কত আসন পাবে এনডিএ? নরেন্দ্র মোদী কবেই বা দেখা করতে যাবেন রাইসিনা হিলের বঙ্গসন্তানের সঙ্গে? আজ সকালের টুইটারের ট্রেন্ডে এগিয়ে থাকবে কে?
পুরো দেশ যখন এই মুহূর্তে এই সব জল্পনা নিয়ে ব্যস্ত, লেক গার্ডেন্সের বাড়িতে কিন্তু একজন এ সব থেকে অনেক দূরে।
তিনি তাঁর পরের ছবির স্ক্রিপ্ট আরও একবার পড়ছেন। লাস্ট মিনিটের কাঁটাছেঁড়া করছেন, আরও পালিশ দিচ্ছেন স্ক্রিপ্ট-এ। সঙ্গে তালমিছরি অবশ্যই রয়েছে।
তিনি? তিনি সৃজিত মুখোপাধ্যায়। ‘জাতিস্মর’য়ের পর ব্যস্ত তাঁর পরের ছবি নিয়ে।
এবং এ বার কিন্তু ২০১৪-র নির্বাচনের মতোই পরতে পরতে চমক।
প্রথম চমক, ‘অরুণ চ্যাটার্জি’ ওরফে ‘প্রবীর রায়চৌধুরী’ ওরফে ‘কুশল হাজরা’ ওরফে প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায় নেই তাঁর পরের ছবিতে।
তাই নাকি? ইয়েস।
দ্বিতীয় চমক?
যে-সৃজিতের ছবির গান মানেই সুপারহিট, সে ‘আমাকে আমার মতো থাকতে দাও’ হোক বা ‘এ তুমি কেমন তুমি’ সেই সৃজিতের পরবর্তী ছবিতে কোনও গান নেই।
কী বলছেন কী? আরে সত্যি কথা।
আর তৃতীয় চমক?
চমক ছবির টাইটেলে। এখন অবধি যা ঠিক হয়েছে, এই ছবির টাইটেল, ‘দুলাল চন্দ্র ভড়ের আসল ভালবাসার গল্প’। এই টাইটেলটা যদি পড়ে বেশি বড় মনে হয়, তা হলে পরিবর্ত টাইটেলও ভেবে রেখেছেন পরিচালক। সেটা ‘নির্বাক’।
মাঝখানে ‘জাতিস্মর’ ছবিটি রিলায়্যান্স এন্টারটেনমেন্ট ও রানা সরকারের সঙ্গে করলেও সৃজিত এ বার ফিরে গিয়েছেন তাঁর বাকি সব ছবির প্রযোজক ভেঙ্কটেশ ফিল্মস-এর কাছেই।
‘দুলাল চন্দ্র ভড়ের আসল ভালবাসার গল্প’র শ্যুটিং শুরু জুলাই মাসে।
তা হলে কি বিপাশা
এই ছবিতে এখনও অবধি দু’জন অভিনেতাকে চূড়ান্ত করে ফেলেছেন সৃজিত। তাঁরা হলেন ঋত্বিক চক্রবর্তী ও যিশু সেনগুপ্ত। এ ছাড়াও আর দু’টো গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রের কাস্টিং এখনও বাকি। তার একটি নায়িকা এবং অন্যটি একটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র।
এখনও অবধি যা খবর, এই দুই চরিত্রের জন্য বলিউডের অনেক বড় নামের সঙ্গেই কথা বলছেন সৃজিত।
“হ্যাঁ, এই ছবির কাস্টিং টলিউড আর বলিউড মিলিয়েই করব। টলিউড থেকে তো যিশু আর ঋত্বিক রইল।
এখন বলিউডের অনেকের সঙ্গে কথাবার্তা চলছে। সেগুলো প্রধানত তাঁদের ডেটস্ নিয়ে,” বলছেন সৃজিত।
কিন্তু এই দুই চরিত্রের মধ্যে একটি তো নায়িকার! সৃজিতের ছবির নায়িকা কে, তা নিয়ে বরাবরই কৌতূহল থাকে। তা কাকে নায়িকা হিসেবে ভাবছেন?
“এখনও ঠিক করিনি। খুব শিগগিরি জানতে পারবেন, এটুকু প্রমিস করছি,” হাসতে হাসতে বলেন সৃজিত।
তিনি মুখে কিছু না বললেও যা খবর, মুম্বইতে বিপাশা বসুর সঙ্গে নাকি কথা বলছেন। অন্য চরিত্রের জন্য মুম্বইয়ের এক নামী চরিত্রাভিনেতাকে দেখা যাবে, আশ্বাস দিচ্ছেন পরিচালক।
সাইলেন্স এখানে একটা চরিত্র
বৃহস্পতিবার সকালে সালভাদর দালির আঁকা টি শার্ট আর শর্টস পরে আড্ডা মারতে মারতে নিজেই জানালেন কী ভাবে শুধুমাত্র দেড় দিনে তিনি লিখে ফেলেছেন এই ছবির গল্প।
“আমেরিকাতে ৪০ দিন কাটিয়ে তখন আমার ম্যাসিভ জেট-ল্যাগ। এক দিন সকালে লেখা শুরু করলাম। ঠিক দেড় দিন লেগেছে এই গল্পটা লিখতে,” বলছিলেন সৃজিত।
কিন্তু এ ছবির বিষয়বস্তু কী?
“এটা বেসিক্যালি চারটে লভ স্টোরি যেখানে সাইলেন্স ইজ আ ভেরি ইম্পর্ট্যান্ট ক্যারেকটার। নৈঃশব্দ্যটা আমি ধরতে চাই। এবং এই ছবিতে কোনও গান নেই,” বলেন সৃজিত।
আমি দেখতে পাচ্ছি না স্বস্তিকাকে
গান নেই, নৈঃশব্দ্যকে ধরতে চান, হল কী সৃজিত মুখোপাধ্যায়ের? বিচ্ছেদের পর ৪০ দিন আমেরিকাতে বেড়াতে গেলেন, ফিরে এসে চেনা ছকের বাইরে ছবির প্ল্যান করছেন, এ সব কি স্বস্তিকার সঙ্গে সম্পর্ক ভেঙে যাওয়ার পর তাঁর মনের অবস্থার প্রতিফলন?
“ধুর, ধুর, এ সব কিছু নয়। বক আর রামায়ণের মধ্যে কোনও যোগাযোগ নেই,” হাসতে হাসতে বলেন সৃজিত। কিন্তু তাঁর আগের দু’টো ছবিতে যিনি নায়িকা, সেই স্বস্তিকার সঙ্গে তো তাঁর সম্পর্ক ছিল। এ বার স্বস্তিকা থাকবেন না সেটে? সেটা কি কনসেনট্রেট করতে সাহায্য করবে? নাকি ছটফটানি বাড়বে?
“দেখুন আমার সব ছবির আগেই আমি ফোকাসড্ থাকি। প্রত্যেকটা ছবির আগেই মনে করি এটা আমার প্রথম ছবি। সেটার সঙ্গে আমার কী সম্পর্ক তার কোনও যোগ নেই। আর যাঁর কথা আপনি বললেন, তিনি আমার আগের দু’টো ছবিতে ছিলেন কারণ অভিনেত্রী হিসেবে আমি চেয়েছিলাম তাঁকে। আর তাঁর অভিনয় যে মানুষের ভাল লাগছে, তাতেই তো প্রমাণিত আমার সিদ্ধান্তটা ঠিক ছিল। আই স্ট্যান্ড ভিন্ডিকেটেড,” বলেন ‘জাতিস্মর’ ছবিতে মহামায়ার অফিসের বস।
কিন্তু এই ছবিতে কি নায়িকার ভূমিকায় দেখা যাবেই না স্বস্তিকাকে?
“আমার এই ছবির নায়িকার যে চরিত্র সেটাতে আমি দেখতে পাচ্ছি না স্বস্তিকাকে,” সাফ উত্তর সৃজিতের।
ছবির জাতীয় পুরস্কারের পর রিপোর্ট কার্ড
‘গ্রিন ইজ দ্য কালার অফ এনভি’। কিন্তু ন্যাশনাল অ্যাওয়ার্ড পাওয়ার পর সৃজিত
সবুজের নানা রকম রং দেখতে পেয়েছেন। নিজেই তার মানে বুঝিয়ে দিলেন:
হাল্কা সবুজ: এই গোষ্ঠী, ‘জাতিস্মর’ ন্যাশনাল অ্যাওয়ার্ড পাওয়ার পর একেবারে নিশ্চুপ। একটা বাংলা ছবি যে চার-চারটে পুরস্কার পেল সেটা নিয়ে কোনও উচ্চবাচ্য নেই এদের।
তুঁতে সবুজ: এরা খুব কষ্ট করে আমাকে কনগ্র্যাচুলেট করেছে।
বটলগ্রিন: এরা প্রশংসা করেছে আমাকে কিন্তু প্রশংসার মধ্যেও তির্যক মন্তব্য ঢুকিয়ে দিয়েছে।
ফ্লুরোসেন্ট গ্রিন: এরা হচ্ছে নস্যাৎ ক্যাটাগরি। কীসের ন্যাশনাল অ্যাওয়ার্ড বলে উড়িয়ে দিয়েছে আমাদের।
যে বিরিয়ানি রাঁধে সে কন্টিনেন্টালও পারে
কিন্তু সৃজিত মুখোপাধ্যায়ের ছবি বলতেই তো দর্শকরা বোঝেন প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়, বড় ক্যানভাস, হিট গান, ফ্যান্সি সব লোকেশন।
এই ছবিটা কি ঠিক সৃজিত মুখোপাধ্যায়ের ছবির সংজ্ঞার সঙ্গে খাপ খায়? হঠাৎ বিরিয়ানি থেকে মুখ ফিরিয়ে একটু অন্যরকম মনে হচ্ছে না ডিশটা?
“হা হা হা। এই বিরিয়ানি নিয়ে আমার তিনটে বক্তব্য আছে। বিরিয়ানি তো কত রকমই হয় হায়দরাবাদি বিরিয়ানি হয়, মোতি বিরিয়ানি হয়, আঔয়াধি বিরিয়ানি হয়। এত দিন এক রকম বিরিয়ানি খাওয়াচ্ছিলাম, এ বার এই ছবিটা হয়তো একটু অন্য রকম বিরিয়ানি। দ্বিতীয়ত, বেশি বিরিয়ানি খেলে কিন্তু পেট গরম হয়। আর তৃতীয়ত, যে ভাল বিরিয়ানি রাঁধতে পারে সে ভাল কন্টিনেন্টাল রাঁধতে পারবে না, এটা আপনাকে কে বলল!” ভুরুটা উঁচুতে তুলে ঠোটে এক টুকরো হাসি ঝুলিয়ে উত্তর দেন সৃজিত।
তা হলে এই ছবিতে আমরা অন্য এক সৃজিতকে দেখব? ভার্সন ২.০?
“দেখুন, আমি স্টিরিয়োটাইপে বিশ্বাস করি না। একজন পরিচালকের মধ্যে নানা সত্তা থাকতে পারে। এক একটা ছবিতে যেমন কৌশিকদা আলাদা, কমলদা আলাদা, অতনু ঘোষ আলাদা, সুমন ঘোষ আলাদা ঠিক তেমনই আমার মধ্যেও একটা আলাদা আমি আছি। এই আলাদা ‘আমি’ সত্তাটাকে এক্সপ্লোর করলে, তবেই একটা নতুন চ্যালেঞ্জ নেওয়া যায় পরিচালক হিসেবে। আমার কাছে এই ছবিটা আমার পার্সোনালিটির একটা অন্য দিক। দেখুন কে আমার ছবি বলতে কী ভাবল সেটার থেকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ আমি আমার ছবি নিয়ে কী ভাবলাম। দর্শকদের আশ্বস্ত করছি, এটাও কিন্তু ‘সৃজিত মুখোপাধ্যায় ফিল্ম’। যদি একটু অন্য রকম মনে হয় আপনাদের তা হলে সেটা ইচ্ছে করেই করা। ওটাও পার্ট অব দ্য ডিজাইন,” বলেন তিনি।
ইন্টারেস্টিং চরিত্র না হলে বুম্বাদা নয়
কিন্তু শুধু গান কেন, এই ছবিতে তো প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়ও নেই। ‘হেমলক সোসাইটি’-র পর আবার প্রসেনজিৎকে দেখা যাবে না সৃজিতের ছবিতে। কী হল হঠাৎ?
“দেখুন এই নিয়ে আমার কথা হয়েছে বুম্বাদার সঙ্গে। বুম্বাদা আর আমি দু’জনেই ঠিক করেছি এর পর বুম্বাদার সঙ্গে কাজ করলে আমাকে এমন একটা চরিত্র লিখতে হবে যেটা ‘কুশল হাজরা’র মতো বা ‘কুশল হাজরা’র থেকেও বেশি ইন্টারেস্টিং। আমি অবশ্য পরের বছর ‘কাকাবাবু’ করছি বুম্বাদার সঙ্গে। সেই ছবির রেশ ধরেই বলছি বুম্বাদার জন্য সব সময় একটা লার্জার দ্যান লাইফ বা সুপার ইন্টারেস্টিং চরিত্র হলে তবেই আমরা একসঙ্গে কাজ করব,” বলেন পরিচালক।
কিন্তু যে ‘জাতিস্মর’য়ের চারটে ন্যাশনাল অ্যাওয়ার্ডের দু’টো গানের জন্য, সেই পরিচালকের পরের ছবিতে গান নেই, সেটা দর্শক মেনে নেবে তো? “দেখুন, আমার ছবিতে গান তখনই এসেছে, যখন গানের দরকার পড়েছে। এই ছবিতে গানের সত্যিই প্রয়োজন নেই। এবং এটা টপিক অব ডিসকাশনও নয়। ঠিক যেমন ট্রলি শট হবে না জাম্প কাট, এগুলো যেমন আমরা সিনের প্রয়োজন অনুযায়ী ব্যবহার করি, আমার কাছে গানের ব্যবহারটা ঠিক ততটাই ন্যাচারাল,” বলেন সৃজিত।
যিশুর মাপের অভিনেতা কম আছে আমাদের ইন্ডাস্ট্রিতে
‘জাতিস্মর’-এর পর সৃজিতের সঙ্গে আবার কাজ করতে পেরে খুশি যিশু সেনগুপ্তও। অনেকেই মনে করেন যিশুকে বাংলা ছবিতে নতুন করে লাইফলাইন দিয়েছেন সৃজিত।
যিশু কী বলছেন?
“দেখুন, ঋতুপর্ণ ঘোষের পর সৃজিতই একমাত্র পরিচালক যে আমার পাশে দাঁড়িয়েছে। আই অ্যাম গ্রেটফুল টু হিম। আর ওকে ভুলব কী করে! আমাকে আনলাকি যিশু থেকে লাকি যিশুতে যে নিয়ে এল তার নাম তো সৃজিত মুখোপাধ্যায়,” সোজাসাপ্টা বলেন যিশু।
যিশুকে অবশ্য আরও বড় সার্টিফিকেট দিচ্ছেন পরিচালক স্বয়ং।
“আমার মনে হয় যিশু ইজ ওয়ান অফ আওয়ার ফাইনেস্ট অ্যাক্টর। ওর উপর আমার রাগও হয়। জীবনে অনেক ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কিন্তু ওর মাপের অভিনেতা খুব কম আছে আমাদের ইন্ডাস্ট্রিতে। আমি ‘আর একটি প্রেমের গল্প’ আর ‘চিত্রাঙ্গদা’তে ওর অভিনয় দেখেই ভেবেছিলাম, যিশুর সঙ্গে কাজ করতে হবে,” বলছেন পরিচালক।
অন্য দিকে ঋত্বিকের অভিনয়ের অসম্ভব ভক্ত সৃজিত। এবং এর আগে ‘শব্দ’তে সহ-অভিনেতা হিসেবে ‘তারক’য়ের সঙ্গে কাজ করলেও এই প্রথম পরিচালক হিসেবে কাজ করবেন ঋত্বিকের সঙ্গে।
এই মুহূর্তে দুলাল চন্দ্র ভড় ছাড়া কেউ নেই জীবনে
“হ্যাঁ, ঋত্বিকের আমি কো-অ্যাক্টর ছিলাম ‘শব্দ’তে। কিন্তু ডিরেক্টর হিসেবে এই প্রথম কাজ করব। ‘শব্দ’, ‘বাকিটা ব্যক্তিগত’তে ওর অভিনয় দেখে চমকে গিয়েছিলাম। ‘তিন পাত্তি’তেও ও দুর্দান্ত অভিনয় করেছিল। যে কোনও চরিত্রেই ঋত্বিক লিভস্ আ মার্ক।
এটা বড় অভিনেতার হলমার্ক। আমার ধারণা এই ছবিতেও দর্শক ওর অভিনয়ের ভূয়সী প্রশংসা করবেন,” বলেন সৃজিত।
কথা বলতে বলতে যা জানা গেল, তাতে এই ছবির ক্যামেরায় থাকবেন সৌমিক হালদার।
আর বোধাদিত্য বন্দ্যোপাধ্যায়? তাঁর সঙ্গে তো ঝামেলা হয়েছিল সৃজিতের। তিনি কি সম্পাদক হিসেবে এই ছবিতে থাকবেন?
“বোধা এই ছবিতে থাকতে পারবে কি না এখনও অবধি জানি না। সবাই এত ব্যস্ত...” মুচকি হেসে বলেন পরিচালক।
আড্ডা শেষ। এ বার কি তা হলে বাড়ি?
“হ্যাঁ, বাড়ি যাব। এই গরমে দুলাল চন্দ্র ভড় ছাড়া কেউ নেই আমার জীবনে,” হাসতে হাসতে কথা শেষ করেন সৃজিত।