবী।’’ এমসি মেরি কমের পৃথিবী। ২০১২-র অলিম্পিকের পর থেকে যে মেয়েটির নাম সারা দেশ একডাকে চিনতে শিখল।

অথচ মেরি তার আগে পাঁচ বার বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হয়েছেন। কিন্তু একে বক্সিং, তায় আবার মেয়েদের বক্সিং। তায় মণিপুরের প্রত্যন্ত গ্রামের মেয়ে। বলিউড যে আজ মেরিকে নিয়ে সিনেমা বানাতে এগিয়ে এল, এটাও সেই বদলেরই ফসল। নইলে এক জন খেলোয়াড়, কেরিয়ার থেকে অবসর নেওয়ার আগেই তাঁকে নিয়ে বায়োপিক তৈরি হয়েছে এমন ঘটনা বিরল বললেও কম বলা হয়। ‘মেরি কম’ সেই অতি বিরল ছবি। বিরল ছবি, তবে বিরল গোত্রের ছবি নয়। সাধারণ ভাবে স্পোর্টস ফিল্ম যে ধাঁচা মেনে চলে--- অ র্থাৎ সব বাধা ঠেলে এগোনোর গল্প, লড়াই করে জয় ছিনিয়ে আনার গল্প--- ‘মেরি কম’ও তাই। এবং এ সব গল্পের আবেদন কোনও দিন পুরনো হয় না। বড় ম্যাচ দেখার উত্তেজনা যেমন কোনও দিন কমে না, হারতে হারতে জিতে যাওয়ার কাহিনিতেও মরচে ধরে না। সুতরাং ফর্মুলা মেনে হাঁটায় এ ক্ষেত্রে কোনও ভুল নেই। বরং অব্যর্থ ফর্মুলার প্রয়োগটা ব্যাটে-বলে হল কি না, মানে মেরি কমের ক্ষেত্রে উইনিং পাঞ্চ হয়ে ঊঠল কি না, সেটাই প্রশ্ন।

Advertisement

উপাদান কিন্তু পর্যাপ্ত। সব খেলোয়াড়ের জীবনে সমান কাহিনি-গুণ নাও থাকতে পারে। মেরির জীবনে অন্তত তার কোনও অভাব নেই। ছোট্টবেলা থেকে বক্সিং-এর প্রতি আগ্রহ, বাবাকে লুকিয়ে কোচিং নেওয়া, বাবার সঙ্গে ঝগড়া, ফুটবল ট্রেনার ওনলেরের সঙ্গে প্রেম, ফেডারেশনের কর্তাদের সঙ্গে ঝামেলা, বিয়েকে কেন্দ্র করে কোচের অভিমান, প্রসববেদনা নিয়ে কার্ফুতে আটকে পড়া, সন্তানের অসুখ...আর এ সব কিছুর পাশাপাশি একের পর এক পদক জয়। অর্থাৎ বক্সিং, পারিবারিক মেলোড্রামা, প্রেম, ভিলেন ফেডারেশন, কামব্যাক --- কী নেই?

সমস্যাটা হল গিয়ে পরিচালক, চিত্রনাট্যকার আর সম্পাদক মিলে হিসেব করে উঠতে পারেননি, কী রাখবেন আর কী ফেলবেন। কোনখানে কতক্ষণ সময় বরাদ্দ করবেন। ফলে ছবির গতি এলোমেলো, বুনন একমাত্রিক, ক্লিশের ভিড়। প্রথমার্ধে হুড়মুড় করে অনেক কিছু বলা হয়ে গিয়েছে। প্রায় টাইমলাইনের ধাঁচে একটা থেকে আরেকটা ঘটনায় লাফিয়ে চলে যাওয়া হয়েছে। কিন্তু কী করে মেরি বক্সিং ভালবাসল, কোচের হাতে পড়ে আস্তে আস্তে বক্সার হয়ে ওঠার দিকে এগোল, সেই প্রক্রিয়াটা অধরা থেকে গিয়েছে। এক জন বক্সিং ভালবাসে বলে ছেলেদের সঙ্গে মারপিট করে বেড়ায় এটা নিশ্চয়ই কোনও যুক্তি হতে পারে না! তুলনায় ছবির দ্বিতীয়ার্ধ বেশি গোছানো যেখানে মাতৃত্ব আর কেরিয়ারের টানাপড়েনটাই মূল বিষয়।

মেরির কামব্যাকটাই এই ছবির আসল নাটক। এখানে এসেই ছবিটা বেশ খানিকটা নম্বর তুলে ফেলে। তার সবচেয়ে বড় কারণ হল, স্পোর্টস ফিল্মের ঘরানায় এই কাহিনি আগে তেমন ভাবে উঠে আসেনি। আসবেই বা কী করে? মা হয়ে যাওয়ার পরেও পাওয়ার-স্পোর্টস চালিয়ে যাওয়া এবং চ্যাম্পিয়ন হওয়া এ-ও তো অতি বিরল ঘটনা! মেরির জীবনের শুধু এই পর্বটি নিয়েই একটা আস্ত ছবি হতে পারত। আপাতত এটুকু বলা যাক, মেরি যেমন অনেক ম্যাচে শেষ রাউন্ডে ঘুরে দাঁড়িয়েছেন, ‘মেরি কম’ ছবিটাও তাই । কিন্তু এটাও একই সঙ্গে বলতে হবে যে, সফল স্পোর্টস ফিল্মের জান যে গনগনে প্যাশন আর অ্যাড্রিনালিনের ফোয়ারা তা গোটা ছবির শরীরেই ভর করে থাকার কথা। ছবির গা থেকে জবজবে ঘাম, রক্তজমা কালশিটে আর পেশির কুঞ্চন ফুটে বেরনোর কথা, সেখানে ঘাটতিটা থেকেই গেল। ছবির গড়ন থেকে স্পষ্ট, পরিচালক মশাই আসলে অশ্রুসজল গল্প বলতে বেশি আগ্রহী। নইলে মেরির গল্প অন্য ভাবে পড়ার সুযোগও ছিল। মণিপুরের মেয়ে মেরি। মণিপুর মানে শর্মিলা চানু। মণিপুর মানে মনোরমার জন্য নগ্ন মিছিল। মণিপুর মানে কানহাইয়া লাল বা রতন থিয়ামের নাটক। বলিউডের ছবি সেই মণিপুর নিয়ে নাড়াঘাঁটা করবে, এটা প্রত্যাশিত নয়। কিন্তু তাই বলে একটা কার্ফুর দৃশ্য ছাড়া অশান্ত মণিপুরের আর কোনও চিহ্নই তেমন ভাবে থাকবে না? মণিপুরের ভূগোল? সেটাই বা কতটুকু পাওয়া গেল? মেরি কমের বায়োপিক এত ইন্ডোর-নির্ভর হওয়া উচিত? মেরিকে বুঝতে গেলে কি পার্বত্য জনজীবনের আধারটি বাদ দেওয়া চলে? ওই একরোখা জেদ, ওই পরিশ্রম, ওই কষ্টসহিষ্ণুতা মেরি তো তাঁর মাটি থেকে অনেকটা পেয়েছেন। পাহাড়ি মেয়েরা তো লবঙ্গলতিকা হওয়ার বিলাসিতা জানেন না! সেটা ছবিতে ধরা পড়ল কোথায়?

তবে এক দিক থেকে বাঁচোয়া! সঞ্জয় লীলা বনশালি শিবিরের ছবি হয়েও (সঞ্জয় প্রযোজক, পরিচালক ওমাঙ্গকুমার সঞ্জয়ের সহকারী ছিলেন!) ‘মেরি কম’ অন্তত বনশালি-ম্যানিয়ায় সে ভাবে আক্রান্ত নয়। এলাহি আড়ম্বরের দেখনদারি নেই। বলিউডি ধামাকা সহযোগে মণিপুরী নাচের আসর বসানো হয়নি। পোশাকআশাক-ঘরবাড়ি বাস্তবতার সীমা ছাড়ায়নি। তবে অজস্র গান গুঁজে দেওয়ার লোভ সামলাতে পারেননি, এই যা। প্রিয়ঙ্কা চোপড়া সুঅভিনেত্রী। তবে হিলারি সোয়াঙ্ক নন। এই চরিত্রটার জন্যে কত খেটেছেন, তাই নিয়ে গত ক’মাসে কম চর্চা হয়নি। সেই খাটনির ছাপ পর্দায় আছে। কিন্তু সেটাকে খাটনি বলে চেনাও যাচ্ছে। তার ফাটলগুলোও ধরা পড়ছে। মণিপুরের মেঠো মেয়েটা প্রিয়ঙ্কার গালে মেচেতার দাগ হয়ে থেকে গিয়েছে। বলিউডি বাচন আর বিভঙ্গকে পুরোপুরি নক-আউট করতে পারেনি। প্রিয়ঙ্কার ফোকাস ছিল, স্কিল ছিল, কয়েকটা জবরদস্ত পাঞ্চও ছিল। সব মিলিয়ে নিঃসন্দেহে ভাল খেলেছেন। কিন্তু চ্যাম্পিয়ন হতে পারেননি। নাসিরুদ্দিন শাহ-র সমালোচনা মাথায় রেখেও বলছি, ফারহান আখতারের মিলখা প্রিয়ঙ্কার থেকে এগিয়ে রইল।

ভগবানের চরিত্রে, থুড়ি মেরির স্বামী ওনলেরের ভূমিকায় দর্শনকুমারকে অবশ্য ভালই লাগে। ডিরেক্টর ওমাঙ্গ সাহেব, আপনি প্রথম ছবিতেই একটা চ্যালেঞ্জিং বিষয় বেছে নেবার সাহস দেখালেন। সেটা একশো বার তারিফযোগ্য। কিন্তু আশ মেটাতে পারলেন না। সব রকম সম্ভাবনা নিয়েও তাই ‘মেরি কম’ আর একটা ‘কোনি’ বা ‘চক দে ইন্ডিয়া’ হয়ে উঠল না। তবে হ্যাঁ, ‘মেরি কম’-এর মতো গল্প যে ভাবেই বলা হোক না কেন, যত বার বলা হোক না কেন, ইন্সপিরেশন জোগাবেই। ছবিটা দেখে অগুন্তি মানুষ মেরির কাহিনি জানবেন, গর্ব বোধ করবেন, আগামী লড়াইয়ের জন্য মেরিকে শুভেচ্ছা জানাবেন---

এও তো বড় কম নয়।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement