পোক্ত পারফর্ম্যান্সে চমকে দিয়েছেন যিশু

অন্য ধারার ছবিতে নজর কাড়লেন শুভশ্রী-ও। কিন্তু ‘শেষ বলে কিছু নেই’ অঞ্জনের বাকি ছবির মতোই... সেই পার্ক স্ট্রিট আর গিটার। লিখছেন জাগরী বন্দ্যোপাধ্যায়।শিল্পীদের দু’টো ধরন হয়। এক দল চেষ্টা করেন নিজেকে ক্রমশ ছড়িয়ে দিতে। নানা ধরনের বিষয়, নানা ধরনের ফর্ম নিয়ে কাজ করতে। আর এক দল আছেন, যাঁদের একটা একান্ত জগত্‌ আছে। তাঁরা সারা জীবন ধরে টুকরো টুকরো করে সেই জগত্‌টার গল্প বলেন। সব গল্পই সেখানে একটা বৃহত্‌ গল্পের অংশ।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০২ জুলাই ২০১৪ ০০:০০
Share:

শিল্পীদের দু’টো ধরন হয়। এক দল চেষ্টা করেন নিজেকে ক্রমশ ছড়িয়ে দিতে। নানা ধরনের বিষয়, নানা ধরনের ফর্ম নিয়ে কাজ করতে। আর এক দল আছেন, যাঁদের একটা একান্ত জগত্‌ আছে। তাঁরা সারা জীবন ধরে টুকরো টুকরো করে সেই জগত্‌টার গল্প বলেন। সব গল্পই সেখানে একটা বৃহত্‌ গল্পের অংশ।

Advertisement

দর্শকরা যখন প্রথম দলের কাজ দেখেন, তাঁরা লক্ষ করলে বুঝতে পারেন বিবিধের মাঝেও একটি মিলন আছে। আর দ্বিতীয় দলের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা ঠিক উল্টো। তাঁরা যেন অনুচ্চারে বলে দেন, এটা আমার রাস্তা। দর্শক, তুমি চাইলে আমার সঙ্গী হতে পারো।

অঞ্জন দত্ত প্রধানত এই দ্বিতীয় গোত্রের পথিক।

Advertisement

অতএব সেই পার্ক স্ট্রিট, সেই মিউজিক, সেই গিটার, সেই বাংলা ব্যান্ড...কিছু খাপছাড়া খ্যাপাটে গোছের মানুষ...আর ফিরে আসার গল্প...। অঞ্জনের ছবি অঞ্জনের গানের মতোই...চেনা কথা, চেনা সুর, চেনা ছন্দ... এর যেন শেষ বলে কিছু নেই! অঞ্জনের ছবি যাঁরা দেখতে যান, তাঁরা এগুলো জেনেই দেখতে যান।

কী বলব একে? পুনরাবৃত্তি? হ্যাঁ তা তো বটেই। কিন্তু পুনরাবৃত্তি মানেই যে দোষের, তা তো সব সময় নয়। চেনা গান শুনতে, চেনা দোকানের মিষ্টি খেতে, চেনা বন্ধুদের কাছে যেতে, চেনা ঘরে ফিরতে ভাল লাগে তো! চেনা আরাম পাওয়া যায়!

তবে একটা চেনা গল্প বারবার পড়া আর চেনা আদলের গল্প বারবার শোনা--- এ দু’টো এক নয়। সেটা করতে গেলে চেনা ভাল লাগাকেও বারবার রি-ক্রিয়েট করার মুন্সিয়ানা দেখাতে হয়। আর তার জন্যই চেনা আখ্যানেও কিছু অচেনা ঝিলিক রেখে যেতে হয়।

অঞ্জনের নতুন ছবি সেটা পারল কি?

বিপত্নীক অনিমেষ রায় বহু আয় করে বহু দেশ ঘুরে এখন ব্যাঙ্ককে ঠাঁই গেড়েছেন। লিভ-ইন সঙ্গিনীও আছে। এ হেন অনিমেষ তিরিশ বছর আগে ছেড়ে আসা ছেলেকে দেখতে কলকাতায় এলেন। আর জানতে পারলেন, ছেলে বাইক অ্যাক্সিডেন্টে মারা গিয়েছে। ছেলে গান লিখত। বাবাকে নিয়েও গান লিখেছিল। অনিমেষ খুঁজতে বেরোলেন ছেলের বন্ধুকে। যে নাকি গানগুলো জানে আর যার বাইকেই নাকি অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছিল। ছেলে আর ছেলের এই বন্ধু দু’জনেই ভরপুর মাদকাসক্ত। অনিমেষ ঠিক করলেন, এই বন্ধুটিকে দিয়ে মৃত ছেলের লেখা গান গাওয়াবেন, অ্যালবাম বের করবেন।

কাহিনি-চুম্বক এর বেশি বলার দরকার নেই। বুঝতেই পারছেন, শেষ বলে কিছু নেই বলেও ছবিটা কোথায় শেষ হবে। তাতে আপত্তির কিছু নেই। শেষে কী হল, এই সাসপেন্স বজায় রাখাটাই গল্পের একমাত্র শর্ত নয়। বরং কী ভাবে ওই শেষটায় পৌঁছনো যাবে, সেই জার্নিটাই আসল কথা। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে কী, এই ছবির জার্নিটাও বড্ড বেশি চেনা।

গলদটা চিত্রনাট্যেরই। প্রধান চারটে চরিত্র অনিমেষ, অ্যান্ডি, শ্বশুরমশাই আর অ্যান্ডির বান্ধবী কোকো একটা অদ্ভুত সময়ে মুখোমুখি হয়। আর সেই সময়টার মধ্যে দিয়ে যেতে যেতে চারটে চরিত্রই একটু একটু করে বদলে যায়। বদলে যায় তাদের ভেতরকার রসায়নও। এইটা দেখাতে হলে ওই চার জনের ঘাত-প্রতিঘাত থেকে যে টেনশন তৈরি হবে, সেটাই গল্পকে বাঁচিয়ে রাখবে। ছবিতে ঠিক এটারই খামতি। অন্য পাঁচটা জিনিসের ভিড়ে টেনশনের মুহূর্তগুলো এখানে কুঁড়ির মতো তৈরি হয়। তার পর পাপড়ি মেলার যথেষ্ট সময় না দিয়েই হঠাত্‌ ফুল ফুটে যায়। তিরিশ বছরের দূরত্বগুলো বড় তাড়াতাড়ি একটা-দু’টো হোঁচট খেয়েই মসৃণ হয়ে যায়। শ্বশুরমশাই একটু গাঁইগুঁই করেই অ্যান্ডিকে বাড়িতে রাখতে রাজি হয়ে যান। কোকো বলে দেয়, অ্যান্ডিকে ছেড়ে কোথাও যাবে না। অ্যান্ডি এক বার বিগড়ে গেলে শ্বশুরমশাই রেগে যান। কোকো গলা তুলতেই আবার সবাই চুপ...এই রকম আর কী! সব ক’টা চরিত্রকেই আমরা অনিমেষের চোখ দিয়ে দেখি। স্বতন্ত্র ভাবে তাদের মনের মধ্যে কী চলছে, তত দেখতে পাই না। অনিমেষও যে এত দূর ছুটে এসে শুনল, ছেলেটা আর নেই--- সেই আকস্মিকতার অভিঘাতটা দর্শকের মধ্যে সে ভাবে চারিয়ে যায় না।

‘শেষ বলে কিছু নেই’ আর ‘তুমি চলে গেলে’ গান দু’টো ভাল লাগে। চেনা আমেজের খাতিরেই ভাল লাগে। ভাল লাগে সুপ্রিয় দত্তের ক্যামেরার ‘র’ আর ঘন টেক্সচার। ভাল লাগে সম্পাদনার (বোধাদিত্য বন্দ্যোপাধ্যায়) কিছু টাচ! যা অ্যাকোরিয়ামের মাছগুলোর মতোই অনুচ্চকিত।

অভিনয়ে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় এখন যে স্তরে পৌঁছেছেন, পর্দায় এলেই মনে হয় ঈশ্বর নেমে এসেছেন। অঞ্জন অঞ্জনের মতো। ব্রাত্য ব্রাত্যর মতো। বৈঠকখানায় বসে মুড়ি খেতে খেতে মানুষ যে ভাবে কথা বলে, এঁরা সংলাপ বলাটাকে সেই সহজতায় নিয়ে গিয়েছেন। সেই সঙ্গে এটাও বলা দরকার, এঁদের কেউই এমন কোনও চরিত্র এখানে করেননি যাতে নিজেদের নতুন করে ভাঙচুর করতে লাগে।

সেই ঝক্কিটা কিন্তু যিশু এবং শুভশ্রীর ছিল। শুভশ্রী এই প্রথম মশলা ছবির বাইরে কিছু করলেন। এবং সেখানে প্রথমেই তাঁকে সৌমিত্র-অঞ্জনের মতো অভিনেতাদের সঙ্গে ফ্রেম শেয়ার করতে হল। ভাবুন চাপটা! শুভশ্রী কিন্তু নজর টানলেন। প্রথমত তাঁকে ভারী সুন্দর দেখাচ্ছিল। বিশেষ করে গাঢ় কাজলের চোখ দু’টি আর চুল বাঁধার স্টাইল। দ্বিতীয়ত খুব বড় চরিত্র না হলেও শুভশ্রী সাধ্যমতো ভাল অভিনয়ই করলেন। সৌমিত্রকে কড়া কড়া কথা শোনানোর দৃশ্যে লম্বা সংলাপ। পুরো পোক্ত হননি বোঝা গেল, কিন্তু চেষ্টার ছাপটাও থাকল।

আর পোক্ত পারফরম্যান্সের বিচারে এ ছবিতে যিনি সত্যিই চমকে দিয়েছেন, তিনি যিশু। এর আগে ‘চিত্রাঙ্গদা’ ছবিতে তাঁকে মাদকাসক্তের চরিত্রে দেখেছিলাম। এটাতেও দেখলাম। যিশু কিন্তু দু’টো সম্পূর্ণ আলাদা চরিত্রই তৈরি করলেন! খুব কম অভিনেতাকেই এমন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হয়। একাধিক বার পুলিশ অফিসার সাজা বা একাধিক বার গুন্ডা সাজা হামেশাই দেখা যায়। কিন্তু একাধিক বার অন্ধের চরিত্র করেছেন, একাধিক বার পাগল সেজেছেন এমনটা খুব বেশি ঘটে না।

সব মিলিয়ে কী দাঁড়াল? অঞ্জনের ছবি অঞ্জনের চেনা ছবির মতোই দাঁড়াল। ওর ভাবনার সঙ্গে সবটা সহমত না হতে পারি, কিন্তু আবেগটা নিয়ে কখনও সন্দেহ জাগে না। মেকি মনে হয় না। আর সেটাই অঞ্জনের চিরকেলে জোরের জায়গা। মাঝে গণেশ টকিজ ধন্দ জাগিয়েছিল। এ বার দেখলুম অঞ্জন ঘরে ফিরেছেন। শেষ বলে তা হলে কিছু নেই।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement