লন্ডনের অ্যাবি রোড স্টুডিয়ো। রেকর্ডিংয়ের মক্কা বললে ভুল হবে না। আর সেখানে গিয়ে ব্রিটিশ ছবির গান রেকর্ড করে এলেন বাংলার শুচি। এমন এক ছবি যাতে অভিনয় করেছেন রিচার্ড গ্যেরে, ডেম জুডি ডেঞ্চ প্রমুখ! আর সঙ্গীত পরিচালক বিখ্যাত থমাস নিউম্যান। লক্ষ্মীপুজোর দিন কলকাতার এক হোটেলের কফি শপে সে নিয়েই আড্ডা দিলেন শুচি।
চাকদা থেকে অ্যাবি রোডের দূরত্বটা মেপেছিলেন কোনও দিন?
(হাসি) না। চাকদাতে যখন পাবনা কলোনিতে থাকতাম তখন ভাবিওনি।
তখন বড়জোর পেডার রোডের বাড়িটার স্বপ্ন দেখতেন। তাই না?
হ্যাঁ। সেটা ভেবেছিলাম ঠিকই। লতাজি (লতা মঙ্গেশকর) আমার আদর্শ। পেডার রোডের বাড়িতে গিয়ে যে লতাজিকে আমার গান শোনাতে পারব এটা আমার কাছে পরম সৌভাগ্যের ব্যাপার। অ্যাবি রোড স্টুডিয়োতে শ্যুটিং করার পরও লতাজির কাছে গিয়েছিলাম গণপতি উত্সবের সময়। আমায় বলেছিলেন যে মনে হয় না ভারত থেকেও অ্যাবি রোড স্টুডিয়োতে খুব একটা কেউ গেয়েছেন। লতাজি নিজে গেয়েছেন। আশাজিও গেয়েছেন।
থমাস নিউম্যান, শুচিস্মিতা দাস, জন ম্যাডান। লন্ডন অ্যাবি রোড স্টুডিয়োতে।
কথাটা শুনে নিজেকে তো চিমটি কেটেছিলেন?
(হাসি) তা নয়। তবে এটা একদম অন্য ধরনের অভিজ্ঞতা ছিল। স্টুডিয়োর সামনে সেই জেব্রা ক্রসিং। ওটা দিয়ে হেঁটে যেতেই মনে পড়ল বিটলস্রে সেই বিখ্যাত ছবিটার শ্যুটিংয়ের কথা। চার জন জেব্রা ক্রসিং দিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন। যে ঘরে জর্জ হ্যারিসন রেকর্ড করতেন সেখানে গেলাম।
মনে হচ্ছিল চাকদা থেকে আলোকবর্ষ দূরে চলে এলেন...
খানিকটা। এর আগেও ‘দ্য বেস্ট এক্সোটিক মেরিগোল্ড হোটেল’য়ে আমি গান গেয়েছি। এপ্রিল মাসে আমেরিকা ট্যুরে গিয়েছিলাম। তখন থমাসের সেক্রেটারির থেকে অফারটা পাই।
এপ্রিল মাসে অফার পেয়েও কেন রেকর্ডিং করতে যাওয়ার সময় ফ্লাইট মিস করেছিলেন আপনি?
ওহ্। সে কি বিশাল কাণ্ড! ক্ল্যাসিকাল আর ফিল্ম মিউজিক করার সঙ্গে সঙ্গে আমি আবার নিজের একটা ব্যান্ডও করেছি। নাম দিয়েছি রেড। এই ব্যান্ডে আমি সব ঘরানার মিউজিক করি। লন্ডনের রেকর্ডিংয়ের আগে আমার ব্যান্ডের একটা শো ছিল লাভাসা-তে। দিনটা ছিল ১৭ অগস্ট। যদিও সে রাতেই আমার লন্ডনের ফ্লাইট ধরার কথা ছিল, আমিই ভুল করে ভেবেছিলাম পরের দিন দুপুরের ফ্লাইটে আমাকে যেতে হবে।
কী করলেন তার পর?
মুম্বই থেকে লাভাসা গাড়িতে যেতে লাগে সাড়ে পাঁচ ঘণ্টা। শো ক্যান্সেল করা গেল না। কিন্তু অনেক অনুরোধে সময়টা এগিয়ে আনা হল। আমি এক কাপড়ে বেরিয়ে গিয়েছি। শো করে লাভাসা থেকে মুম্বই এয়ারপোর্টে পৌঁছালাম রাত সাড়ে বারোটার সময়। তার পর প্লেন ধরলাম লন্ডনের।
এ যেন একটা থ্রিলার চিত্রনাট্য!
(হাসি) তবে লন্ডনে পৌঁছে আর কোনও টেনশন হয়নি। মার্সেডিজ চেপে হোটেলে গেলাম। সেখানে এক দিন রেস্ট। পরের দিন থমাসের ফোন। এত বড় মাপের সুরকার। ‘স্কাইফল’য়ে সুর করেছেন। ওঁর সঙ্গে কাজ করে আমি ধন্য হয়ে গিয়েছি। কিন্তু উনি আমায় বলেছেন যে আমার সঙ্গে কাজ করতে গিয়ে উনি ভীষণ উত্তেজিত।
এটা কি শুধুই বিনয়?
অ্যানালিসিস করব না। মুম্বইয়ের এক কম্পোজারকে থমাসের সঙ্গে কাজ করেছি বলাতে আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, “তুমি জানো কত বড় মাপের মিউজিশিয়ান এই থমাস?” দুটো বাফতা পুরস্কার, ছ’টা গ্র্যামি আর একটা এমি অ্যাওয়ার্ড জিতেছেন থমাস। ‘রেভলিউশনারি রোড’, ‘দ্য আয়রন লেডি’, ‘দ্য গ্রিন মাইল’, ‘আমেরিকান বিউটি’র মতো সব ছবির সুরকার তিনি। কিন্তু কোনও দেখনদারি নেই। ‘দ্য বেস্ট এক্সোটিক মেরিগোল্ড হোটেল’য়ের থিম সং ‘আ বিট অব আফটার্স’ গুনগুন করতে করতে আমাকে নিয়ে স্টুডিয়োয় ঢুকলেন থমাস আর পরিচালক জন ম্যাডান। ওই থিম সঙের সরগম আমারই গাওয়া। ইউটিউবে শুনতে পাবেন। রেকর্ডিংয়ের আগে স্টুডিয়োর একটা ট্যুর করলেন আমাকে নিয়ে। তার পর পরিস্থিতিটা বুঝিয়ে বললেন আমার যা ইচ্ছে তাই করতে।
মানে? পূর্ণ স্বাধীনতা?
হ্যাঁ। আগের বার আমি একটা প্রচলিত বন্দিশ গেয়েছিলাম। রাগ যোগের ওপর। স্বাধীনতা পেয়ে জিজ্ঞেস করেছিলাম নিজে কিছু কম্পোজ করে শোনাতে পারব কি? ওঁরা রাজি। একটাই ব্রিফ। প্রেমের গান হওয়া চাই। আমার মনে হল কেমন হয় বাংলায় একটা কিছু লিখে যদি ব্যবহার করি?
ব্রিটিশ ছবি তাও রাজস্থানের পটভূমিতে। সেখানে বাংলা গান কী করে গাইলেন? এটা আপনার এক্সোটিক ইনপুট?
ওঁদের বলেছিলাম একটা আঞ্চলিক ভাষায় লিখব। আমি দু’টো অপশন দিয়েছি ওঁদের। একটা বাংলায়, অন্যটা ব্রজভাষায়। ওঁরা আপত্তি করেননি। মুখরার প্রথম লাইন ‘আমি তোমার পথ চেয়ে থাকি সারাদিন।’ যে দৃশ্যে গানটা ছিল, তাতে ছিলেন রিচার্ড গ্যের, লিলেট দুবে... একটি মেয়েকে দু’জন ভালবাসে। একজন রিচার্ড গ্যের। তবে মেয়েটি বোঝে ওর আসল ভালবাসার মানুষ হল অন্য একজন।
গ্যেরকে মনিটরে দেখে কী করলেন?
ওঁর কত ছবি দেখেছি। ‘শিকাগো’, ‘প্রিটি ওম্যান’, ‘আনফেথফুল’, ‘রানঅ্যাওয়ে ব্রাইড’... রিচার্ড গ্যেরকে দেখে দারুণ লাগলেও গান রেকর্ড করার সময় ও সব কোনও চিন্তা মাথায় আসে না। তখন শুধু মনে হয় গানটা ঠিক মতো গাইতে পারছি কি না।
লিলেট দুবে-রিচার্ড গ্যের। ‘দ্য বেস্ট এক্সোটিক মেরিগোল্ড হোটেল’য়ের সিকোয়েলে।
আপনি বললেন যে আপনাকে পরিপূর্ণ স্বাধীনতা দেওয়া হয় রেকর্ডিংয়ের সময়। এটার কারণ কি ভারতীয় মার্গসঙ্গীত সম্পর্কে ওঁদের অতটা পড়াশোনা নেই বলেই আপনার ওপর কোনও খবরদারি না করা?
এ ভাবে ভাবিনি। ওঁরা জানেন যে এই বিষয় নিয়ে আমি চর্চা করেছি। একটা ব্যাপার বলে রাখা দরকার। আমি নিজে তো ওয়েস্টার্ন মিউজিক শিখিনি। কিন্তু থমাস বলেন যে কৌশলগত ব্যাপারে কিছু না জানলেও আমি নাকি সহজাত ভাবে বুঝতে পারি কোন কর্ড-এর সঙ্গে কোন নোট গাওয়া উচিত। ওটা ওঁকে ব্যাখ্যা করতে হয় না।
দু’বার বিদেশি ছবিতে গান গাইলেন। কলকাতায় এসে গাইলেন এ আর রহমানের সঙ্গে। তবু আপনার সে ভাবে প্রচার নেই কেন?
কলকাতা থেকে ডাক পেলে দারুণ লাগবে। আসলে আমি নিজের ঢাক নিজে পেটাতে পারিনি কোনও দিন।
এই কথাটা কিন্তু সবাই বলেন। যাঁরা ঢাক পেটান, তাঁরাও...
আমি তো বলিউডে গাইতে শুরু করেছি। অরিজিত্ সিংহের সঙ্গে প্রীতমের সুর করা ‘শাদি কে সাইড এফেক্টস’য়ে গেয়েছি ‘দেশী রোম্যান্স’। গানটা দারুণ হিট করেছে। বিদ্য বালন ও ফারহান আখতারকে নিয়ে গানটা পিকচারাইজড। নাগেশ কুকনুরয়ের ‘লক্ষ্মী’ ছবিতে গেয়েছি ‘শুন সুগ্না রে’। সদ্য মুক্তিপ্রাপ্ত ‘জিগরিয়া’তেও আমার একটা হোলির গান আছে।
তবু বলিউডে আপনার শুরুটা ধীরগতিতে...
গান মানে কিন্তু আমার কাছে শুধু বলিউড নয়। মুম্বইতে শিফ্ট করলেও ফিল্মে গাওয়াটা আমার লক্ষ্য ছিল না।
কেন?
ব্যক্তিগত কিছু কারণ ছিল। পেশাদার এবং ব্যক্তিগত জীবনে যত ঝড়ঝাপ্টা সামলেছি, সেখানে আমার একটা সম্বল ছিল। তা হল সঙ্গীত।
প্রেম-বিয়ে নিয়ে ভাবেননি?
আই ইউজড টু হ্যাভ আ বয়ফ্রেন্ড।
তিনিও সঙ্গীতশিল্পী?
না। তবে সম্প্রতি খবরের শিরোনামে ছিল। বিশ্বব্যাপী ওর পরিচিতি। শাস্ত্রীয় সঙ্গীত পছন্দ করে।
নামটা?
না, সেটা উহ্য থাক।
নতুন কাউকে নিয়ে ভাবেন না?
কিছু সম্পর্ক বিয়ে-শাদির গণ্ডির মধ্যে ফেলা যায় না। আজও ওর উন্নতির কথা শুনলে আমার খুব আনন্দ হয়।
প্রেমের গান গাইতে গেলে কি আজও তাঁর স্মৃতি ভেসে আসে?
স্মৃতি সহজে মোছা যায় না। বিশ্বের যে কোনাতেই আমরা দুজনে থাকি না কেন, আমাদের একটা আত্মিক যোগ থাকবেই। আমার এই একলা পথ চলায় একমাত্র সহযোগী হল আমার গান। যখন লতাজির বাড়িতে গিয়ে ওঁকে গান শোনানোর সুযোগ পাই, যখন থমাসের মতো সুরকারের সঙ্গে কাজ করি, বা রহমানজি কিংবা প্রীতমের সঙ্গে কাজ করি তখন আর অন্য কিছু মনে হয় না। জানি মুম্বই এসে আমি যদি শুধুমাত্র আমার পেশাদার জীবন নিয়েই চিন্তা করতাম, তা হলে হয়তো কেরিয়ারটা অন্য রকম হত। আবার ভাবি এই বেশ ভাল আছি। সেদিন লতাজির বাড়িতে গিয়ে ওঁর সামনে যখন ‘লাগি লগন’ গাইলাম, তখন উনি বললেন, ‘ম্যঁয়নে না আমির খান সাব সে থোড়া অলগ শিখা থা...’। ওঁকে আমতা আমতা করে জিজ্ঞেস করলাম, ‘দিদি, একটু বলবেন কী রকম ভাবে শিখিয়েছিলেন?’ তখন উনি ওই জায়গাটা গেয়ে শোনালেন। আমার গাওয়া ‘পতি সখী সঙ্গ’য়ের স্বরলিপিটা হল ‘পা রে সা রে সা সা’। আর দিদি গাইলেন ‘পা নি নি রে গা সা সা’। এই যে মুম্বইতে এসে দিদির পায়ের তলায় বসে এ ভাবে শিখতে পারলাম, এটা কি কম বড় আশীর্বাদ?