চার্লিজ এঞ্জেলস’: লুসি-ক্যামেরুন-ড্রু
মনে আছে ‘চার্লিজ এঞ্জেলস’-এর লুসি লিউকে?
২০০০ সালের জনপ্রিয় অ্যাকশন কমেডির সেই প্রাইভেট ডিটেকটিভ, যিনি অভিনয় করেছিলেন ক্যামেরুন ডিয়াজ আর ড্রু ব্যারিমোরের সঙ্গে?
হলিউডের তারকা লুসি আবার শিরোনামে এসেছেন শার্লক হোমসকে নিয়ে ‘এলিমেন্ট্রি’ সিরিজের জন্য। যেখানে তিনি রয়েছেন ডা. জোন ওয়াটসনের ভূমিকায়। শার্লকের ভূমিকায় জনি লি মিলার। ‘এলিমেন্ট্রি’র প্রথম দু’টো সিজন অত্যন্ত জনপ্রিয় হওয়ার পর তৃতীয় সিজনের জন্য আবার শ্যুটিং শুরু হয়েছে নিউ ইয়র্কে। সেখানে শুধু অভিনয় নয়, লুসিকে দেখা যাবে পরিচালকের ভূমিকাতেও!
তবে লুসির পরিচালনার হাতেখড়ি ‘এলিমেন্ট্রি’ দিয়ে নয়। কয়েক বছর আগে মুম্বইতে এসে তিনি পরিচালনা করেছিলেন একটি হিন্দি শর্ট ফিল্ম। নাম ‘মীনা’। সে ছবিতে নামভূমিকায় অভিনয় করেছেন বাঙালি অভিনেত্রী তন্নিষ্ঠা চট্টোপাধ্যায়। তিনি নিউ ইয়র্ক গিয়েছিলেন ‘সিদ্ধার্থ’ ছবির আমেরিকান রিলিজের জন্য। সেখানেই ২৬ জুন ‘মীনা’র প্রথম স্ক্রিনিং হয়। ‘এলিমেন্ট্রি’র শ্যুটিংয়ের ফাঁকে সময় বের করে লুসি এসেছিলেন সেই প্রিমিয়ারে। সঙ্গে ছিলেন হলিউডের সেলিব্রিটি যোগ-গুরু দীপক চোপড়া। ছবির স্ক্রিনিং, প্রশ্নোত্তর পর্ব শেষ হলে পর দিন নিউ ইয়র্কের একটা কফি জয়েন্টে লুসি আড্ডা দিলেন তন্নিষ্ঠার সঙ্গে। হলিউডে অভিনয় থেকে টেলিভিশন সিরিজ পরিচালনা, অ্যাকশন দৃশ্য শ্যুট করা থেকে পেশাদার মেয়েদের নিজেদের ডিম্বাণু সংরক্ষণ করা সব প্রসঙ্গই উঠে এল কথার মাঝখানে।
নিউ ইয়র্ক টাইমস থেকে বিশ্বের প্রথম সারির নানা দৈনিকেই লেখা হয়েছে ‘মীনা’ ছবিটি নিয়ে। এক সত্যি ঘটনার ভিত্তিতে তৈরি এই ছবি। মাত্র ৮ বছর বয়সে মীনা হাসান বলে এক মেয়েকে তার কাকা অপহরণ করে এক বেশ্যালয়ে বিক্রি করে দেয়। প্রায় ১২ বছর সেখানেই পড়ে থাকে মীনা। বেশ্যালয়েই জন্ম দেয় দুই সন্তানের। ভাগ্যক্রমে এক সময় মীনা সেখান থেকে পালিয়েও যায়। যদিও ফেলে আসে নিজের অতীত ও দুই শিশুকন্যাকে। নাড়ির টান তাকে বারবার ফিরিয়ে নিয়ে যায় সেই বেশ্যালয়ে। চেষ্টা করে মেয়েদের সেখান থেকে উদ্ধার করার। নিকোলাস ডি ক্রিস্টফ আর শেরিল উডানাস-এর বেস্ট সেলিং বই ‘হাফ দ্য স্কাই: টার্নিং অপ্রেশন ইনটু অপরচুনিটি ফর উইমেন ওয়ার্ল্ডওয়াইড’য়ের একটি চ্যাপ্টার মীনার কন্যা নয়নাকে এই বেশ্যালয় থেকে উদ্ধার করার ঘটনাকে কেন্দ্র করে। আর সেই অধ্যায়ের ভিত্তিতেই লেখা লুসির চিত্রনাট্য।
নিউ ইয়র্কের প্রিমিয়ার শেষ করে তন্নিষ্ঠা কলকাতায় এসেছিলেন সোহিনী দাশগুপ্তর প্রথম হিন্দি ছবির জন্য ডাবিং করতে। বলছিলেন লুসির ছবির শ্যুটিংয়ের সময় তাঁর দেখা হয়েছিল বাস্তবের মীনার সঙ্গেও। কথা হয়েছিল তাঁর জীবনসংগ্রাম নিয়ে।
নিউ ইয়র্কে লুসি লিউ-তন্নিষ্ঠা চট্টোপাধ্যায়
লুসির ছবিটা আপলোড করা আছে ইন্টারনেটে। ২২ মিনিটের সেই ছবি মন ছুঁয়ে যায় অনেকের। মেয়েকে উদ্ধার করতে বারবার বেশ্যালয়ে ফিরে যাওয়ার দৃশ্যগুলো নাড়া দিয়েছে দর্শকদের। চুলের মুঠি ধরে বের করে দেওয়া হয় মীনাকে। হিঁচড়ে টেনে নিয়ে যাওয়া হয় রাস্তা দিয়ে। ধাক্কা মেরে ডুবিয়ে দেওয়া হয় কুয়োর জলে। তবু মীনা হাল ছাড়েন না। যোগাযোগ করেন আপনে আপ এনজিও-র রুচিরা গুপ্তার সঙ্গে। তারপর নতুন করে যুদ্ধ শুরু করেন। নয়নার মুক্তির জন্য...
যদিও মীনার ইতিকথা যে কোনও মানুষকে স্পর্শ করবে, তবু সুদূর হলিউডের এক অভিনেত্রীর তা নিয়ে ছবি তৈরি করার সঙ্কল্পটা রূপকথার গল্পের মতো শোনায়। কুইন্টেন ট্যারান্টিনোর ‘কিল বিল’-এর মতো ছবি করেছেন লুসি। ‘অ্যালি ম্যাকবিল’-এর মতো টিভি সিরিজে দেখা গিয়েছে তাঁকে। গ্ল্যামারাস অ্যাকশন-ফ্রিক অভিনেত্রী লুসি। হলিউড ট্যাবলয়েডের নয়নের মণি। হঠাৎ মীনার কাহিনি নিয়ে ছবি তৈরি করতে তিনিই এতটা উৎসাহিত হয়েছিলেন কেন?
এর উত্তরে তন্নিষ্ঠা বলেন, “লুসি বলেছিল যে ও মনে করে প্রত্যেক সেলিব্রিটির উচিত একটা ‘কজ’য়ের জন্য কিছু করা। লুসি হলিউডে মূলধারার ছবি করে। তবে শিশুদের উপর যৌন নির্যাতনের বিষয়টা ওকে খুব নাড়া দেয়। আর সেই জন্যই ও এই ধরনের একটা শর্ট ফিল্ম পরিচালনা করার কথা ভাবে। ওর সঙ্গে কাজ করে বুঝেছি বিষয়টা নিয়ে ও যথেষ্ট সিরিয়াস।”
‘এলিমেন্ট্রি’তে লুসির সঙ্গে জনি লি মিলার
জয়সলমেরে নওয়াজউদ্দিন সিদ্দিকির সঙ্গে ‘দেখ ইন্ডিয়ান সার্কাস’-এর শ্যুটিং করছিলেন তন্নিষ্ঠা যখন এই ছবিতে অভিনয় করার অফার পান তিনি। তিন দিনের কাজ ছিল মুম্বইতে। ছবিটি দেখে অবশ্য কিছু দর্শকের মনে এ প্রশ্ন আসাটা অস্বাভাবিক নয় যে ছবিটির মাধ্যমে আবার শিরোনামে আসবে তৃতীয় বিশ্বে বাচ্চাদের যৌন হয়রানির প্রসঙ্গ। “জানেন, নিউ ইয়র্কে স্ক্রিনিংয়ের পর এক দর্শক তৃতীয় বিশ্বে বাচ্চাদের যৌন হয়রানি নিয়ে উল্লেখ করতে গেলে লুসি তাঁকে থামিয়ে বলেছিলেন যৌন হয়রানি ব্যাপারটা শুধুমাত্র ভারতের সমস্যা নয়। হ্যাঁ, ছবিটির শ্যুটিং হয়েছে ভারতে। তবে এই সমস্যা নিউ ইয়র্কেও রয়েছে। বিশ্বের অন্যান্য শহরেও ওই একই ধরনের হয়রানির নানা কাহিনি শোনা যায়,” বলেন তন্নিষ্ঠা। লুসির সঙ্গে কথা বলে তন্নিষ্ঠার মনে হয়নি যে হলিউড অভিনেত্রী এই ছবিটি পরিচালনা করতে গিয়ে ভারতের কিছু ক্লিশেড ইমেজকে পর্দায় পুনঃপ্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করেছেন। “ছবিটা এমন ভাবে শ্যুটিং করা হয়েছে যে সেখানে কোনও বাচ্চার যৌন হয়রানির ডিরেক্ট শট দেখানো হয়নি। সিনেমাটোগ্রাফি একদম কবিতার মতো,” বলছেন তিনি।
নিউ ইয়র্কে প্রদর্শন শেষে লুসি আবার ফিরে গিয়েছেন ‘এলিমেন্ট্রি’র শ্যুটিংয়ে। অক্টোবর মাসে টিভির পর্দায় দেখা যাবে এই সিরিজ। এ বার সিরিজে রয়েছে অন্য এক চমক। অন্যান্য শার্লক হোমস সিরিজ থেকে ‘এলিমেন্ট্রি’র প্রাথমিক তফাত হল সেখানে ডা. ওয়াটসনের চরিত্রে অভিনয় করেছেন এক মহিলা (লুসি)। এই সিজনে প্রথম দেখা যাবে তাঁর বয়ফ্রেন্ডকে। যে চরিত্রে অভিনয় করছেন ইংলিশ অভিনেতা রাজা জাফ্রি (যাঁর বাবা আগ্রা নিবাসী এক ‘সি-ক্যাপ্টেন’)। সিজনের আরেক চমক হল অ্যাকশন দৃশ্য। ইন্টারনেট জুড়ে লুসির সেই অ্যাকশন সিকোয়েন্সের ছবি। হাতে কালো রঙের কোলাপসিবল ব্যাটন। আত্মরক্ষার প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন নিউ ইয়র্কের রাস্তায়। পরিচালক লুসি-ও অ্যাকশন সিকোয়েন্স তাঁর অভিনেতাদের নিরাপত্তা নিয়ে খুব সতর্ক। ‘মীনা’তেও একটা ছোট অ্যাকশন দৃশ্য ছিল। সেখানে লুসির কড়া নির্দেশ ছিল অভিনেতাদের নি-প্যাড পরতে হবে। শরীরে সমস্ত প্রোটেকশন নিতে হবে। “ওর কথা হল ছোট্ট একটা অ্যাকশন দৃশ্যেও একজন অভিনেতার এমন চোট লাগতে পারে যা সারা জীবন তাঁকে ভোগাতে পারে। হলিউড ছবি না শর্ট ফিল্ম, সেটা বড় কথা নয়। অ্যাকশন দৃশ্যের দৈর্ঘ্যটাও বিচার্য নয়। লুসির টিপস হল মারামারি করতে গেলে প্রোটেকশন নিতেই হবে,” বলছেন তন্নিষ্ঠা।
ভারতে এসে শর্ট ফিল্ম পরিচালনা এক জিনিস। আর বিলাসবহুল টিভি সিরিজে কাজ করা একদম আলাদা একটা ব্যাপার। তবুও কোথাও যেন মহিলা হিসেবে কাজ করার মধ্যে একটা মিল রয়েছে। “বলিউড যে পুরুষশাসিত, তা নিয়ে আলোচনা করছিলাম। তখন লুসি বলে যে হলিউডেও একই ব্যাপার। তাই বিশ্বজুড়ে আজও মহিলা পরিচালকদের সংখ্যা অনেক কম। মহিলা পরিচালক হয়ে নিজেকে প্রমাণ করতে গেলে দুগুণ খাটনি খাটতে হয়। ‘এলিমেন্ট্রি’তে ও অভিনয়ের সঙ্গে আবার পরিচালনাও করছে। সেটা আরও পরিশ্রমের ব্যাপার,” জানান তন্নিষ্ঠা।
অভিনয়, পরিচালনা, পেশাদারিত্ব নিয়ে কথা বলার ফাঁকে ব্যক্তিগত জীবন নিয়েও কথা হয়। পাপারাজ্জি-প্রিয় হলিউড লুসির জীবন নিয়ে নানা সময় নানা রসালো খবর প্রকাশ করেছে। কখনও হলিউড তারকা জর্জ ক্লুনির নাম উঠে এসেছে লুসি প্রসঙ্গে। কখনও ইউক্রেনিয়ান হেভিওয়েট বক্সার ভ্লাদিমির কিতস্কোর সঙ্গে নাম জড়িয়েছে তাঁর। তবু লুসি নিজমুখে তাঁর প্রেমচর্চা করতে নারাজ। আড্ডাশেষে নিউ ইয়র্কের জিও কাফেতে বসে হঠাৎই না কি তিনি তন্নিষ্ঠাকে বলেন ‘নেভার পুট ইয়োর লাইফ অ্যাজ আ ওম্যান অন হোল্ড বিকজ অব ইয়োর কেরিয়ার’। অর্থাৎ পেশার কারণে কখনও নারী হিসেবে বাঁচতে ভুলে যেয়ো না। লুসির মুখে এই কথাগুলো শুনতে বেশ লেগেছিল তন্নিষ্ঠার। বলছেন, “লুসির মতে এই ভুলটা অনেক পেশাদার মহিলা করে থাকেন। পেশা পেশার জায়গায় থাকবে। তাই বলে ব্যক্তিগত জীবনটাকে এনজয় করতে অনেকেই ভুলে যায়। ও বলছিল দরকার হলে কেরিয়ারিস্ট মহিলারা নিজেদের ডিম্বাণু ফ্রিজ করেও রেখে দিতে পারেন। কিন্তু মাতৃত্বের স্বাদ থেকে যেন নিজেদের বঞ্চিত না করেন। কেরিয়ারের পিছনে ছুটতে গিয়ে সংসার, মাতৃত্বের আনন্দটা বিসর্জন নয়। দু’টোকে একসঙ্গে ব্যালান্স করেও চলা সম্ভব।”
হলিউডের ট্যাবলয়েডে লুসিকে নিয়ে জল্পনার শেষ নেই। লুকিয়ে বিয়ে করছেন কি না, অন্তঃসত্ত্বা কি না ইন্টারনেটে এ নিয়ে অনেক প্রতিবেদন ছড়িয়েছিটিয়ে পাওয়া যায়। কে জানে, ৪৫ বছর বয়সে দাঁড়িয়ে চার্লির এঞ্জেলের মুখে এমন উপদেশ শুনে তাঁরাও আশ্চর্য হবেন কি না!