খেয়ালি খাম তোকে হঠাত্‌ ছুঁয়ে দিলাম

আরব সাগরপারের সাফল্যের পর এ বার উদীয়মান গায়ক পাপন যে গঙ্গার ধারে শহর কলকাতায়। নতুন পরীক্ষা দিতে। তাঁর সঙ্গে দেখা করে এলেন সংযুক্তা বসু।এমন নরম কথাকে গানের সুরে ভাসিয়ে নিয়ে গিয়েছেন যে গায়ক, তিনি কিন্তু বাঙালি নন। অহমিয়া। নাম পাপন। তাঁর কণ্ঠ যেন ব্রহ্মপুত্র নদের উত্তাল ঢেউয়ের সঙ্গে মিলিয়ে দিতে চায় ‘ও গঙ্গা তুমি নিঃশব্দে নীরবে বইছ কেন’র শান্ত বিহ্বলতার আর্তি।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০৪ অগস্ট ২০১৪ ০০:০০
Share:

ছবি: কৌশিক সরকার।

এসেছে রাত ভিজে হাওয়ার

Advertisement

খোলা চিঠির পাশে থাক

খেয়ালি খাম তোকে হঠাত্‌

Advertisement

ভুল করে আজ ছুঁয়ে দিলাম....

এমন নরম কথাকে গানের সুরে ভাসিয়ে নিয়ে গিয়েছেন যে গায়ক, তিনি কিন্তু বাঙালি নন। অহমিয়া। নাম পাপন। তাঁর কণ্ঠ যেন ব্রহ্মপুত্র নদের উত্তাল ঢেউয়ের সঙ্গে মিলিয়ে দিতে চায় ‘ও গঙ্গা তুমি নিঃশব্দে নীরবে বইছ কেন’র শান্ত বিহ্বলতার আর্তি।

পাপন নামটা শুনলে কেমন যেন পাড়ার ছেলে, পাড়ার ছেলে মনে হয়। সারা দেশটাই এখন এই পাপনের পাড়া। তাঁর একটা ভাল নামও আছে। বেশ ভাল নাম। অঙ্গরাগ মহন্ত। কিন্তু গায়ক হিসেবে জনপ্রিয়তার তোড়ে সে নাম ধোপে টেকেনি।

তাঁর ঝকঝকে চেহারার ছবি ছাপা টি শার্ট পরে নাকি ঘুরে বেড়ায় আম অসমিয়া জেন ওয়াই।

কারণটা?

অসমিয়া লোকগান গেয়ে তিনি এখন সেখানকার রকস্টার। ব্যান্ডের নাম ‘ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি।’

সে কী! ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি? মানে ভারত দখলের সেই ভয়ঙ্কর ইতিহাস?

পাপনের সঙ্গে কথা হচ্ছিল অনিরুদ্ধ রায় চৌধুরী পরিচালিত ‘বুনো হাঁস’ ছবির মিউজিক লঞ্চের পর দিন। কলকাতারই এক পাঁচতারা হোটেলে। গুয়াহাটি রওনা দেবেন বলে দ্রুত জিনিসপত্র গোছাচ্ছিলেন।

তারই ফাঁকে হাসতে হাসতে বললেন, “সবাই বলেছিল যে এটা ব্রিটিশ রুলারদের নাম। দলের নাম এমন না হওয়াই উচিত। কিন্তু আমি বললাম, পূর্ব ভারতই যখন আমার দেশ, তখন ব্যান্ডের নাম ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিই তো হওয়া উচিত। আমি শেকড়ের কথা বলি, মাটির গান গাই, আবার বলিউডে গিয়ে পর পর ছবিতে গান গাইছি এখন। লোকগান মানে যে গ্রাম্যতা নয়, নাগরিক জীবনের একটা আশ্রয় হল ফোক, সেটা আমি অসমের ছেলেমেয়েদের বুঝিয়ে দিয়েছি।”

অসমের সবুজ পাহাড়ের তারুণ্যে ভরা পাপনের হাসি আর কথার ফাঁকে ফাঁকে ঝরে পড়েছিল আত্মবিশ্বাস। যা তিনি অর্জন করেছেন গত বছর পাঁচেকে। বলিউডে তিনি আজ সুপরিচিত গায়ক। ২০১৪তেই রিলিজ করবে অনেক ছবি। ‘ববি জাসুস’, ‘ম্যাড্রাস কাফে’র গান গেয়ে জনপ্রিয় হওয়ার আগে খুব বেশি দিন মুম্বই শহরে পা ঘষটাতে হয়নি পাপনকে। ‘দম মারো দম’ ছবিতে একটা গান গাওয়াতে প্রীতম তাঁকে নিয়ে এসেছিলেন ইন্ডাস্ট্রিতে। তার পর বেশ কিছু ছবিতে তাঁর গান চিনিয়ে দিয়েছিল প্রতিভা আর দক্ষতা। যা দেখে শান্তনু মৈত্রের মনে হয়েছিল পাপনের মধ্যে বড় জাতের শিল্পী হয়ে ওঠার সম্ভাবনা প্রবল ভাবে লুকিয়ে আছে।

দেবের লিপে পাপনের গান

‘বুনো হাঁস’ ছবিতে পাপনের ‘এসেছে রাত’ গানে তাঁর সঙ্গে গলা মিলিয়েছেন শ্রেয়া ঘোষাল। আর সেই যুগলবন্দি শুনে সঙ্গীত পরিচালক শান্তনু মৈত্রের মনে হচ্ছে শ্রেয়া আর পাপন হয়ে উঠতে পারেন সমকালীন বলিউডের শ্রেষ্ঠ রোম্যান্টিক জুটি। কথাটা স্মরণ করিয়ে দেওয়াতে সেই পাহাড়িয়া সম্মোহনী হাসি ছড়িয়ে পাপন বললেন, “জুটি হব কি না জানা নেই। ভাল সুযোগ এলে আমি আর শ্রেয়া নিশ্চয়ই গান গাইব। ও আমার বন্ধু হয়ে গিয়েছে। মানসিকতাতেও মিল আছে অনেক। আসলে ‘এসেছে রাত’ গানটার মধ্যে এমন একটা মাদকতা ছিল যে রেকর্ডিং শেষ হয়ে যাওয়ার পর আমরা ক’জন সে দিন অনেক রাত অবধি প্রায় ‘স্পেলবাউন্ড’ হয়ে স্টুডিয়োতে বসে ছিলাম। গানটার রেশ এমন।”

অসমের মনোরম নিসর্গকে পেছনে ফেলে আসা পাপন এক সময় পেশায় আর্কিটেক্ট হতে চেয়েছিলেন কথায় কথায় বললেন, “আসলে গান না আর্কিটেকচার? এই নিয়ে এমন একটা দ্বন্দ্ব শুরু হল! শেষ কালে আমার এক দাদা এসে বলেছিলেন ‘দ্যাখ, দুটো প্রেমিকা নিয়ে জীবন কাটাতে পারবি না।’ তাই শেষমেশ বুঝে গেলাম গানই আমার প্রেমিকা। ফিরে এসেছি গানের কাছে।” কিন্তু অরিজিত্‌ সিংহ? তিনি তো আপনার প্রতিদ্বন্দ্বী? বলিউডে টিকতে হলে তাঁর সঙ্গে পাল্লা দিতে হবে তো? “ও আমার বন্ধু। ভাল ছেলে। কিন্তু ওর গায়কি আলাদা। আমার গায়কি আলাদা। আমরা কেন প্রতিদ্বন্দ্বী হব? কোনও ভাল গান ও পেয়ে গেলে হয়তো কখনও মনে হতে পারে, ইশশ্ গানটা আমি পেলাম না। কিন্তু সেটা তো একটা সুস্থ প্রতিযোগিতা!” যখন এই কথাগুলো বলছিলেন, মনে হচ্ছিল হেড ফোনে বরফি-র ‘কিঁউ’ গানটা বাজছিল। ওই গানটার জার্নি। জার্নির ওঠাপড়া চিকচিক করে ধরা পড়ছিল পাপনের পাহাড়ি সবুজ চোখে।

আসল কথা, যতই জনপ্রিয়তার জোয়ার জেন ওয়াই পাপনকে বাঁধতে চাক, তাঁর ভেতর লুকিয়ে আছে বাউল মন। ভ্রমণপিপাসু মন। সময় পেলেই পাহাড়ে যান। দেশ বিদেশে লোকগান গেয়ে বেড়ান। শোনেনও। বললেন “আমি আর শান্তনুদা অনেকটা একই রকম। আমাদের কাছে জীবন আগে, ফাংশান-শো এই সব অনেক পরে। নিজেদের শখ উপভোগ করে জীবন কাটাই। বিশ্বাস করুন, মুম্বই শহরের ওয়ার্ক কালচারটাই শুধু আমার ভাল লাগে। সমুদ্র ছাড়া ওখানে আর কিছুই উপভোগ করার নেই। ফিরে আসার ঘর কিন্তু আমার অসম। আদ্যোপান্ত মেঠো ছেলে আমি।”

আর বাংলা? বাংলা গাইছেন বটে পাপন। কিন্তু ভাল ভাবে বাংলা বলতে পারেন না। তাই বলে কি বাংলার সঙ্গে কোনও সম্পর্ক নেই? তা কেন হবে? পাপনের বাবা-মা দু’জনেই ছিলেন আইপিটিএ-র সঙ্গে যুক্ত। তাঁদের সঙ্গে পরিচয় ছিল হেমাঙ্গ বিশ্বাসের, সলিল চৌধুরীর। সেই সূত্রে বাঙালিয়ানার আর একটা মাত্রা তাঁর কাছে পরিচিত। মনে মনে কোথাও পাপন বাঙালি। বললেন, “‘আমি যে জলসাঘরে’ গানটা মা-বাবার কাছে শিখেছি, সেটা খুব ভাল গাই। এ বছর বেশ কিছু বাংলা ছবি রিলিজ করবে যেখানে আমার গান আছে। আরও বাংলা গান গাইব আমি। আরও বাংলা গান গাইতে চাই। ঠিক যেমন চাই বলিউডেও একটা জায়গা ধরে রাখতে। দেবের সঙ্গে আলাপ হল। বেশ লাগল ওকে। বলল, মুম্বইয়ে গেলে আড্ডা হবে।’’

এক দিকে অসমের দুটি পাতা একটা কুঁড়ির হিল্লোল, অন্য দিকে আরব সাগরের নোনা জল, পশ্চিম ঘাট পর্বতমালা আর অন্যদিকে বাংলার মুখ। এই তিন নিয়ে বেশ আছেন পাপন ওরফে অঙ্গরাগ মহন্ত। ধর্মে বৈষ্ণব। মূতির্র্ পূজা করেন না। নিরাকার ঈশ্বরপ্রেমে কীর্তন গাইতে ভাল বাসেন।

কিন্তু শুধু ঈশ্বরপ্রেমে কি জীবন চলে? শিল্পীর তো আরও প্রেম লাগে। মানবীপ্রেম। হোটেলের ঘর থেকে বেরোতে বেরোতে বললেন, “লাগে তো। কিন্তু আমি বিবাহিত। এক ছেলে, এক মেয়ে আছে। কোথাও তো সব প্রেমেই লাইন টানতে হয়।”

তা হলে গানের অনুরাগিনীদের সামলান কী ভাবে? হাসতে হাসতে বলেন,“ আমার গানের প্রেমে পড়ো, যত খুশি পড়ো। কিন্তু আমার প্রেমে পোড়ো না। এটাই বলি।”

সত্যিই তো তাই। খেয়ালি খামকে ভুল করে শুধু গানের ভেতর দিয়ে ছুঁয়ে দেওয়া যায়। শিল্পী নিজে কি পারেন, ভুল করেও কখনও খেয়ালি খামে হঠাত্‌ তাঁর পরশ রাখতে?

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement