এ বারেও পাঁচের বাজি। গত বছরের মতো এ বছরও হিন্দি ছবিকে টেক্কা দিয়ে ‘ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল অব ইন্ডিয়া’-এর ইন্ডিয়ান প্যানোরামা বিভাগে জায়গা করে নিয়েছে পাঁচ-পাঁচটা বাংলা ছবি। তবে আলোচনার কেন্দ্রে মূলত তিনটি নাম। শৌভিক মিত্রর ‘পুনশ্চ’, বৌদ্ধায়ন মুখোপাধ্যায়ের ‘তিন কাহন’ এবং অয়নাংশু বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘বোধন’। প্রথম দানেই কিস্তিমাত করে দিয়েছেন এই তিন পরিচালক। প্রথম ছবিতেই যে জায়গা করে নিয়েছেন ইন্ডিয়ান প্যানোরামাতে।
৫৪ বছর বয়সি শৌভিক মিত্র বহু বছর ধরে ঋতুপর্ণ ঘোষের সহকারী পরিচালক ছিলেন। টেলিভিশনেও অনেক বছর কাজ করেছেন। তবে পরিচালক হিসেবে ‘পুনশ্চ’ই শৌভিকের প্রথম ছবি। অভিনয় করেছেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ও রূপা গঙ্গোপাধ্যায়। অন্য বাংলা ছবিগুলো নিয়ে ভোটাভুটি হলেও সূত্রের খবর অনুযায়ী, ‘পুনশ্চ’ ছবিটি সর্বসম্মতি পায় বিচারক মহলে। শৌভিকের কথায়, “আমাদের মতো পরিচালকরা মনে মনে নতুন কিছু করার কথা ভাবি। প্রতিষ্ঠিত পরিচালক বলতে আমরা যাঁদের বোঝাই, তাঁরা হয়তো সৃষ্টিশীল ভাবে নতুন কিছু ভাবতে পারছেন না। কোথাও একটা গিয়ে আটকে পড়েছেন।” বন্ধু ঋতুপর্ণ ঘোষের কথা টেনে বলেন, “ওঁর শেষের ক’টা ছবিতে যেমন একঘেয়েমি এসে গিয়েছিল।” শৌভিক জানান, বিচারকেরা বড় নামের বদলে যে এ বার নতুন নামকে জায়গা দিয়েছেন, তাতে তিনি খুশি। বলেন “জুরি বোর্ডকে ধন্যবাদ যে, তাঁরা নাম নিয়ে কোনও পক্ষপাত করেননি।”
এ ধরনের অনামী ব্যানারের ছবির ভাগ্যে সেই অর্থে প্রচার জোটে না। তাই প্রযোজকে র টাকাও ওঠে না। সাধারণ মানুষ জানতেও পারেন না, কবে ছবি প্রেক্ষাগৃহে এসে চলে যায়। সে নিয়েও শৌভিক জানান, তাঁর ছবির বাজেট ছিল মাত্র ৫৫ লাখ। ইন্ডিয়ান প্যানোরমাতে ছবি মনোনীত হলে, সেই ছবিটি জাতীয় নেটওয়ার্কে দেখানো হয়। তার মানে স্ক্রিনিংয়ের স্বত্ব বাবদ ২৫ লক্ষ টাকা পাওয়াটা নিশ্চিত হয়ে গেল। তাতে প্রযোজকের খুব সুবিধা হবে।
আর এক পরিচালক ৪২ বছর বয়সি অয়নাংশু বন্দ্যোপাধ্যায় পেশায় ইঞ্জিনিয়ার। আইআইটি খড়্গপুর থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে আমেরিকায় গিয়ে স্কলারশিপ নিয়ে এমএস এবং এমবিএ করেছিলেন। তার পর সে দেশেই ছ’-সাত বছর চাকরি করেন। ২০০৩ সালে দেশে ফিরে আসেন। চাকরি নেন কর্পোরেট দুনিয়ায়। কিন্তু ভালবাসা ছিল সিনেমা। বললেন, “২০১২ সালে চাকরি ছেড়ে দিয়ে ঠিক করি ফিল্ম বানাব। শুরু করি একটা স্বল্প দৈর্ঘ্যের ছবি দিয়ে। পরে মাতৃত্বের উপর নিজের লেখা চিত্রনাট্য দিয়ে তৈরি করি ‘বোধন’।” ওটাই ছিল অয়নাংশুর প্রথম পূর্ণ দৈর্ঘ্যের ছবি। অভিনয়ে অর্পিতা চট্টোপাধ্যায়, জয় সেনগুপ্ত, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, মমতাশঙ্কর প্রমুখ। একদম কাউকে না চিনে ফিল্ম দুনিয়ায় পা ফেলেই প্যানোরামায় নির্বাচিত হয়ে যাওয়ায় খুশি অয়নাংশু।
উচ্ছ্বসিত বৌদ্ধায়ন মুখোপাধ্যায়ও। বছর একচল্লিশের এই মুম্বই নিবাসী পরিচালক বিজ্ঞাপনী ছবি বানাতেন। ‘তিন কাহন’ তাঁর প্রথম পূর্ণ দৈর্ঘ্যের ছবি। বললেন, “ছ’টি চলচ্চিত্র উৎসবে দেখানো হয়েছে আমার ছবি। কসভোতে ‘তিন কাহন’ দু’টি পুরস্কার পেয়েছে। আমার সৌভাগ্য যে প্রথম ছবির নামের পাশে প্যানোরামাতে নির্বাচিত হওয়ার কথা লিখতে পারব।”
‘তিন কাহন’ এখনও মুক্তি পায়নি। বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায়, সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ আর বৌদ্ধায়নের নিজের লেখা তিনটে গল্প নিয়ে তৈরি হয়েছে এই ছবি। টলিউড থেকে প্যানোরামার দৌড়ে নতুন পরিচালকদের পাল্লা ভারী শুনে বলেছেন, “আমার মনে হয়, যে কোনও চলচ্চিত্র উৎসবের বাছাই পর্বে একমাত্র মাপকাঠি হল ছবির মান। নতুন-পুরনো, নামী-অনামী পরিচালক হওয়াটা মুখ্য নয়। ছবি ভাল কি না সেটাই মূল বিষয়।”
তবে এর মধ্যেও রয়ে যাচ্ছে কিছু বিতর্ক। ইন্ডিয়ান প্যানোরামায় যে ৩২টা ছবি পাঠানো হয়েছিল, তার মধ্যে ছিল অঞ্জন দত্তের ‘শেষ বলে কিছু নেই’, রাজা সেনের ‘কাঞ্চা’, সৃজিত মুখোপাধ্যায়ের ‘জাতিস্মর’, অতনু ঘোষের ‘এক ফালি রোদ্দুর’, শেখর দাসের ‘নয়নচাঁপার দিনরাত্রি’, অনিরুদ্ধ রায়চৌধুরীর ‘বুনো হাঁস’ এবং সোমনাথ গুপ্তর ‘ডাকের সাজ’। মনোনীত হয়নি কোনওটিই। বরং প্রতিষ্ঠিত পরিচালকদের ছবি বলতে এক মাত্র কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘ছোটদের ছবি’ ও সুদেষ্ণা রায়-অভিজিৎ গুহ পরিচালিত ‘যদি লভ দিলে না প্রাণে’ মনোনীত হয়েছে। যেখানে জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত ‘জাতিস্মর’ মনোনয়ন পায়নি, সেখানে ‘বোধন’ নির্বাচিত হয়ে যাওয়ায় প্রশ্ন তুলেছেন কেউ কেউ। তবে সৃজিত এ নিয়ে কোনও মন্তব্য করতে চাননি। শেখর দাস বলেন, “ছবিগুলো আমি দেখিনি। যদি গুণাগুণের ভিত্তিতে আমার ছবির থেকে এগিয়ে থাকে, তা হলে নিশ্চয়ই এটা ওঁদের প্রাপ্য। নিজে দেখে তার পরই বিচার করব।”
পরিচালক প্রদীপ্ত ভট্টাচার্য বলেন, “আমার ছবি ‘বাকিটা ব্যক্তিগত’ গত বছর জাতীয় পুরস্কার পেলেও প্যানোরামাতে জায়গা পায়নি। এ বছর যে নতুনদের কাজ নির্বাচিত হয়েছে, তাতে খুব খুশি।”
গুঞ্জনটা অয়নাংশুও শুনেছেন। সে প্রসঙ্গে বলেন, “আমার ছবিটা কেউ দেখেনি। তা হলে, কেন এমন প্রশ্ন তোলা হচ্ছে! আমি এই ফিল্ম জগতের সঙ্গে সে ভাবে যুক্ত নই। কারা বিচারক, তা-ও জানি না। এইটুকু বলতে পারি ছবিটা প্যানোরামাতে জায়গা পেয়েছে। নতুন কোনও পরিচালককে জায়গা করে দেওয়ার এই প্রচেষ্টাকে স্বাগত।”