মারাকানা স্টেডিয়াম
জায়গাটা খুব একটা মনে করতে পারলাম না। তবে পাহাড় দিয়ে ঘেরা। একসঙ্গে অনেকগুলো মাঠ। ঘেরা চারদিকটা। ছবির মতো। এটা কি তেরেসোপোলিস? যেখানে ব্রাজিল প্র্যাকটিস করছে। জায়গাটা চেনা নিশ্চয়ই নয়। তা হলে ডিক কোভারম্যান, সুনীল ছেত্রী, রহিম নবি, সুব্রত পালেরা কী করছে ওখানে? ওই তো সব ভারতীয় জার্নালিস্টরাও ল্যাপটপের ব্যাগ হাতে। বাইচুং ভুটিয়াও দাঁড়িয়ে। একটা চ্যানেলকে ইন্টারভিউ দিচ্ছে। আর সুনীলেরা প্র্যাকটিসে ব্যস্ত। সেট পিস। কোভারম্যান নিজে দাঁড়িয়ে করাচ্ছেন।
কাঁধে একটা মৃদু টোকায় ঘুম ভেঙে গেল। এমিরেটসের বিমানসেবিকা হাসি মুখে পাশে দাঁড়িয়ে। “স্যার, আমরা এবার নামব। চেয়ারটা সোজা করে নিন। সিট বেল্টটা বেঁধে নিন।” বাইরে তাকালাম। চকচক করছে রোদ্দ্ুর। পায়ের নীচে পর পর অনেকগুলো সবুজ পাহাড়। রোদ খেলা করছে তাতে। এবার পাইলটের গলাটা শুনতে পেলাম, “অল কেবিন ক্রু পির্রেয়ার ফর ল্যান্ডিং।” পায়ের নীচের ছবিগুলো ততক্ষণে বদলে গিয়েছে। কিছু হাইরাইজ। কিছু ঘিঞ্জি এলাকা। ব্যস্ত রাস্তাঘাট। এটাই সাও পাওলো। এটাই ব্রাজিল। এখানেই মাঠে, ঘাটে, বস্তিতে, গলিতে পেলে তৈরি হয়। গারিঞ্চা তৈরি হয়। রোনাল্ডিনহো হয় বা নেইমার।
আজ থেকে তিরিশটা বছর আগের কথা মনে পড়ল। আমাদের বেড়ে ওঠার মফস্সলে তখন ছড়িয়ে ছিটিয়ে সিনেমা হল। বিদেশি সিনেমা মানে কলকাতার গ্লোব বা নিউ এম্পায়ার। ব্রাজিলের সঙ্গে আলাপের জন্য অবশ্য কলকাতা ছুটতে হয়নি। পাড়ার একটা ক্লাব চ্যারিটি শো-য়ে হুগলির একটা সিনেমা হলে এসেছিল ‘জায়েন্টস অফ ব্রাজিল’।
চোখ বন্ধ করলে শুনতে পাই এখনও গ্যালারির সেই দ্রিম দ্রিম আওয়াজ। সে বারই প্রথম দেখা।
আর প্রথম দেখায় প্রেম। তখনও বিশ্বফুটবলের জানলা কোথায় আমাদের জন্য? ‘জায়েন্টস অফ ব্রাজিল’ দেখিয়েছিল ফুটবল মানে কী! আর ফুটবলে ব্রাজিলে আসলে কী!
অনেক পরে পেলের আত্মজীবনীতে পড়েছিলাম, ‘আমেরিকান আর্মিতে একটা কথা প্রচলিত আছে। গতিশীল কিছু হলে স্যালুট করো। জড় পদার্থ হলে সরিয়ে ফেলো। খুব বড় কিছু হলে সরাতে না পারলে সেটা রং করে দাও। আমাদের ব্রাজিলে বিষয়টা এই রকম: গতিশীল কিছু হলে তাতে শট মারো। জড় পদার্থ হলে তাতে শট মেরে গতিশীল করো। আর খুব বড় হলে তাকে ছোট করে শটই মারো।’ এই দেশটা ওটাই জানে। ফুটবল, ফুটবল আর ফুটবল। ইন ফ্লাইট ম্যাগাজিনে দেখলাম পেলের একটা বড় ইন্টারভিউ। অন বোর্ড টিভিতেও দেখলাম পেলের স্বাগত ভাষণ। ‘ওয়েলকাম টু ব্রাজিল’। বোয়িং ৭৭৭-৩০৩ বিমানটার গায়েও বিশ্বকাপের একটা বিরাট লোগো। ডাউনটাউন শপিং মল যেখানেই গেলাম চোখে পড়ছিল ওটাই। ব্রাজিলের রং এখন হলুদ সবুজ। বিক্ষোভের রঙে ভাটা পড়েনি যার।
পেলে
দেশের মাটিতে ফুটবল। ১৯৫০য়ের পর আবার। তখন কাপ জেতা হয়নি। লক্ষ লক্ষ মানুষের স্বপ্ন চুরমার করে দিয়েছিল উরুগুয়ের গোল। ওই জ্বালাটা এখনও ভোলেনি ব্রাজিল। পাঁচবার বিশ্বকাপ জিতেছে। সোনার পরি পাকাপাকি ভাবে দেশে। কিন্তু দেশের মাটিতে বিশ্বকাপ জেতা হয়নি। সাও পাওলো এয়ারপোর্টে আলাপ হয়েছিল ভিক্টরের সঙ্গে। এখানে হোন্ডা কোম্পানির প্রোজেক্ট ম্যানেজার। ইউরোপে ছুটি কাটিয়ে দেশে ফিরছে। পরদিনই একটা ব্রাজিলিয়ান রেস্তোরাঁয় খেতে নিয়ে গিয়েছিল। এমনিতে এ দেশে কথা বলার লোক পাওয়া মুশকিল। একশো জনের একজন লোকও ইংরেজি জানে কিনা সন্দেহ। গুগুল ট্রান্সলেটর ডাউনলোড করে রেহাই পেতে হচ্ছে। যেখানেই যাচ্ছি এক সমস্যা। এ দেশে আবার সব চেয়ে উপকারী বন্ধু এই মোবাইল। আর অবশ্যই ভিক্টর।
এই প্রতিবেদনটা লিখছি স্যান্টোস থেকে। সাও পাওলো ফিরে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু এতটা দূর কল্পনা করতে পারিনি। হোটেল থেকে শুনেছিলাম এক ঘণ্টা লাগবে। সেটা লাগল আসলে চার ঘণ্টা। পেলে-নেইমারদের ক্লাব দেখার জন্য থেকেই যেতে হল। ভিক্টর বলছিল, “এ বছরে ব্রাজিলে নির্বাচন। দেশের মাটিতে বিশ্বকাপ না জিতলে সরকার পড়ে যাবে। ব্রাজিলিয়ানদের ক্ষোভ চরমে।” ক্ষোভটা টের পাচ্ছিলাম। জিনিসপত্রের দাম যে কী পর্যায়ে! ট্যাক্সিতে পাঁচ মিনিটের দূরত্বে ভাড়া গুনতে হচ্ছে তিনশো টাকা। বাসে স্যান্টোস এলাম। চার ঘণ্টা। ভাড়া হল দেড়হাজার টাকা! রাতে পিত্জার দাম পড়ল ন’শো টাকা। ব্রাজিলের লোকজন ক্ষেপে থাকবে না কেন? এই তো গত দু’দিন মেট্রোতে স্ট্রাইক। ভিক্টররের কথায়, “বিশ্বকাপ জিতলে এই বিক্ষোভ সব উধাও হয়ে যাবে।”
স্কোলারির টিম যদিও প্রবল সমর্থন পাচ্ছে সাধারণ মানুষের। কনফেডারেশন কাপ জেতার পর থেকে ব্রাজিলের সমর্থকেরা বিশ্বাস করছে যে বিশ্বকাপ জেতা সম্ভব। কনফেডারেশন কাপে এমনও হয়েছে, জাতীয় সঙ্গীত বন্ধ হয়ে গিয়েছে। ফুটবলারেরা আর স্টেডিয়ামের দর্শকেরা একসঙ্গে দাঁড়িয়ে জাতীয় সঙ্গীত শেষ করেছে। এই সমর্থনটা বোধ হয় প্রত্যাশা বাড়াচ্ছে।
নেইমার
১৯৫০য়ের ফাইনালে মারাকানা স্টেডিয়ামের ছবি দেখছিলাম। ঘিজিয়ার গোলটার সময় গ্যালারিতে কানায় কানায় মানুষ। দু’ লাখ লোক হয়েছিল সে দিন। মারাকানার দর্শক আসন কমে গিয়েছে। কিন্তু চৌষট্টি বছরে জনসংখ্যা বেড়েছে কয়েকগুণ। বিশ্বকাপ শুরুর আগে ব্রাজিলে এসে লোকজনের আগ্রহে সেই আঁচটা অনুভব করছি। এখনও ফুটবলের আসল বৃত্তে ঢোকা হয়নি। চার পাশে ঘোরা ফেরা শুধু। তাতেই বুঝতে পারছি, ব্রাজিলের মাটিতে বিশ্বকাপ আসলে কী হতে চলেছে। এখানে আসার দিন সাও পাওলোর ইমিগ্রেশনে লম্বা লাইন। কেউ জাপান, কেউ অস্ট্রেলিয়া, কেউ রাশিয়া থেকে এসেছেন। বিশ্বকাপে ঘুরে যেতে চাইছেন। বিশ্বকাপ শুরু হলে শুধুই ফুটবল।
ওখানেই আলাপ উইলিয়ামের সঙ্গে। নাইজেরিয়ার মানুষ। বিশ্বকাপ দেখাবেন বলে বৌ আর ছেলেকেও নিয়ে এসেছেন। এয়ারপোর্ট থেকে শহর অবধি রুট ম্যাপটা বুঝিয়ে দেওয়ার ফাঁকে বললেন, “বৌ আসায় একটাই সমস্যা হল সাত জন ব্রাজিলিয়ান বান্ধবীর নাম- ফোন নম্বর ডিলিট করতে হবে।” অবাক করার সুযোগ না দিয়েই পরের পরামর্শ ‘“পর্তুগিজটা শিখে নিলে ব্রাজিলিয়ান সুন্দরীর অভাব হবে না।”
নানা রঙের পাসপোর্ট হাতে বিভিন্ন দেশের লোক, ভারতের কয়েক জন সাংবাদিকও আছেন। ‘ভারত ফুটবল খেলে?’ এমন প্রশ্নেরও মুখোমুখি হতে হয়েছে। অথচ এই ব্রাজিলেই গোটা ভাগ্যচক্রটা বদলে যেতে পারত। হ্যাঁ সেই ১৯৫০এ। সে বার ব্রাজিল বিশ্বকাপে আমন্ত্রণ পেয়েছিল ভারত। কিন্তু সে আমন্ত্রণ ফিরিয়ে দিয়েছিল ভারতীয় ফুটবল সংস্থা। কেন? আসা যাওয়ার জন্য প্রায় ছ’ মাস জাহাজে থাকতে হবে। আর খেলতে হবে বুট পরে।
শৈলেন মান্নাদের তাই আর বিশ্বকাপ খেলা হয়নি।
১৯৫০য়ের জ্বালা ব্রাজিল মিটিয়ে নিয়েছিল আট বছর পরে। সুদে আসলে মিটিয়ে নেওয়ার সুযোগ আবার চৌষট্টি বছর পরে। মারাকানাতেই যে ফাইনাল। সুযোগ নিশ্চয়ই ছাড়বেন না নেইমাররা। কিন্তু আমাদের? এই ৬৪ বছরে আমরা বরং আরও ভাল দর্শক হয়েছি। এই ফুটবল যজ্ঞে আমাদের কোনও আহুতি নেই। আমরা বোধ হয় খেলাই দেখে যাব। আরও ৬৪ বছর, তার পর আরও ৬৪ বছর।