চুপিচুপি ভালবাসা

এটা শ্রেয়া ঘোষালের এক জনপ্রিয় গান। কে জানত এটা তাঁর জীবনেরও গান! লিখছেন প্রিয়াঙ্কা দাশগুপ্ত।সে দিন ছিল কি গোধূলি লগন শুভদৃষ্টির ক্ষণ...না, ছিল না। তখন ঘড়ির কাঁটা মধ্যরাতের দিকে ছুটছে। বিয়ের পিঁড়িতে বসে শ্রেয়া ঘোষাল। সামনে শিলাদিত্য মুখোপাধ্যায়। যাঁর সঙ্গে তাঁর দশ বছরের ‘চুপিচুপি ভালবাসা’।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ ০১:০০
Share:

সে দিন ছিল কি গোধূলি লগন শুভদৃষ্টির ক্ষণ...

Advertisement

না, ছিল না।

তখন ঘড়ির কাঁটা মধ্যরাতের দিকে ছুটছে। বিয়ের পিঁড়িতে বসে শ্রেয়া ঘোষাল। সামনে শিলাদিত্য মুখোপাধ্যায়। যাঁর সঙ্গে তাঁর দশ বছরের ‘চুপিচুপি ভালবাসা’। শ্রেয়ার মুখের লাজুক হাসি ঢেকে দিচ্ছে পিঁড়ি থেকে পড়ে যাওয়ার ভয়। তখন পিঁড়ি ধরে দাঁড়িয়ে সুরকার শান্তনু মৈত্র, জয় সরকার আর জিৎ গঙ্গোপাধ্যায়। এই একবার শ্রেয়ার পিঁড়ি শিলাদিত্যর থেকে উঁচুতে উঠিয়ে দেওয়া হয়, পরমুহূর্তে শিলাদিত্যর পিঁড়িটা এক ফুট উঁচু।

Advertisement

দেখতে দেখতে জিতের মনে পড়ে যায় প্রভাত রায়ের ছবি ‘শুভদৃষ্টি’র কথা। প্রায় এক দশক আগে যে ছবির গান শ্রেয়াকে দিয়ে রেকর্ড করিয়েছিলেন জিৎ। স্টুডিয়োতে এসে পরিচালক শ্রেয়ার সঙ্গে অনেকক্ষণ কথা বলেছিলেন। তখন শ্রেয়ার বয়স কতই বা হবে! বিয়ে-শুভদৃষ্টি আর কী ধরনের অনুভূতি গানের মধ্যে চেয়েছিলেন সে সব কিছু শ্রেয়াকে বুঝিয়েছিলেন পরিচালক। দরদ দিয়ে রেকর্ডিং করেছিলেন শ্রেয়া। ছবিতে কোয়েল পানপাতা সরিয়ে লাজুক-লাজুক ভাবে তাকাচ্ছেন জিৎ-এর দিকে। পিছনে ভেসে আসে শ্রেয়ার গলায় ‘তুমি আমার চিরসাথী’ গানটা।

কত বছর আগেকার কথা। দৃশ্যটা অনেকটা একই রকম। শুধু পাত্র-পাত্রী আলাদা। যে শ্রেয়া সে দিন গান গেয়েছিলেন তিনি পানপাতার আড়ালে ঢাকলেন নিজের মুখ। তারপর আস্তে আস্তে তা সরিয়ে ডাগর চোখে চেয়ে থাকলেন শিলাদিত্যর দিকে।

সিনেমা নয়। এটা ঘোর বাস্তব।

তারিখটা ৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৫।

তেরো বছর আগে যে মেয়েটি ফ্রক পরে ইন্ডাস্ট্রিতে গান করতে এসেছিলেন, আজ তাঁর বয়স ৩০। এক সময় অলকা ইয়াগনিকের একাধিকার স্বত্ব থাকা সত্ত্বেও শ্রেয়া নিজের জন্য একটা জায়গা করে নিয়েছেন বলিউডে। আর আস্তে আস্তে তিনি ভারতীয় ফিল্ম সঙ্গীতের দুনিয়ায় পাটরানি হয়ে গেলেন। সঙ্গে নিলেন সুনিধি চৌহানকে।

সঞ্জয় লীলা বনশালীর ‘দেবদাস’ দিয়ে ২০০২-এ ইনিংস শুরু করেছেন শ্রেয়া। আজও প্রত্যেকটা হিট ছবিতে তাঁর একটা গান থাকেই। তা সে ‘হ্যাপি নিউ ইয়ার’‌য়ে ‘মনওয়া লাগে’ হোক, কী ‘পিকে’র ‘চার কদম’। কবিতা কৃষ্ণমূর্তির মনে পড়ে যায় ‘দেবদাস’‌য়ের ‘ডোলা রে ডোলা রে’ গানটার রেকর্ডিংয়ের কথা। ১৬-১৭ বছরের মেয়েটি স্টুডিয়োয় এসে ডুয়েট গেয়েছিলেন তাঁরই সঙ্গে। কবিতা তখন বলিউডে যথেষ্ট প্রতিষ্ঠিত। স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘‘তখন ওর কত অল্প বয়স। কিন্তু কী ট্যালেন্টেড। আত্মবিশ্বাসী। তা দেখে সঞ্জয় লীলা বনশালী, ইসমাইল দরবার আর আমি বুঝতেই পেরেছিলাম মেয়েটি অনেক দূর যাবে।’’

অভিজিতের দৃষ্টিতে শ্রেয়া হলেন প্লেব্যাক গায়িকাদের মধ্যে অন্যতম সেরা। ‘‘শ্রেয়া আর সুনিধিকে আমি একই জায়গায় রাখব। ক’টা গান গাইছে সেটা বিবেচ্য নয়। ওদের সঙ্গে অন্য যারা বেসুরো গেয়ে হিট দিচ্ছে তাদের কোনও তুলনা হয় না। বিয়ে হোক না হোক, শ্রেয়ার যা ট্যালেন্ট তাতে কেরিয়ারে কোনও প্রভাব পড়বে না। ও আরও অনেক দূর যাবে,’’ বলছেন অভিজিৎ।

কিন্তু যেখানে জনপ্রিয়তা ব্যাপারটাই আজকাল এত ক্ষণস্থায়ী, সেখানে শ্রেয়া যে ১৩ বছর ধরে এ ভাবে রাজত্ব করে যাচ্ছেন, সেটা কী ভাবে হল? বলিউডে সোনু নিগম পরবর্তী জমানাতেও আতিফ, মোহিত, হিমেশ, অরিজিৎ-দের নাম শোনা যায়। কিন্তু গায়িকাদের ক্ষেত্রে? শাল্মলী খোলগেড়ে আছেন। উল্লাস করতে গেলে ‘দারু দেশি’ গানটা না শুনলেই নয়, বলেন অনেকে। আছেন মোনালি ঠাকুর। ‘লুটেরা’র পর মোনালির গাওয়া ‘সাঁওয়ারলু’ তো ঘুরছে লোকের মুখে মুখে। নীতি মোহন গেয়েছেন ‘ইশকওয়ালা লাভ’। আকৃতি কক্করের গলায় ‘খুদায়া খ্যার’ দারুণ জনপ্রিয়। ‘গেন্দাফুল’ থেকে ‘নমক’ কী সব গান গেয়েছেন রেখা ভরদ্বাজ। ‘মুন্নি বদনাম’ গেয়ে চর্চায় থেকেছেন মমতা শর্মা। আর কণিকা কপূর? ‘বেবি ডল’ তো প্রায় জাতীয় কলার টিউন বলে ঘোষিত হতে হতে আটকে গেল।

কিন্তু শাল্মলী, মোনালি, নীতি, আকৃতি, রেখা, কণিকা, মমতা— এঁরা কি কেউ পারবেন শ্রেয়া বা সুনিধিকে সরিয়ে দিতে?

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক সুরকার বলছেন, ‘‘হালফিলের বলিউড গায়িকাদের মধ্যে লোকে চাইছে সেক্সি গলা যার মধ্যে মাটির টানও আছে। এই মসৃণতা সুনিধির গলায় পাওয়া যেত। কিছু বছর আগেও সুনিধি একচেটিয়া ভাবে এই গানগুলো গাইত। এখন আরও অনেকেই গাইছে। গান হিটও করেছে। কিন্তু আজও বলিউডের শীর্ষস্থানীয় গায়িকা বলতে লোকে শ্রেয়া, সুনিধির কথাই বলে।’’

আর তা নিয়ে শ্রেয়ার কিন্তু দম্ভ নেই। মাঝে মধ্যে কেউ কেউ অভিমান করে বলেন, আজকাল শ্রেয়াকে ফোনে পাওয়া যায় না। কিন্তু যাঁদের সঙ্গে শ্রেয়ার বছরের পর বছর ধরে আত্মিক যোগ, তাঁদের সঙ্গে তিনি ঠিকই যোগাযোগ রেখেছেন— এমনটাই দাবি করছেন সুরকার জয় সরকার। আজও সময় পেলেই শ্রেয়া নাকি পুরনো দিনের গল্প করেন। যখন তাঁর বয়স ১৩-১৪। গরমের ছুটিতে রাজস্থান থেকে কলকাতায় এসে রেকর্ডিং করতেন। থাকতেন রাজপুরে ওঁর এক আত্মীয়ের বাড়িতে। অ্যালবামটার নাম ছিল ‘মুখর পরাগ’। তাতে দু’টো গান সুর করেছিল জয়। ‘‘তখনও লোপা (লোপামুদ্রা মিত্র)-র সঙ্গে আমার বিয়ে হয়নি। কিন্তু লোপা রেকর্ডিংয়ে আসত। তাই নিয়ে শ্রেয়া আমাদের খেপাত। হয়তো গান তুলছে, কিন্তু শ্রেয়ার হাসি আর থামছে না। তখন ওর বাবার কাছে বকুনি খেত। গত বছর ‘মন কেমনের স্টেশন’ রেকর্ড করতে এলে দেখি এখনও শ্রেয়া ওর বাবার কাছে ও ভাবেই বকুনি খায়!’’ হেসে বলছেন জয়।

তারপর মনে করিয়ে দিচ্ছেন যে ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে এত দিন টিকে থাকার বড় কারণ হল শ্রেয়ার পারিবারিক পরিবেশ। ‘‘ও রিয়্যালিটি শো থেকে উঠে এসেছে। চাইলেই ভেসে যেতে পারত। কিন্তু তা হতে দেয়নি। প্রথম ছবি কী বিশাল হিট। কিন্তু কৈ! পাড়ায় পাড়ায় গিয়ে শো করে বেড়ায়নি তো। ও জানে পারিবারের গুরুত্ব কতটা। বিয়েতে কোথাও কোনও দেখনদারি নেই। বিয়ের পর দিন সকালবেলা আমাকে ফোন করে নিজেই জিজ্ঞেস করল পিঁড়ি ধরে আমার হাতে ব্যথা হয়েছে কি না!’’ বলছেন জয়।

শ্রেয়ার সঙ্গে অন্তত কুড়িটা হিট গান গেয়েছেন বাবুল সুপ্রিয়। তাঁর ভাষায়, ‘‘নতুন প্রজন্মের গায়িকাদের মধ্যে নীতি, মোনালি আর শাল্মলী হল ডার্ক হর্স। এদের মধ্যে গলার গুণগত মান আর গান গাওয়ার ক্ষমতায় মোনালি এগিয়ে।’’ কিন্তু এঁরা কেউ কি শ্রেয়ার মতো জনপ্রিয় হতে পারবেন? উত্তরে বাবুল বলছেন, ‘‘শ্রেয়া আর সুনিধিকে ইঁদুর দৌড়ে রাখাই উচিত নয়। খুব কম বয়সে ওঁরা দারুণ সাফল্য পেয়েছে। টুইটারে শ্রেয়ার থ্রি পয়েন্ট থ্রি মিলিয়ন ফলোয়ার। ভাবা যায় কী রকম জনপ্রিয়তা থাকলে এটা সম্ভব!’’

শ্রেয়ার জনপ্রিয়তা নিয়ে জিৎ গঙ্গোপাধ্যায়কে প্রশ্ন করা হলে তিনি গায়িকার রেঞ্জের প্রশংসা করেন। যদি পঞ্চাশ ওভারের ম্যাচ হিসেবে ভাবা যায় তা হলে শ্রেয়া এখন কত ওভার খেলছেন বলে মনে হয়? ‘‘সবে কুড়ি ওভারে খেলছে। অন্যান্য গায়কগায়িকাদের চড়া পর্দায় গাইতে বললে গলাটা কেমন শ্রিল হয়ে যায়। কিন্তু শ্রেয়ার তা হয় না। ও ঠিক জানে কী অনুভূতি ডিমান্ড করছে। সব সময় পড়াশোনা নিয়ে থাকে। সেটার একটা প্রতিফলন ঘটে ওর গানে। এ সব গুণ নতুন গায়িকাদের মধ্যে কোথায়?’’ প্রশ্ন করছেন জিৎ।

বলিউডের এক নম্বর গায়িকা হিসেবে শ্রেয়াকেই সেরার মুকুট পরিয়ে রাখতে চান পরিচালক অনিরুদ্ধ রায় চৌধুরী। ‘‘হিট আছে। নিয়মিত ভাল গাইছে। প্রতিভা অসাধারণ। রেওয়াজি গলা, সুরে গায়। মাইকের সামনে এসেই একদম অন্য এক ব্যক্তিত্ব হয়ে যায় শ্রেয়া। প্যাকেজিং ভাল। আর নিজের জায়গাটা বজায় রেখে চলতে জানে ও,’’ বলছেন অনিরুদ্ধ।

তার পর চলে যান ‘অপরাজিতা তুমি’র গান রেকর্ডিংয়ের গল্পে। মুম্বইয়ের স্টুডিয়োতে ‘রূপকথারা’ গানটা রেকর্ড করবেন শ্রেয়া। খাওয়া দাওয়া আড্ডা ইত্যাদি হয়েছে। শান্তনু মৈত্র স্টুডিয়োর বাইরে গিয়েছেন। শ্রেয়া অনুরোধ করেন অনিরুদ্ধকে গানের দৃশ্যটা বুঝিয়ে দিতে। অনিরুদ্ধ বলতে থাকেন দুই বন্ধুর আলাদা হয়ে যাওয়ার গল্প। ছেলেটির বয়স হয়েছে... বিয়ে ভেঙেছে... মেয়েটির বিয়ে হয়েছে অন্য কোথাও... কিন্তু তাঁর জীবন টালমাটাল... সানফ্রান্সিসকোর রাস্তায় দু’জনের দেখা... পুরনো স্মৃতিগুলো আছড়ে পড়ে। ‘‘পাঁচ মিনিট শুনেই দেখি শ্রেয়ার চোখ জলে টল টল করছে। তারপর ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল। আজও ভাবলে গায়ে কাঁটা দেয়। সেই একই অনুভূতি হয়েছিল ‘ফেরারী মন’‌য়ের সময়। ওটার জন্য তো শ্রেয়া জাতীয় পুরস্কারও পেয়েছিল,’’ বলেন অনিরুদ্ধ।

সাফল্যের চূড়ায় এসে বিয়ের সিদ্ধান্তকে কী ভাবে দেখছেন অনিরুদ্ধ? ‘‘একদম ঠিক সিদ্ধান্ত। আমি কয়েকবার শিলাদিত্যর সঙ্গে আড্ডা দিয়েছি মুম্বইতে। খুব ভাল ছেলে। শ্রেয়ার মতো সেন্সিটিভ এক মেয়ের পার্টনার হিসেবে ও আদর্শ। শিলাদিত্য হল ‘রক স্টেডি’ আর ব্যালান্সড,’’ বলছেন অনিরুদ্ধ।

ইতিহাস স্মরণ করে বাবুল মনে করিয়ে দিচ্ছেন যে, এ দেশে গায়িকারা বিয়ের পরে পেশাদার দুনিয়ায় আরও বেশি সাফল্য পেয়ে এসেছেন। ‘‘আশা ভোঁসলে, অনুরাধা পাড়োয়াল, অলকা ইয়াগনিক— সবার ক্ষেত্রেই এটা সত্যি। সুনিধি আর শ্রেয়ার ট্যালেন্টকে সামনে রেখে আমি প্রার্থনা করব যে, ওদের ক্ষেত্রে ইতিহাসের যেন পুনরাবৃত্তি হয়। ভাল লাগছে এই ভেবে যে, শ্রেয়া এত ব্যস্ততার মধ্যেও ফ্যামিলি লাইফের স্বপ্নটা বাস্তবায়িত করার জন্য সঠিক সময় বেছে নিল। ছোটবেলার প্রেম পরিপূর্ণতা পেল বিয়েতে। ওর গান এতে আরও বেশি রোম্যান্টিক হবে,’’ বলেন বাবুল।

বাবুল হয়তো জানেন না শ্রেয়ার শুভাকাঙ্ক্ষীরাও একই আশায় বুক বেঁধেছেন।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement