জিতের সুরে মহেশ ভট্ট

তা হলে কি সব্বাইকে দিয়ে গান গাওয়ানো যায়? মুম্বই থেকে জিৎ গঙ্গোপাধ্যায়। শুনলেন প্রিয়াঙ্কা দাশগুপ্ত।একটা সময় বছরে পাঁচটা থেকে ছ’টা বাংলা ছবিতে সুর দিতেন জিৎ গঙ্গোপাধ্যায়। এখন সেই সংখ্যা কমে দাঁড়িয়েছে একটা থেকে দুটোতে। কিন্তু বেড়েছে বলিউডের কাজ। তার সঙ্গে বেড়েছে হিটের সংখ্যা এবং পুরস্কারও। তাঁর সুর করা ‘খামোশিয়া’ গানটা এখন সর্বভারতীয় মিউজিক চার্টে পয়লা নম্বরে। ইতিমধ্যে আবার মহেশ ভট্টকে দিয়ে গান গাইয়ে ফেলেছেন ‘মিস্টার এক্স’‌‌-এর জন্য।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৮ জানুয়ারি ২০১৫ ০১:০০
Share:

একটা সময় বছরে পাঁচটা থেকে ছ’টা বাংলা ছবিতে সুর দিতেন জিৎ গঙ্গোপাধ্যায়। এখন সেই সংখ্যা কমে দাঁড়িয়েছে একটা থেকে দুটোতে। কিন্তু বেড়েছে বলিউডের কাজ। তার সঙ্গে বেড়েছে হিটের সংখ্যা এবং পুরস্কারও। তাঁর সুর করা ‘খামোশিয়া’ গানটা এখন সর্বভারতীয় মিউজিক চার্টে পয়লা নম্বরে। ইতিমধ্যে আবার মহেশ ভট্টকে দিয়ে গান গাইয়ে ফেলেছেন ‘মিস্টার এক্স’‌‌-এর জন্য।

Advertisement

বলিউডে হঠাৎ জিতের এই জনপ্রিয়তার কারণ কী?

এত সুরকার কাজ করেছেন মহেশ ভট্টের সিনেমায়। তা তিনি প্রীতম হোন, কী মিঠুন। কিন্তু এর আগে তো কারও সুরে গান গাননি মহেশ ভট্ট। কী জাদু করে জিৎ গান রেকর্ড করাতে রাজি করালেন মহেশ ভট্টকে? ‘‘আসলে ভট্ট সাহেবের সঙ্গে যখন সিটিং করি আমি গান গেয়ে শোনাই। আর তার পর দেখেছি উনি নিজেই সেই গানটা গেয়ে ওঠেন। দরাজ গলা। কিছু মেহেদি হাসানের গজল তো দারুণ গান উনি। অনেক বার জিজ্ঞাসা করেছিলাম কেন প্লেব্যাক করেননি? বলেছিলেন ‘আমি সব কিছুই করি কিন্তু আবার করিও না’। শুনেছিলাম কন্যা পূজা ভট্টও তাঁকে প্লেব্যাক করার অনুরোধ করেছিলেন। কিন্তু ভট্ট সাব রাজি হননি,’’ বলেন জিৎ।

Advertisement

রাজি হয়েছিলেন ‘খামোশিয়া’ গানটা সুপার হিট হওয়ার পর। কী ভাবে, সেটা অবশ্য অন্য গল্প। বিক্রম ভট্ট পরিচালিত ‘মিস্টার এক্স’-এর জন্য একটা গান অরিজিৎ সিংহকে দিয়ে রেকর্ড করে ফেলেছিলেন জিৎ। থিম গানটা জিৎ সুর করেছিলেন খানিকটা ‘জ্যাজ আর ব্লুজ’ মাথায় রেখে। কিন্তু মহেশ ভট্ট সেটা রেকর্ড করতে নারাজ। ‘‘প্রথমে বললেন ‘মিস্টার এক্স’-এর নায়ক ইমরান হাসমিকে দিয়ে গাওয়াতে। সিটিং হল। ইমরান ভাল গায়। কিন্তু ভট্ট সাবের েয জলদগম্ভীর গলাটা আমার দরকার ছিল, সেটা আমি পাচ্ছিলাম না,’’ বলেন জিৎ। প্রযোজক মুকেশ ভট্টকে বলেন গানটা একমাত্র ভট্টসাবকে দিয়েই গাওয়াবেন। রেকর্ডিংয়ের সময় মনে হল একদম গভীরে গিয়ে অনুভব করেই গাইছেন তিনি। মহিলাকণ্ঠ হিসেবে নিলেন মিলি নায়ারকে। এ আর রহমানও সঙ্গে কাজ করেছেন মিলি। উপরি পাওনা হল ‘ইউ ক্যান কল মি এক্স’ গানের শেষে কিছু ডায়লগ মহেশ ভট্টকে দিয়ে নিজের গলায় রেকর্ড করানো।

কিছু দিন আগে হেমা মালিনী গান রেকর্ড করলেন কলকাতায় এসে। এখন মহেশ ভট্ট। অমিতাভ বচ্চন না হয় অনেক কাল ধরেই প্লে ব্যাক করে আসছেন। কিন্তু হঠাৎ এই ষাটোর্ধ্ব সেলিব্রিটিদের গায়ক হওয়ার পেছনে অনুপ্রেরণা কী বলে মনে হয়? এ সব কি চমক নাকি অন্য কিছু? ‘‘হেমাজির ক্ষেত্রে কী হয়েছে আমি জানি না। বাবুলের সঙ্গে গাইছেন। হেমাজি ভাল নাচেন। ওঁর সঙ্গীতবোধটাও দারুণ। ভট্ট সাহেবের ক্ষেত্রে বলতে পারি উনি ভাল গান। প্লেব্যাক আগে করেননি সেটা অন্য প্রসঙ্গ। সর্বোপরি ফিল্মের স্বার্থে আমি ওঁকে দিয়ে গাইয়েছি,’’ স্পষ্ট জবাব দেন সুরকার।

আচ্ছা, এই যে সারাক্ষণ শোনা যায় আজকাল সফ্টওয়্যারের যুগে যে কেউ যে কোনও গান গেয়ে দিতে পারেন? পাড়ার মুদিখানা দোকানের হরি কিংবা সব্জিওয়ালি চম্পাও নাকি গান না জেনেও বলিউডে প্লেব্যাক করে দিতে পারেন? ‘‘দেখুন, ‘পরাণ যায় জ্বলিয়া রে’ আমি নিজে গেয়েছিলাম কারণ আমি ওটা সব থেকে ভাল গাইতে পারব। এখন কম্পোজার বা সিঙ্গারের মধ্যে আলাদা করে তফাত করা শক্ত। সব্বাই সব কিছু করে।’’

তার মানে কি বলছেন সব্বাই ভাল গাইতে পারে? ‘‘না, তা বলছি না। সোনু আর শ্রেয়ার কথায় আসি। যতই যাই হোক ওরা এই রকমই গাইবে। আমার মনে হয় না যে কেউ এসে বলিউডে প্লেব্যাক করতে পারে। রিয়েলিটি শো থেকে যারা চান্স পাচ্ছে তারা কিন্তু সবাই ভাল গায়। শুধুমাত্র হতাশা থেকে যদি অভিযোগ ওঠে, আজকাল যে কেউ এসে গেয়ে দিতে পারবে সেটা ঠিক হবে না,” জোর দিয়ে বলেন জিৎ।

তাঁর কথা অনুযায়ী সবাই এক সময় নতুন ছিলেন। “তারা নিজেরা যখন চান্স পেয়েছে, তখন বলতে শোনা যায়নি যে ‘যে কেউ এসে প্লেব্যাক করছে’। তাদের ক্ষেত্রে যুক্তি ছিল তারা ভাল গেয়েছে। তাই সুযোগ পেয়েছে। তাদের সাফল্যকে যেমন ছোট করা ঠিক নয়, সে ভাবেই আজকের যারা গাইছে তাদেরও স্বীকৃতি প্রাপ্য,’’ টানা বলে চলেন জিৎ।

একটু থেমে আবার বলেন কাউকে তাচ্ছিল্য করে কোনও দিন টিকে থাকা যায় না। ‘‘যাদের গান আজকে মার্কেটে হিট হচ্ছে, তাদের ভেতরে নিশ্চয়ই কিছু ভাল আছে। না হলে সেটা হিট হত না। দুঃখের বিষয় হল লোকে নিজের উত্থানটা মনে রাখে না। এক সময় তারাও এই ‘সব্বাই’য়ের মধ্যেই পড়ত। আমার তো মনে হয় এই ধরনের একটা প্রশ্নের উত্তর দেওয়া মানে কিছু মানুষের হতাশাকে আমল দেওয়া। নেগেটিভিটি বাড়ালে বাড়ে। তার থেকে কাজে মন দেওয়া ভাল,’’ বলেন জিৎ।

বলিউডে পর পর অরিজিৎ সিংহকে দিয়েই গান গাওয়াচ্ছেন জিৎ। ‘সিটিলাইটস’ ছবিতে ‘মুস্কুরানে’, ‘সোনে দো’ থেকে ‘খামোশিয়া’ সবই তাঁর গাওয়া। বলিউডের বেশির ভাগ সুরকার যখন আজকাল অরিজিৎ-এর সঙ্গে কাজ করছেন, সেখানে অরিজিৎ-এর জন্য গান সুর করাটাও কি বেশি কঠিন হয়ে যাচ্ছে না? ‘‘আমি প্রথমে গানের মুখরা বানাই। তার পর গায়কের কথা ভাবি। আমার মনে হয় সব্বাই ভাল গান করার চেষ্টা করছে। অরিজিতকে নিয়ে বলিউডের সুরকাররা প্রতিযোগিতা করছেন, সেটাও নয়। এটা সুরকারদের মনের ইচ্ছে যে ওর সেরাটা যেন তাঁরা বের করে আনতে পারেন।’’

এ দিকে অরিজিৎ-এর ‘খামোশিয়া’ হিট হলেও একটা প্রশ্ন আবার উঠেছে। অত হাই পিচে নিস্তব্ধতার মতো লিরিক ব্যবহার করাটা কিছু শ্রোতার কানে একটু বেমানান ঠেকেছে। এর উত্তরে জিৎ বলেন, ‘‘অনেকে পুজো করার সময় জোরে জোরে মন্ত্র বলেন। অনেকে কিছুই বলেন না। এক সময় ছবিতে ভায়োলেন্স দেখাতে গেলে খুব চিৎকার চেঁচামেচি দেখানো হত। এখন দেখি খুব হিংসার দৃশ্য। কিন্তু কোনও শব্দ নেই। অভিব্যক্তিটা ব্যক্তিগত।’’

বলিউডে একটা সময় ‘কে কে ফেজ’ ছিল। তার পর এল ‘মোহিত চৌহ্বন ফেজ’। তার পর হিমেশ রেশমিয়া। এখন অরিজিৎ সিংহের মাতামাতি। আজকের দিনে বলিউডের একজন গায়কের ‘সেল্ফ লাইফ’ বলে কিছু থাকতে পারে কি? প্রশ্নটা শুনে জিৎ ভেবে নিয়ে বলেন, ‘‘সবার টাইম থাকে। অনেক বেশি গান গাইলে ‘সেল্ফ লাইফ’ বলে একটা ব্যাপার এসে যাবেই। কিন্তু সেটা কত বছর তা নির্ভর করবে গায়কের তালিমের ওপর। ফ্রেশ ভয়েসের চাহিদা থাকবে। নতুন সুরকার, গীতিকার আসবেই। মনোপলি কোথাও বেশি দিন থাকে না। আমি যত ভাল সুর করি না কেন তাও জানি নতুন সুরকার আসবেই। তাদের নামে বদনাম করলে আমার ইনসিকিওরিটি প্রকাশ পাবে। প্রমাণ হবে যে আমি নেগেটিভিটির মধ্যে জড়িয়ে পড়েছি। সেখান থেকে ভাল কাজ কী করে হবে?’’

এ দিকে বলিউডের বাণিজ্যিক ছবিতে জিৎ মেলোডিয়াস গানের সুরকার হিসেবেই পরিচিতি পাচ্ছেন। কিন্তু টলিউডে জিৎ-এর সুর মানে অনেকের কাছে প্রথমেই মনে আসে ডান্স নাম্বার। এই বৈষম্যটা কি স্বেচ্ছায় তৈরি নাকি তৈরি করে দেওয়া হয়েছে? প্রশ্ন শুনে খানিকটা হেসে জিৎ বলেন, ‘‘এটা তৈরি করে দেওয়া হয়েছে। ‘সিটিলাইটস্’-এ ‘শোনে দো’ টা শুনুন বা ‘এক চিরাইয়া’ সব মেলোডিভিত্তিক গান। এটা দুঃখের ব্যাপার যে বাংলাতে আমাকে এই ধরনের মেলোডিয়াস গানের জন্য ব্যবহারই করা হয়নি। এক সময় কিছু গান করেছিলাম। যেমন ‘সাজনা’ বা ‘ভোলা যায় না’। শ্রোতাদের সেগুলো ভাল লেগেছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্য যে ওগুলোর পরেও সেই ধরনের কাজ আমায় দেওয়া হয়নি বা আমার কাছে আসেনি।’’

মেনে নিচ্ছেন যে টলিউডে শ্রোতাদের মনে তাঁর একটা ইমেজ জোর করে তৈরি করে দেওয়া হয়েছে। ‘‘ভাগ্য ভাল বলিউড আমাকে টাইপকাস্ট করেনি। বাংলায় যে ‘মিডল অব দ্য পাথ’ ছবি হচ্ছে, সেগুলো যাঁরা করছেন তাঁদের মনে কোথাও ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে যে জিৎ মানেই শুধু মস্তির গান। ‘মিডল অব দ্য পাথ’ ছবিতে সুর করার সুযোগ কোথায় এল? ঈশ্বরের আশীর্বাদ যে আমার সুর করা মেলোডিয়াস সব গানই তো বলিউডে হিট হয়েছে। এখন যদি টলিউড অন্য ভাবে দেখে। আমিও মুম্বই থেকে দেখছি কী হয়,’’ বলে হেসে ফেললেন জিৎ।

একটা সময় তো ছিল যখন টলিউডে যে ভাবে রমরমিয়ে রিমেক চলত, সে ছবিগুলোর গানও নিমেষের মধ্যে সে ভাবেই হয়ে যেত সুপারহিট। ইদানীং কালের টলিউডে বাণিজ্যিক ছবির তেমন রমরমা অবস্থা আর নেই। এর একটা কারণ কি বাণিজ্যিক ছবির গান আগের মতো হিট না করা? ‘‘এটা প্রোডিউসাররা বলতে পারবেন। গত এক বছর টলিউডে দু’টো ছবিতে সুর করেছি। ‘বস’ আর ‘রংবাজ’। সেগুলো দারুণ হিট। তার পর ‘বচ্চন’ করলাম। ‘হিরোগিরি’তে ‘মন আমার তোর কিনারে’ গানটা শুনে বাসু ভাগনানি আর টি-সিরিজ থেকে অফার আছে ওটা হিন্দিতে করার জন্য। কাকে কী ভাবে সেটা দেব, জানি না। টলিউডে সুর করা কমিয়ে দিয়েছি। অন্য যাঁরা সুর করছেন, সেগুলো কেন হিট করছে না, তা আমি কী করে বলব বলুন তো?’’

তা এই পাঁচ-ছ’টা বাংলা ছবি থেকে কাজ কমিয়ে বলিউডমুখী হয়ে যাওয়াটা কি স্বেচ্ছায়? না কি তা করতে এক রকম বাধ্য হয়েছেন? ‘‘দুটোই বলা যায়,’’ জবাব দেন জিৎ।

মানে বলছেন কেউ বা কারা তাঁকে বাধ্য করেছেন মুম্বইমুখী হতে? “অনেক কিছুর মধ্যে দিয়ে গিয়েছি। শেষে নিজে একদম ‘স্টোয়িক’ হয়ে গিয়েছিলাম। ছোটবেলায় অনেক স্ট্রাগল করেছি। তাতে মনটা শক্ত হয়েছে। অনেক কিছুতেই আমি আর বিচলিত হই না। রিঅ্যাক্ট করি না। লোকে ভাবে আমি ভোলেভালা। কিন্তু বিশ্বাস করুন, আমি জানি সবার শেষে ভাল সুর করলে কেউ কাউকে আটকাতে পারে না।’’

টুইটার দিয়ে প্রচার, প্রযোজকদের সঙ্গে দহরম-মহরম— এ সব দরকার পড়ে না বলছেন? ‘‘ধুর, ধুর! লুচি, আলুরদম, রাবড়ি খাওয়াতে হয় না। শুধু ভাল সুর করতে হয়। আর তা করলে সেটা শ্রোতাদের কাছে পৌঁছবেই। বাধ্য হয়ে যদি অন্য ইন্ডাস্ট্রিতে কাজ করতে হয়, তাতে আমার ক্ষতি নেই। কারণ আমি জানি ভাল গান ভাষার বিভেদ পেরিয়ে আবার বাংলার শ্রোতার কাছেই ফিরে আসবে। ‘খামোশিয়া’ সেটা প্রমাণ করেছে।’’

কনুই দিয়ে সরিয়ে দেওয়া তো থাকবেই। কিন্তু এ সব মানুষদের ‘খামোশ’ করার উপায় হল কাজ।
এত দিনে তিনি বুঝেছেন ওখানেই আসল জিৎ।

আনাচে কানাচে

গঙ্গাবক্ষে সম্পূর্ণা: পরের ব্যোমকেশের প্রস্তুতি। ছবি: কৌশিক সরকার।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement