রাজকন্যার ভূমিকায় রুকমা রায়।
উত্তাল ঢেউয়ে ঢেউয়ে ফুঁসে ওঠা ভয়ঙ্কর সমুদ্র। তার মধ্যে থেকে জেগে উঠেছে কুচকুচে কালো দানবের মতো এক পাহাড়। ঘন অন্ধকার পাহাড়ের ওপর দাঁড়িয়ে মায়াবিনী রাক্ষসী। সমুদ্রের জলে সে ছুড়ে ফেলে দিতে যায় নবজাত এক শিশুকে...
রাজসভায় ফোয়ারা দিয়ে বেরোতে আরম্ভ করল কিলবিলে সব কাঁকড়া বিছে..... আর কাঁকড়া বিছে বেরিয়ে আসা মানেই রাক্ষসদের হুমকি।
অচিনপুরের রাজা বিজয়রাজের রক্ষাকবচের নাম বজ্রমানিক। যেমন তার রূপ। তেমন তার বাহার। সেই রক্ষাকবচের এমনই জোর যে প্যাকাটি আর কটকটি নামে দুই রাক্ষসী রাজার ক্ষতি করতে চেয়েও ক্ষতি করতে পারল না। বজ্রমানিকের রোষে তারা দমকা তুফানে উড়ে বেরিয়ে গেল।
এই রকমই সব অভাবনীয় ঘটনা চোখের সামনে যেন জাদুমন্ত্রে জীবন্ত হয়ে উঠবে আর মাত্র কয়েক দিন বাদে। বাঙালির বড় আদরের সাহিত্য দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদারের লেখা ‘ঠাকুরমার ঝুলি’ এ বার টিভির পর্দায়। ‘অরুণ বরুণ কিরণমালা’র গল্প অবলম্বনে বিশাল খরচসাপেক্ষ ‘কিরণমালা’ সিরিয়াল দেখা যাবে স্টার জলসায় ‘মা’ সিরিয়ালের জায়গায়। রাত আটটায়। এটাই আজ অবধি বাংলা টেলিভিশনের ‘কস্টলিয়েস্ট’ প্রোগ্রাম।
যেখানে পারিবারিক ধারাবাহিক দিয়েই আকাশ ছোঁয়া টিআরপি তোলা যায়, সেখানে কেন হঠাৎ এই পট পরিবর্তন? কেনই বা রূপকথা? প্রযোজক সংস্থা সুরিন্দর ফিল্মসের অন্যতম কর্ণধার নিসপাল সিংহ রানে বললেন, “এই প্রথম বাংলা ভাষায় এই রকম একটা কাজ হচ্ছে। প্রতিটা এপিসোডের খরচ সাধারণ আর পাঁচটা সিরিয়ালের প্রতি এপিসোডের তুলনায় তিন চারগুণ বেশি। কখনও বা তারও বেশি। তবু এই কাজের সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করতে পেরে ভাল লাগছে কারণ ঘরোয়া সিরিয়ালের বাইরেও একটা অন্য গোত্রের সিরিয়াল দর্শক দেখতে পাবে। বাংলা সিরিয়াল বলতে যা হয় তা বাচ্চাদের দেখার উপযুক্ত নয়। বড়দের বিনোদনেও চাই নতুনত্ব। ছোটরা টিভিতে হয় হ্যারি পটারের মতো ছবি দেখে কিংবা কার্টুন নেটওয়ার্ক দেখে। এই ট্রেন্ড বদলানো দরকার। সেই সঙ্গে ‘ঠাকুরমার ঝুলি’ দেখে প্রাপ্তবয়স্কেরাও ফিরে যাবেন তাঁদের শৈশবে।”
ঠিক তাই। ঠাকুরমার ঝুলি মানেই তো নস্টালজিয়া। রাজপুত্র-রাজকন্যা, ব্যাঙ্গমা-ব্যাঙ্গমী, সোনার গাছে হিরের ফুল, মণিমুক্তোখচিত রাজপ্রাসাদ, সোনার কাঠি-রুপোর কাঠি, লালপরি আর নীলপরি, তেপান্তরের মাঠের দিকে আবার যেন ফিরে যাওয়া।
কটকটি ও প্যাকাটি: দুই রাক্ষসীর ভূমিকায় চান্দ্রেয়ী ঘোষ ও চৈতালী চক্রবর্তী।
কিন্তু চোখ যেখানে হলিউডি গুণমানের উচ্চ প্রযুক্তিসম্পন্ন কম্পিউটার গ্রাফিকস দেখতে অভ্যস্ত সেখানে কী ভাবে মন কাড়বে বাংলা সিরিয়ালের মেঠো ফেয়ারি টেল? বা ফ্যান্টাসি? নিছক কাঁচা কাজ হয়ে যাবে না তো? নিসপাল বললেন “না সেটা যাতে না হয় সেই জন্যই বাইশ জন টেকনিশিয়ান আর্টিস্ট নিয়ে কাজ করছে স্পেশাল ভিএফএক্স কম্পিউটার গ্র্যাফিক্স টিম’। মাল্টিমিডিয়া অ্যানিমেশনের নিখুঁত ইনোভেশনে আমরা তৈরি করছি রূপকথার জগৎ।”
আর এই রূপকথার জগৎকে চমকপ্রদ করে তুলতে, প্রাঞ্জল করে তুলতে—শিল্প নির্দেশক তন্ময় চক্রবর্তী পার্পল মুভিটাউনে একশো ফুট বাই নব্বই ফুট ফ্লোরকে ছ’টি আলাদা সেটে ভাগ করে বিশাল খরচসাপেক্ষ এক পটভূমি তৈরি করেছেন। বললেন, “এর আগে ধর্মীয় কাহিনি নিয়ে কাজ করেছি। কিন্তু রূপকথা নিয়ে কাজ করতে গিয়ে অনেক রকম এক্সপেরিমেন্ট করার সুযোগ পাচ্ছি। যেটা আগে হয়নি। একটা স্টুডিয়োতেই বানিয়েছি একই সঙ্গে রাজসভা, গ্রাম, বিজয়রাজের রাজ্যপাট, পাতালঘর, রাজসভার করিডর, গুপ্ত কুঠি আর এই রকম আরও কত কী! তার পর মজা হল সেটের ভেতর থেকে বাইরের যে প্রকৃতি দেখা যাচ্ছে সেটা তৈরি হচ্ছে অ্যানিমেশনে। সেখানে বাগানের গাছে গাছে ফলে আছে হিরে-মুক্তো-চুনী-পান্না। বাজার থেকে কোনও জিনিসই কিনে এনে ব্যবহার করা হয়নি। রাজবাড়ির থামে থামে অজন্তা ইলোরার কাজের অনুকরণ করেছি। এমনকী বিছানার চাদর, বাসনপত্র, আসবাব সবটাই নিজেদের কল্পনা মতো গড়ে নেওয়া। পাতালঘরে রেখেছি আদিবাসী নকশার ছোঁয়া।”
রূপকথা যে মাটিতেই জন্ম নিক তা আসলে যে আন্তর্জাতিক, কোনও ভৌগলিক মাত্রায় তাকে বাঁধা যায় না এমনটা মনে করছেন টলিউডের বৃহত্তম বাজেটের ‘কিরণমালা’ সিরিয়ালের সঙ্গীত পরিচালক ইন্দ্রদীপ দাশগুপ্ত। তাই তিনি রূপকথার রাজদরবারে যেমন ব্যবহার করেছেন ভারতীয় মার্গ সঙ্গীত, তেমনি রাজবন্দনার গানে ব্যবহার করেছেন মার্চ সং, আবার রাক্ষস-রাক্ষসীর গানে সুর দিয়েছেন সাম্বা-র। এই ভাবেই নানা উপকরণে সেজে, বর্ণে-গন্ধে-ছন্দে-গীতিতে তৈরি হচ্ছে কিরণমালার সুবৃহৎ দৃশ্যকাহিনি। যে কাহিনির শুরু ১৯০৭ সালে।
১৯০৭ সালে প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল ‘ঠাকুরমার ঝুলি’। এতটাই জনপ্রিয় হয়েছিল সেই সঙ্কলন যে দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছিল ১৯০৯ সালে। স্বদেশি আন্দোলনের যুগে ভারতীয় লোককথাকে খুঁজে বের করাও সেই সময় হয়ে উঠেছিল বিপ্লবেরই অঙ্গ। দেশের মাটির গল্প, দেশের মাটির লোকগান, ব্রতকথা নিয়ে কাজ শুরু করেছিলেন দক্ষিণাচরণ ময়মনসিংহে বসে। তাঁর বইয়ের ভূমিকায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছিলেন, “এই যে আমাদের দেশের রূপকথা বহুযুগের বাঙ্গালী বালকের চিত্তক্ষেত্রের উপর দিয়া অশ্রান্ত বহিয়া কত বিপ্লব কত রাজ্য পরিবর্তনের মাঝখান দিয়া অক্ষুণ্ণ চলিয়া আসিয়াছে, ইহার উৎস সমস্ত বাংলা দেশের মাতৃস্নেহের মধ্যে। ....দক্ষিণারঞ্জনবাবুকে ধন্য। তিনি ঠাকুরমার মুখের কথাকে ছাপার অক্ষরে তুলিয়া নিয়া পুঁতিয়াছেন তবু তাহার পাতাগুলি প্রায় তেমনই তাজাই রহিয়াছে।”
যদি রূপকথার পৃষ্ঠা উল্টে দেখা যায়, দেখবেন অরুণ-বরুণ-কিরণমালার গল্প আসলে কিরণমালারই গল্প। জীবন জয়ের গল্প। যুদ্ধ জয়ের গল্প। ভালবাসা জয়ের গল্প। আর অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবার গল্প। বিংশ শতকের প্রথম ভাগে যখন দেশই মুক্ত নয়, নারী মুক্তি যখন স্বপ্নমাত্র তখন দক্ষিণারঞ্জন লিখছেন বীরাঙ্গনা কিরণমালার গপ্পো। কেমন করে সে মৃত ভাইদের বাঁচিয়ে তুলল, কেমন করে সে তার দুয়োরানি মায়ের সঙ্গে রাজা বিজয়রাজের মিল করিয়ে দিল, কেমন করে দত্যি-দানো ভরা পৃথিবীর মাঝখানে দাঁড়িয়ে দানবদলনী হল—সেই কাহিনিই হল বাংলা রূপকথায় প্রথম নারীমুক্তি আন্দোলনের সারাৎসার। এমনটাই মনে করছেন স্টার জলসা চ্যানেলের মুখপাত্র মধুজা বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি বললেন, “আমাদের ‘মা’ সিরিয়াল যেমন এক মেয়ের সঙ্গে মায়ের মিলনের যুদ্ধযাত্রা থেকে জয়যাত্রা, তেমনি কিরণমালাও এক মেয়ের জীবনেরই লড়াইয়ের গল্প হয়ে উঠবে। এই লড়াইয়ের গল্প তৈরি করার জন্য গবেষণার কাজ শুরু করেছিলেন পরিচালক দেবাংশু সেনগুপ্ত। কিন্তু কাজ শেষ করার আগেই তিনি মারা যান।
রাক্ষসীদের নাম প্যাকাটি আর কটকটি তাঁরই দেওয়া।”
কিরণমালার ভূমিকায় অভিনয় করছেন রুকমা রায়। ইতিপূর্বে মঙ্গলকাব্যভিত্তিক সিরিয়াল ‘বেহুলা’য় মনসার ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন চান্দ্রেয়ী ঘোষ। এবার তিনি ‘কিরণমালা’ সিরিয়ালের রাক্ষসরানি। বললেন, “আমিও দারুণ উপভোগ করছি কাজটা। এর আগে মনসা করেছি। কিন্তু তিনি তো দেবী। আর এখানে রাক্ষসরানি কটকটি হল নেগেটিভ চরিত্র। গুড ভার্সেস ব্যাডের মধ্যে আমি রয়েছি খলনায়িকা হয়ে। সেটাই চ্যালেঞ্জ। এর আগে খলনায়িকা করিনি। মনসার ক্রোধ ছিল। কিন্তু দিনের শেষে তিনি একজন বঞ্চিতা নারী। যতক্ষণ না টিভিতে দর্শক দেখে অ্যাপ্রিশিয়েট করছেন ততক্ষণ একটা টেনশন থাকছে কটকটিকে নিয়ে। কিন্তু খুব যত্ন করে কাজটা করার চেষ্টা করছি। চরিত্রটার অনেক স্তর আছে তো!” ‘কিরণমালা’র পরিচালনা করার দায়িত্বে রয়েছেন শ্রীজিৎ রায়। এর আগে তিনি ‘বেহুলা’ সিরিয়ালটিও পরিচালনা করেন।
কিন্তু প্রশ্ন হল, মাত্র কয়েক পৃষ্ঠায় বাঁধা রূপকথাকে কী ভাবে বারোমাসের তিনশো এপিসোডে রূপান্তরিত করা সম্ভব? এই সিরিয়ালের ক্রিয়েটিভ ডিরেক্টর অভিজিৎ দাশগুপ্ত বললেন, “দক্ষিণারঞ্জনবাবুর কাহিনির সঙ্গে দেশ কালের সীমানা ভেঙে আরও নানা কাহিনির ছায়া ঢুকে পড়েছে গল্পে। এর জন্যে আমাদের ভাবনাকে সব সময়ই উজ্জীবিত রাখতে হচ্ছে। তেপান্তরের মাঠ, ব্যাঙ্গমা ব্যাঙ্গমীর কল্পনাকে কী করে বিশ্বাসযোগ্য করা যায়, কী ভাবে তার একটা ম্যাজিক তৈরি হয়, তার জন্য নিরলস নতুন নতুন ভাবনা রূপায়িত করছে কম্পিউটার গ্রাফিক্স টিম।”
এবং শুধু কলকাতা নয়, মুম্বই এবং হায়দরাবাদেও চলছে কিরণমালা সিরিয়ালের কম্পিউটার গ্র্যাফিক্সের কাজ।
এ বার দেখার, যে-পৃথিবীতে শাশুড়ি বৌয়ের মোনোপলি সেই পৃথিবীতে ১৯০৭ সালের একটি গল্প কতটা ছাপ ফেলতে পারবে।পারবে কি রূপকথা বাংলা সিরিয়ালের মোড় ঘোরাতে?
জানতে বাকি তো আর কুড়ি দিন।