সুনীলদাকে একবার বলেছিলাম যে ওঁকে নিয়ে একটা ছবি বানাতে চাই। যদিও তত দিনে বিষ্ণু পাল চৌধুরী একটা তথ্যচিত্র বানিয়ে ফেলেছেন। সুনীলদা উদাসীনভাবে বললেন, “একটা তো হয়েই গিয়েছে। আবার আর একটা বানিয়ে কী হবে?”
কবিতা যখন ছবি
কিন্তু সুনীলদাকে নিয়ে ছবি বানানোর ইচ্ছে আমার আজও গেল না। আর সেই চিন্তা করলেই মনে হয় এ তো সুনীল নয়, সুনীল সাগর.... এত বড় এক সাগরকে কী ভাবে ধরব একটা তথ্যচিত্রে! কবিতার সব চিত্রকল্প তো সিনেমার দৃশ্যকল্প হতে পারে না। যেমন নীরাকে কখনও পূর্ণাঙ্গ ভাবে দেখাব না। সে যে কল্পনার নারী। হয়তো নীরার কবিতা যখন তথ্যচিত্রে আসবে দেখাব কোনও অ্যাবস্ট্র্যাক্ট পেইন্টিং, কোনও নারীর হাতের আঙুল, দেখাতে পারি কোনও আলোর বিচ্ছুরণ, কিংবা প্রকৃতি। নীরাকে গড়তে গিয়ে চলে আসবে সুনীলের গল্প উপন্যাসের আর সব নারী। জীবনের নারীরাও। বাস্তব, অবাস্তব আর পরাবাস্তবের মিশেল ঘটবে এই নীরা আর নারীর প্রসঙ্গে। তা না হলে নীরাকে দাঁড় করানো যাবে না।
সুনীলদার প্রথম দিককার কবিতার বইগুলো যেমন ‘আমি কী রকম ভাবে বেঁচে আছি’ ‘আমার স্বপ্ন’ ‘সত্যবদ্ধ অভিমান’ ‘জাগরণ হেমবর্ণ’ এসবের মধ্যে রয়ে গিয়েছে কবি সুনীলের বেড়ে ওঠার স্পর্শ। তাঁর জন্মের শহর ফরিদপুর, তাঁর ছেলেবেলা, তার পর কলকাতায় আসা, উত্তর কলকাতা-দক্ষিণ কলকাতা দাপিয়ে বেড়ানো এক মানুষ চলে আসবেন তথ্যচিত্রে এই সব বইয়ের কবিতার হাত ধরে। এই কাব্য জগতের পাশেই ছিলেন সুনীলের বন্ধুবান্ধব। শরৎ কুমার মুখোপাধ্যায়, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়, শক্তি চট্টোপাধ্যায়েরা। কবিতা নিয়ে তাঁদের সকলের উন্মাদনা আমার তথ্যচিত্রে চলে আসবে।
এই কবিতা অবশ্যই আসবে—
“আমি কী রকম ভাবে বেঁচে আছি/ তুই এসে দেখে যা নিখিলেশ/ এই কি মানুষ জন্ম?/ নাকি শেষ পুরোহিতকঙ্কালের পাশা খেলা?”
গল্প-উপন্যাস-সিনেমা থেকে
‘আত্মপ্রকাশ’ বা ‘যুবকযবতী’র মতো উপন্যাস বড় হয়ে যখন পড়েছি তরুণসমাজের যে ছবি তিনি এঁকেছেন তার সঙ্গে নিজেদের আইডেনটিফাই করতে পেরেছি। এই সব উপন্যাস, গল্পের কিছু অংশের চিত্রনাট্য তৈরি করে তথ্যচিত্রে আনা যেতে পারে। এমন ভাবে গল্পগুলোকে বাছব যার মধ্যে একটা বৈচিত্র থাকবে। সুনীলদার তো নানা ধরনের লেখা আছে। সেখান থেকে চরিত্রগুলো বের করে আনতে পারি। ‘জলজঙ্গলের কাব্য’ যখন লিখছেন সে আবার অন্য এক সুনীল। ফুটে ওঠে সুন্দরবনের মানুষ, অরণ্য। এই সব অনুষঙ্গ তথ্যচিত্রে থাকবে। আবার কয়েকজন বন্ধু মিলে এই সুনীলদারাই চলে গিয়েছিলেন একবার ট্রেনে করে ধলভূমগড়। সেই অভিজ্ঞতা, কাহিনি আকারে প্রকাশ হওয়ার পর সত্যজিৎ রায় ছবি করলেন ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’। অসাধারণ ছবি হল। কিন্তু সে ছবি দেখে সুনীলদার মনে হয়েছিল তাঁদের মধ্যে যে দামালপনা ছিল, ছবির চরিত্রদের মধ্যে সেটা ছিল না। গল্পে যা হয় সিনেমায় তা অন্য ভাবে রূপান্তরিত হতেই পারে। ‘অরণ্যের দিনরাত্রির’ ক্ষেত্রে সেটা হয়েছিল। সুনীলদার গল্প নিয়ে ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’ করেছেন সত্যজিৎ রায়। অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছবি। তথ্যচিত্র করলে ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’ আর ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’ থেকে কিছু ক্লিপিংস রাখব অবশ্যই। ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’রই স্মৃতি-অবলম্বনে ছিল আমার ছবি ‘আবার অরণ্যে’। এই ছবিও ফিরে আসতে পারে সুনীলদাকে নিয়ে তথ্যছবি করলে। তার কারণ সুনীলদাকে যখন ‘আবার অরণ্যে’র চিত্রনাট্য লিখে দেখাই, উনি বলেছিলেন, “তুমি তো লিখেই ফেলেছ। আমি আর কী লিখব?” আসবে ‘দেখা’ ছবির দৃশ্যও। এর গল্প আর চিত্রনাট্য আমি আর সুনীলদা মিলে লিখেছিলাম।
জানি না কবে এই তথ্যচিত্র বানাব, কিংবা আদৌ হবে কি না। কিন্তু হলে এই সব মালা গেঁথেগেঁথেই বানাব।
আমার ক্যামেরা যেন সুনীলদার চোখ
আর এক দিকে সুনীলদা ছিলেন ইতিহাসচারী। অন্য এক সুনীল বেরিয়ে এলেন যখন পিরিয়ড উপন্যাস লিখতে শুরু করলেন। বাঙালির জীবনের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দলিল ‘সেই সময়’, ‘পূর্ব-পশ্চিম’, ‘প্রথম আলো’। তথাচিত্রে ‘সেই সময়’য়ের কলকাতাকে গড়ব, আনব ‘পূর্ব-পশ্চিম’য়ের দুই বাংলার দৃশ্য, ‘প্রথম আলো’য় রবীন্দ্রনাথের মনের উদ্ভাস এসব নিয়ে স্মৃতিমালা গাঁথব। তার জন্য আমাকেও ইতিহাসচারী হতে হবে। সুনীলদার ইতিহাস, পুরাণ, বেদ বেদান্ত, বৌদ্ধধর্ম , কোরান সবেতেই প্রবল প্রজ্ঞা ছিল। আমি নিজেই এই সব বিষয় নিয়ে বহুবার আড্ডা দিয়েছি ওঁর সঙ্গে। হয়তো এই সব ইন্টারেস্ট থেকেই ‘রাধাকৃষ্ণ’ বলে একটা ছোট্ট উপন্যাস লিখেছিলেন। বিপ্লব রায় চৌধুরী তা নিয়ে ছবি করতে চেয়েছিলেন।
অরণ্যের দিনরাত্রি।
কাজটা অসমাপ্ত থেকে যায়। ‘রাধাকৃষ্ণ’র জন্য খান পাঁচেক গান লিখেছিলেন সুনীলদা। তার মধ্যে ‘মেঘারানি’ গানখানা অপূর্ব। তথ্যচিত্রে এই গানটি কাউকে দিয়ে গাওয়াবার চেষ্টা করব।
ইতিহাসের কথায় মনে পড়ল সুনীলদা পুরনো দিনের মানুষজনকে নিয়ে উপন্যাস লিখেছেন। যেমন শিশির ভাদুড়িকে নিয়ে ‘নিঃসঙ্গ সম্রাট’। এটি নাটকও হয় এখন। নিতে হবে সেই নাটকের কিছু মুহূর্ত। মোট কথা, সুনীলদাকে নিয়ে তথ্যচিত্রে ইতিহাসের একটা বড় ভূমিকা থাকবে। আমার ক্যামেরা চলবে সুনীলদার চোখ হয়ে। ‘ছবির দেশে কবিতার দেশে’ বইয়ে সুনীলদা ইউরোপের চিত্রকলা, ইউরোপের মনন, ইউরোপের সাহিত্য নিজের মতো করে দেখছেন বুঝছেন লিখেছেন। ইউরোপে গিয়ে ওই সব জায়গায় শ্যুট করে আনতে পারি ‘ছবির দেশে, কবিতার দেশে’য়ের স্মৃতিমালা। আমার ক্যামেরা তখন ঘুরে বেড়াবে সে দেশের বিভিন্ন মিউজিয়ামে, বিভিন্ন আড্ডায় যেখানে কবিরা বসতেন.....এটা আমার তথ্যচিত্রের চমৎকার দৃশ্য হতে পারে। যদিও সুনীলদাকে নিয়ে তথ্যচিত্র বানাতে গিয়ে ইউরোপ চলে যাওয়াটা খুব খরচসাপেক্ষ হয়ে উঠবে। তবু এই মুহূর্তে ভাবতে দোষ কী? যদি যাই তো বেশ হয়।
এস্টাব্লিশমেন্ট শট
কোনও অভিনেতাকে সুনীলদা সাজিয়ে তথ্যচিত্রে অভিনয় করাব না। তাই এমন একটা কিছু করতে হবে যাতে প্রথম দৃশ্যেই দর্শকের মন সুনীলসাগরে ডুবে যেতে পারে।
প্রথম দৃশ্যটা করব এই রকম। কুয়াশার মধ্যে এক অকূল গাঙ। সেখানে সিলুয়েটে থাকবে এক অবয়বহীন ছায়ামূর্তি। তার এক হাতে কলম। অন্য হাতে আবছা ভোরের অন্ধকারে দেখা যাচ্ছে খাতার পাতা। সে মানুষই হয়তো সুনীলদা, হয়তো নীললোহিত যে কিনা অকূল গাঙে জীবনের খোঁজ করতে করতে দিকশূন্যপুরের দিকে যাত্রা করছে।
কালার প্যালেট
তথ্যচিত্রের রং হবে হাল্কা ধূসর। হাল্কা লাল, হাল্কা নীল, হাল্কা সবুজ রঙের প্রলেপ থাকবে ছবির কালার প্যালেটে। অনেকটা জাপানি ওয়াশ পেইন্টিংয়ের মতো। কোনও গাঢ় রং ব্যবহার করব না।
শেষ শট
সুনীলদার কণ্ঠস্বর মিশে যাচ্ছে মানুষের ভিড়ের মধ্যে। কলকাতা থেকে কানাডা, পুরুলিয়া থেকে বর্ধমান-বাঁকুড়া-বাংলাদেশ হয়ে বোস্টন সর্বত্র বহু মানুষ সুনীলদাকে স্মরণ করছে তাঁর কবিতায়, গল্পে, সাহিত্য আলোচনায়। সুনীলসাগরে ডুবে গেছেন তাঁরা সবাই।