চার ইয়ারি কথা। তবে প্রেমের নয়, মৃত্যুর। চারটি মৃত্যু এবং আরও কিছু।
তিন প্রবীণ আর এক নবীন পরিচালক চলেছেন প্রোডিউসারকে গল্প শোনাতে। মৃত্যু বিষয়ক চারটি শর্ট ফিল্ম বানাবেন তাঁরা। চারটি গল্প, চারটি মৃত্যু, চার পরিচালকের পিওভি।
এই প্লট হাতে নিয়ে বলা যায়, যেতে পারি/ যে কোনও দিকেই আমি চলে যেতে পারি...
সৃজিত মুখোপাধ্যায় থ্রিলারের দিকে গেছেন। তবে পুরোটা নয়। ‘চতুষ্কোণ’কে বলা চলে থ্রিলার এবং আরও কিছু।
তৃণা, শাক্য, দীপ্ত, এবং জয়। তৃণা সত্তর দশকের ডাকসাইটে নায়িকা। পরে পরিচালনায় এসেছে। শাক্য এক সময় সিরিয়াস ছবি করিয়ে বলে নাম কিনেছিল। এখন কম কাজ করে। দীপ্ত মশালা ছবির দাপুটে নায়ক ছিল, পরিচালনাও করেছে। এখন সব ছেড়ে দিয়েছে। জয় কমবয়সি। অভিনয় করে। অল্প অল্প করে পরিচালনায় হাত পাকাচ্ছে। কোন চরিত্রে কে, বলার জন্যে পুরস্কার নেই।
অনেক দিন পরে চার মাথা এক হয়ে ছবি বানাতে রাজি হয়। তার পর কী হল, হল-এ গিয়ে দেখে আসুন। জব্বর থ্রিলার! অপর্ণা-গৌতম-চিরঞ্জিত-পরমের অভিনয়! অনুপমের গান! সৃজিতের রান্না! পুজোর বাজারে ধামাকা ককটেল!
তবে ছবিটা টেক অফ করতে বেশ খানিকটা সময় নেয়। গান ধরার আগে গলা খাঁকারির অংশটা বেশ মন্থর। শাক্য-দীপ্ত-তৃণা তিন জনের কারওরই বর্তমান জীবনের ট্র্যাকগুলো জমেনি। যত ক্ষণ না শাক্য তার মৃত্যু-কাহিনি বলতে শুরু করে, ততক্ষণ অবধি ছবিটা তেমন আকর্ষণীয় নয়। কিন্তু স্টোরি-টেলিং সেশন শুরু হওয়ার পর থেকে দুরন্ত এক্সপ্রেস। মাঝে মাঝে সমান্তরাল ট্র্যাক যখন ফিরে আসে, তখন আবার গতি কিছুটা ধাক্কা খায়। তৃণা-তৃণার বর, শাক্য-শাক্যর স্ত্রী, দীপ্ত-দীপ্তর ছেলে, দীপ্তর ছেলে-দীপ্তর প্রেমিকা, নীলাঞ্জনা-ঋ
ত্বিক-অমিত এই সব সাবপ্লটে যদি আরও ঝাঁঝ থাকত, ‘চতুষ্কোণ’য়ের কোনাগুলো আরও ছুঁচলো হতে পারত।
কিন্তু এই খামতি অনেকটা ঢেকে দেয়, তিনখানি ছোট গল্প। ছোট গল্প মানে সাহিত্যের ক্লাসে ক্লাসিক ছোট গল্প বলতে যা বোঝায়, তাই। শাক্য, দীপ্ত, তৃণা তিন জনে তিনটে গল্প শোনায়। তিনটিই কাহিনিগুণ এবং নির্মাণের মুন্সিয়ানায় যাকে বলে ‘এক ঘর’! কারটা বেশি ভাল? তৃণার গল্পের টুইস্ট সবচেয়ে মোক্ষম। কিন্তু আমার ভোট দীপ্তর সিগারেট প্যাকেটে পড়বে। তবে দর্শকরা আপনারা বিধিবদ্ধ সতর্কীকরণটি অগ্রাহ্য করবেন না। স্মোকিং কিন্তু কিলস্!
চার নম্বর গল্প নিয়ে একটা কথাও লিখব না। এটুকুই বলছি, এ গল্পে তিনটি টুইস্ট আছে। সেগুলোর মধ্যে কোনটা কত ভোট পাবে, সেটা আপনাদের জন্যই তোলা রইল। আমরা বরং ইত্যবসরে অন্য কয়েকটা ভোটাভুটি সেরে রাখি।
অভিনয় এ ছবি চার জনের খেলা। বাকিরা চিত্রনাট্যের দাবি মেনে বল কুড়িয়েছেন বা তোয়ালে এগিয়ে দিয়েছেন। রাহুল-কনীনিকা-অর্পিতা-সুজন-শান্তিলাল-ইন্দ্রাশিস-দেবলীনা...মায় পায়েলও। পায়েল গান পেয়েছেন, কিছু চোখা সংলাপও। তাঁকে খুব সুন্দর দেখাচ্ছে। কিন্তু আসল খেলাটা অপর্ণা, গৌতম, চিরঞ্জিত, পরমেরই। ‘অন্তহীনে’র পরে এই প্রথম অপর্ণা অন্য কারও ছবিতে অভিনয় করলেন। তৃণার খাপে এঁটে বসে গেলেন। গৌতমের চরিত্রে এক সিরিয়াস পরিচালক সত্তাটুকু ছাড়া রিল-রিয়েলের মিলমিশ তেমন নেই। আর একটু রেফারেন্স বেশি থাকলে মন্দ হত না। গৌতমের শাক্যকে মেরে বেরিয়ে যায় গৌতমেরই অনিমেষ।
ঈষৎ গোবেচারা গোছের চরিত্র পরম বরাবরই ভাল করেন। এখানেও করলেন, সেটাকে ছাড়িয়েও গেলেন। এখন অবধি তাঁর শ্রেষ্ঠ অভিনয়। আর শ্রেষ্ঠ চমক চিরঞ্জিত। দু’দুটো চরিত্রে দু’হাতে র্যাকেট চালালেন। মাস্টারমশাই, আপনি কিন্তু এই চিরঞ্জিতকে দেখেননি! ট্রফি তাই পরম আর চির-সখাকেই দিতে হচ্ছে। কাহিনিকার-পরিচালকের পক্ষপাতও বোধ করি তাঁদের দিকে কিঞ্চিৎ বেশি ছিল। চরিত্রের শেডই বলি, রিল-রিয়েলের কুমির-ডাঙাই বলি এই দু’জনের ঝোলাই ভারী। চতুষ্কোণ বর্গক্ষেত্র হতে হতেও তাই আয়তক্ষেত্র হয়ে গেল!
খেলা থাকলে, আম্পায়ারও থাকতে হয়! কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়! শুরু আর শেষে দু’টো সিন, ওস্তাদের মার! উনি আছেন বলে হল থেকে বেরিয়ে মনে হতে পারে, ছবির নাম পঞ্চবটী হলেও ক্ষতি ছিল না!
গান চতুষ্কোণ সৃজিত-অনুপম জুটির চার নম্বর কাজ। কোন ছবিতে কতগুলো গান হিট, সেই সংখ্যাতত্ত্বে ‘চতুষ্কোণ’ জিতবে না। কিন্তু ‘বসন্ত এসে গেছে’র দু’টি ভার্সান অনুপমের সেরা কাজের তালিকা থেকে কোনও দিন বাদ যাবে না, হলফ করে বলা যায়। লগ্নজিতা শুধু চমৎকারই গাননি, গলাটি পায়েল সরকারের সঙ্গে একেবারে মিশে গিয়েছে! পুরুষ কণ্ঠের ‘বসন্ত’-গানটি যদি হয় এই শরতের কবিতা, স্ত্রী কণ্ঠটি যেন সেই সে-কালের। কিন্তু একেলে পরশটিও তাতে আলগা করে বুনে দেওয়া আছে! চিনলে চেনা যায়!
একটি প্রাতঃস্মরণীয় ছবিতে দেখা চরিত্রের মতো করে হাত ঝাঁকিয়ে বলতে ইচ্ছে করছে, ‘আশ্চর্য, সত্যিই আশ্চর্য’!
ক্যামেরা দৃশ্যভাষার দিক দিয়ে এখনও অবধি সৃজিতের সবচেয়ে ভাল। সুদীপ চট্টোপাধ্যায় তাঁর জাত চিনিয়ে চৌকো পর্দায় আড়াআড়ি-লম্বালম্বি-কোনাকুণি নানা ধরনের ক্ষেত্রফল তৈরি করেছেন! অসামান্য কিছু লো-অ্যাঙ্গল শট নিয়েছেন। একাধিক দৃশ্যে ফ্রেম, আলো আর রংই নায়ক!
সৃজিত সিনেমা দিয়ে যাত্রা শুরু হয়েছিল। কবিতা, গান হয়ে আবার সেই সিনেমায়। বাংলা সংস্কৃতির হরেক রেফারেন্স সৃজিতের ছবিতে সব সময় ঘুরেফিরে আসে। সেই রেফারেন্সগুলো খানিকটা ভেঙে বাঁকিয়ে নিয়েই ছবির গল্প তৈরি হয়। চতুষ্কোণও তাই। রীতিমতো খাতা-কলম নিয়ে ফর্দ বানাতে পারেন। পরম এই সিনটায় হরিধনকে টুকলেন না? ইন্দ্রদীপের আবহসঙ্গীতে মণিহারা মিশে গেল না? মৃত্যুদৃশ্যে চিরসখা? মনে পড়েছে,শুভ মহরতের প্রেরণা! বনলতার কিরণ মানে তো বাড়িওয়ালি...এই রকম আর কী!
কী বলা হবে এই রেফারেন্সধর্মিতাকে? স্বগতোক্তি, না হলিউড স্টাইল? সিগনেচার, নাকি পুনরাবৃত্তি দোষ? দুয়ের ভেদ যে বড় সূক্ষ্ম। ‘চতুষ্কোণ’য়ে সবচেয়ে বড় রেফারেন্স কিন্তু সৃজিত নিজেই। যেমন ধরুন, সিনেমার গল্প সিরিজে দ্বিতীয়। থ্রিলার সিরিজে দ্বিতীয়। মৃত্যু সিরিজে তৃতীয়। এবং এগুলো শুধু কথার কথা নয়। সৃজিতের কোন ছবির কোন ঘুঁটি এ ছবিতে খাটছে, সেটাও চাইলে ফর্দ মেলাতে পারেন।
ছ’ছটা ছবি হয়ে গেল। পথচলতি প্রসঙ্গ, কোটেশন-রেফারেন্স বুড়ি ছুঁয়ে ছুঁয়ে না বেড়িয়ে, এ বার ‘গভীরে’ যাবেন না সৃজিত? ‘চতুষ্কোণ’য়ের ছোট গল্পে একটা যাই-যাই ভাব আছে অবশ্য। সেটাই সবচেয়ে বড় পাওনা।