আকাশ প্রদীপ জ্বলে
ফোনে আপনার গলা শুনলে আজও মনে হয় একুশ বছরের তরুণী। পঁচাশি ছুঁইছুঁইতেও নিজেকে একুশ রাখতে পারাটা তো ম্যাজিক! শিয়ার ম্যাজিক!
সবটাই ঈশ্বরের কৃপা। ওঁর আশীর্বাদ।
অনেকে বলে, মহাভারতে অর্জুন যেমন পাখির চোখ দেখেছিলেন তেমনই আপনি দীর্ঘ এত বছরেও লক্ষ্য থেকে মনকে সরাননি।
কাজটাকেই আসলে আমার ধ্যানজ্ঞান রেখেছি। তার বাইরে কোনও কিছুতে জড়াইনি। সেই ছোটবেলা থেকেই জীবনযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ি। জীবনে প্রথম যখন বাবার সঙ্গে মঞ্চে উঠি, আমার বয়স তখন নয়। ফিল্মে নামি তেরো বছর বয়সে। বহুত তকলিফ উঠায়ি হ্যয় ম্যয়নে। বাবার একটা নট্টকোম্পানি ছিল সেটা বন্ধ হয়ে যায়। তারপর আমরা চলে এলাম পুণে। তারপর বাবা মারা গেলেন। পয়সাও সংসারে দুষ্প্রাপ্য হয়ে পড়ল। কাজে মনপ্রাণ বসিয়ে দিতে হল। কিন্তু তাতে কখনও দুঃখ পাইনি। আমরা পরিবারের সবাই হাসিমুখেই থাকতাম। ঈশ্বরের বিশাল স্নেহধন্য আসলে আমি।
এত বছর ধরে আপনি টেনে যাচ্ছেন। বোধহয় সাত দশক হয়ে গেল। অথচ পরশু নতুন গান রেকর্ড করে এলেন। কোন ধাতু দিয়ে আপনি গড়া বলুন তো! প্লিজ উত্তরে ঈশ্বরের আশীর্বাদ বলবেন না।
(প্রাণখোলা হাসি) সত্যি তাই (আবার হাসি)।
কী খেয়ে বড় হয়েছেন যে এত দীর্ঘ সময় ধরে অক্লান্ত পথ হেঁটেই যাচ্ছেন?
মায়ের দুধ খেয়ে... (হাসি)।
অনেক ক্রীড়া-ভাষ্যকার আছেন যাঁরা গলা ঠিক রাখার জন্য নিয়মিত গার্গল করেন। আপনি, তর্কযোগ্যভাবে ভারতের সর্বকালের সেরা গায়িকা, কি তা হলে আজীবন গার্গলিং করে গিয়েছেন?
ধুর! মোটেও নিয়মিত গার্গল করি না। ঈশ্বর আমার প্রতি দয়ালু ছিলেন। বাবা-মায়ের অজস্র আশীর্বাদ ছিল আমার উপর। নইলে খুব চিন্তায় থাকতাম যে গলা না পাছে গড়বড় করে। আমি না লোককে ডুবিয়ে দিই। যাঁরা আমার উপর ভরসা রেখেছেন। সেটা ভীষণ গ্লানি আর লজ্জার হত।
রাজ সিংহ দুঙ্গারপুর আপনার খুব ঘনিষ্ঠ ছিলেন। উনি বলতেন, ‘লতা গলার ব্যাপারে এত পারফেকশনিস্ট যে ভালবাসলেও আইসক্রিম ছুঁয়ে দেখে না’।
আইসক্রিম যে একদম ছুঁয়ে দেখি না তা নয়। কখনও কখনও খাই। তবে ভরপেট খাওয়া বা আইসক্রিম— এগুলো গলায় সামান্য স্বস্তি এনে দেয়। রেকর্ডিংয়ের আগে একেবারে বর্জন করা উচিত। গলা থাকবে সতেজ, টগবগে। খাওয়াটা হবে গানের চাহিদা মেনে।
প্লে ব্যাক সিঙ্গিংয়ে আধুনিক সময়ে এক্সেলেন্সের পরম্পরাটা কেউ রাখতে পারছে না। তিন-চার বছরের বেশি টিকতে পারছে না কেন?
আমি তো বলব, ছ’মাসের বেশি কেউ টিকছে না। আমাদের সময়ে সবার নিজস্ব গায়কি ছিল। চোখ বুজে বলা যেত নৌসাদ বেগম গাইছে। আশা গাইছে। লতা গাইছে। এখন সব ক’টা গলা সমান। এক-একটা ছবিতে এখন চার-পাঁচজন করে মিউজিক দিচ্ছে। আগে শঙ্কর-জয়কিষনের মতো কেউ কেউ এমন সব গান তৈরি করতেন যা মুকেশকেই মানায়। মিউজিক ডিরেক্টররা প্রত্যেক শিল্পীর জন্য আলাদা করে ভাবনা-চিন্তা করতেন, কাকে কোন গানটা মানাবে? এখন সেই সব কেউ ভেবেও দেখে না। লাভ সংস্-রোম্যান্টিক নাম্বার উঠেই গিয়েছে প্রায়। সবাই জোরে জোরে গাইছে। প্রায় সব গানই এখন আইটেম নাম্বার। একশো ছবি হলে একটা-দু’টোর বেশি গান কারও মনে থাকছে না। সোলটাই থাকছে না গানের মধ্যে যে গিয়ে ধাক্কা মারবে ভেতরে। মোচড় দেবে। গানের আত্মা গিয়ে হার্টকে ছুঁয়ে আপনার সঙ্গে থেকে যাবে।
এখন যাঁরা গাইছেন তাঁদের কাউকে আপনার ভাল লাগে না?
তা কেন! শ্রেয়া ভাল গায়। সুনিধি ভাল। সোনু ভাল। এদের কাজ আমার পছন্দ।
তা হলে এই অবস্থা তৈরি কেন?
কারণ তেমন ভাল মিউজিক ডিরেক্টরদের অভাব। আমরা সে দিক দিয়ে অনেক লাকি। কী কী সব মিউজিক ডিরেক্টর পেয়েছি আমরা! এসডি বর্মন, আরডি বর্মন, সলিলদা, মদনমোহন, খৈয়ম, হেমন্তদা, লক্ষ্মীকান্ত পিয়ারিলাল, কল্যাণজি-আনন্দজি... কত নাম বলব। এই মিউজিক ডিরেক্টররা প্রত্যেকের জন্য আলাদা আলাদা ভাবে ভাবতেন। তাঁদের জন্য গান তৈরি করতেন। আমাদের ডেকে বোঝাতেন। সেই পথনির্দেশটা খুব জরুরি। আমাকেই তো সিনিয়র মিউজিক ডিরেক্টররা কত পরামর্শ দিয়েছেন যে তুমি অমুকটা করো, এভাবে গানটা ভাবো। এ ভাবে ফিল আনো। গানের মধ্যে এ ভাবে দৃশ্যটা কল্পনা করে অ্যাক্টিং আনো। সেই সব পরামর্শের উপর ভিত্তি করে তবেই না আমি গানটা গেয়েছি।
শুধু এটাই কারণ?
এটা বড় কারণ নিশ্চয়ই। আবার এটাও অস্বীকার করা যাবে না যে, গায়কদের কী অসম্ভব কোয়ালিটি ছিল সে সময়! কিশোরদার কথা ভাবুন। জীবনে কখনও রেওয়াজ করেনি। অথচ কী গলা! যখন ডুয়েট গাইতাম এক এক সময় স্তম্ভিত হয়ে ভাবতাম, আহা, একেই বুঝি গান বলে!
তসবির তেরি দিলমে
সচিন তেন্ডুলকর। অমিতাভ বচ্চন। আর আপনি। ভারতীয় সমাজজীবনে ত্রয়ীকে সব সময় আলাদা দাঁড়িপাল্লায় মাপা হয়। এঁরা যেন উত্তুঙ্গ, অভিজাত এক শ্রেণি। কী ‘কমন’ আপনাদের তিন জনের মধ্যে?
হমলোগ বহুত সিম্পল, ন্যাচারাল আদমি হ্যায়। হমলোগ কভি বদলে নহি।
ব্যাখ্যা করবেন?
আমরা তিন জনই ছোটবেলা থেকে প্রচুর কষ্ট করে ধাপেধাপে চড়াই বেয়ে উঠেছি। যাঁরা অনেক কষ্ট করে, সহস্র বাধাবিঘ্ন কাটিয়ে তাঁর মঞ্জিলে পৌঁছয়, তাঁরা বদলায় না। আমরা তিন জনই একেবারে মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে উঠেছি। চড়াই বেয়ে উঠেও আমাদের সংস্কার আর অনুশাসনগুলোকে বিচ্ছিন্ন হতে দিইনি। অনেককে দেখেছি একটু বড় হলেই তাদের মাথা ঘুরে যায়। আর মানুষকে মানুষ বলে গণ্য করে না। খাটাখাটনি ছেড়ে দেয়। অমিতাভ কখনও সেটা করেননি। খুব ভেবেচিন্তে ব্যালান্স রেখে কথা বলেন উনি। আমি কখনও অমিতাভকে দেখিনি উদ্বাহু হয়ে নাচতে। বা নিয়মিত পার্টি করছেন বাইরে গিয়ে। ডিস্কো যাচ্ছেন। সচিনও তাই। কখনও সচিনকে দেখেছেন চিৎকার করতে? ম্যঁয় সচিন হুঁ?
কোনও দিন দেখবেন না। আমাদের মন্ত্রটাই হল যত উঁচু শৃঙ্গতেই পৌঁছাও না কেন, নিজের স্বাভাবিকত্ব হারিয়ো না। আমার ঘর থেকে আমি এই শিক্ষাই বারবার পেয়েছি। আমার বাবা-মা তাই শিখিয়েছেন যে তোমার জীবনে চার পাশে যাই ঘটে চলুক, নিজের কর্তব্য থেকে বিচ্যুত হোয়ো না।
সচিনকে সব সময় দেখা যায় আপনার কথা বলতে। সচিন বোধহয় আপনাকে ‘মা’ ডাকেন।
হ্যাঁ (প্রচণ্ড হাসি) সচিন আমার ভীষণ প্রিয়। রিটায়ার করার কিছু দিন আগে ও আমার বাড়িতে এসেছিল। আমি বললাম এটা কী করতে যাচ্ছেন আপনি? আপনি মাঠ থেকে চলে যাবেন শুনে তো আমারই মন খারাপ হয়ে যাচ্ছে। তখন ও বসে বোঝাল, মা আমার হাতে চোট রয়েছে। এমনিতেই হাতটা একটু কমজোর হয়ে আছে। এর পর আবার লাগলে এমনিতেই খেলতে পারব না। তাই সরে যাচ্ছি।
শুনে আপনি কী বললেন?
তখন আর কী বলার থাকতে পারে। চোট থাকলে আর কী করা যাবে। আমি অবশ্য বলেছিলাম, আপ অভি গল্ফ শুরু করিয়ে (হাসি)।
বিষেণ বেদীর মুখে শোনা, জীবনের শেষ টেস্ট খেলছেন মুম্বইতে। ক্যাপ্টেন সেদিন ওঁকে বেশি বল করাননি। হতাশ, বিষণ্ণ সর্দার হোটেলের ঘরে একা বসে আছেন। হঠাৎ ফোন বাজল। উনি ‘হ্যালো’ বলার পর ও প্রান্তের কণ্ঠস্বর বলল, আমি লতা মঙ্গেশকর। মন খারাপ করবেন না। খারাপ দিন মাঝেমধ্যে আসেই। বেদীর তখন মনে হয়েছিল মুহূর্তে দুনিয়া আবার ঝলমলে হয়ে গেল। আজও ঘটনাটা ভুলতে পারেন না।
কবেকার কথা এটা বলুন তো?
অনেক আগেকার। ১৯৭৮-৭৯। কিন্তু বেদীর কাছে এ বছর শোনা।
হ্যাঁ, আমি করে থাকতেই পারি। ক্রিকেট সবসময় আমার খুব প্রিয়।
কিন্তু সচিন অবসর নেওয়ার পর নিশ্চয়ই খেলা দেখা ছেড়ে দিয়েছেন?
কে বলল? না তো!
তাহলে শুধু টেস্ট ক্রিকেট?
আরে না না। আমি টেস্ট দেখি। ওয়ান ডে দেখি। টি টোয়েন্টিও দেখি (সলজ্জ হাসি)। আমার তো ধোনিকে দারুণ লাগে। সব সময়ই ও কিছু না কিছু পারফর্ম করে দেয়। কোহলি ছেলেটাকেও খুব ভাল লাগে। কিন্তু ধোনির মধ্যে একটা স্টাইল আছে যেটা আমায় টানে। অদ্ভুত শান্ত একটা ব্যাপার আছে। ও মনে হয় প্রকৃতিগতভাবে এ রকমই। হয়তো সব সময় ওর টিম ভাল খেলে না। কিন্তু সে তো জীবনে হতেই পারে। ধোনির যা ভাগ্যের জোর, তাতে আমার মনে হয় ওকেই ক্যাপ্টেন রেখে দেওয়া উচিত। সৌরভকেও আমার দারুণ লাগত। ওর বৌয়ের একটা নাচের স্কুল আছে। নামটা মনে পড়ছে না। তবে সৌরভ ইনভাইট করায় আমি কলকাতায় এসেছিলাম। আমার বারবারই মনে হয়েছে, কেন যে ও এত তাড়াতাড়ি খেলা ছেড়ে দিল কে জানে!
আসলে আমাদের দেশের একটা অদ্ভুত জিনিস হল যে দু’একটা ম্যাচ খেলতে না পারলেই পাবলিক আওয়াজ তোলে বসাও বসাও। এটা বড় প্লেয়ারদের খুব মনে লাগে। সচিনের বেলাতেও কোরাসটা উঠে গিয়েছিল। এটা খুব দুর্ভাগ্যজনক।
তেরে বিনা জিন্দেগি
বোধহয় জানেন বেশ কয়েক মাস আগে সুচিত্রা সেন মারা গিয়েছেন?
হ্যাঁ, নিউজে দেখেছি।
ওঁর বাড়িতে শ্রাদ্ধের অনুষ্ঠানে দু’টো গান বাজছিল। একটা সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের। একটা আপনার ‘আঁধি’ ছবির।
আঁধির কোন গানটা ছিল যেন?
তেরে বিনা জিন্দেগি...
ওহ্হ! সুচিত্রার দারুণ স্ক্রিন প্রেজেন্স ছিল। উনি কয়েকটা হিন্দি ছবিতে কাজও করেছিলেন। তার একটায় ওঁর লিপে আমার গান ছিল। উনি রেকর্ডিংয়ের সময় এসেছিলেন যাতে লিপ দিতে সুবিধে হয়। আমি গিয়ে নিজেই বলি যে আমি আপনার খুব বড় ভক্ত। উনি বলেছিলেন কী যে বলেন, আমি হলাম গিয়ে আপনার বড় ফ্যান। খুব হাসিঠাট্টা হয়েছিল দু’জনে।
আপনি কোন ছবি দেখে সুচিত্রার ভক্ত হলেন? হিন্দি দেবদাস?
না, না। বাংলায় কত ছবি আমি ওঁর দেখেছি। উত্তম-সুচিত্রার। উত্তমকুমারকেও আমার দারুণ লাগত। কী ক্যারিশমা!
সে যুগে কি ওঁদের ছবিগুলোর সব সাব টাইটেল হত?
সাব টাইটেল কেন হবে! নির্ভেজাল বাংলা। আমি তো খুব ভাল বাংলা বুঝি। তখন বলতেও পারতাম। এই বয়সে এসে একটা ভয় এসে গিয়েছে। যদি কোথাও আটকে যায়। তখনকার দিনের বেঙ্গলিরা সব তো আমার সঙ্গে বাংলাতেই কথা বলতেন। হেমন্তদা, সলিলদা, মান্নাদা। মান্নাদা চলে গেলেন কিছু মাস আগে। ওঁর মেয়েকে আমি ফোন করেছিলাম যখন মান্নাদা হসপিটালে। মান্নাদার সঙ্গে আমার দেখা অনেক কম হয়েছে। কখনও হেমন্তদার মতো নিয়মিত আড্ডা হয়নি। কিন্তু আমি ওঁকে সম্মান করতাম। এত অসুস্থতার মধ্যে মারা যাওয়াটা খুব দুঃখজনক। সলিলদাও অনেক পরে জেনেছি যে অর্থকষ্ট আর চূড়ান্ত অসুস্থতার মধ্যে জীবন শেষ করেছিলেন। পরে খুব আফসোস হয়েছিল আমি এত কাছের হয়েও কিছুই করতে পারলাম না বলে। আসলে সলিলদা ১৯৯৫-তে মারা যান। সে বছরই আমার মা মারা গিয়েছিলেন। তাই আমার আর অন্য কিছুতে মন ছিল না। এ বারে পুজোয় বাংলা যে অ্যালবাম করেছি, সেটা এ জন্যই সলিলদাকে আমার ট্রিবিউট।
মানুষগুলো এক এক করে চলে গিয়েছে ভাবতেই কেমন লাগে। কী আমুদে, হাসিখুশি যে ছিলেন ওঁরা এক এক জন।
হেমন্তদা তো দরজা থেকেই চিৎকার করতে করতে ঢুকতেন এই লতা, লতা। হেমন্তদার শেষজীবনটাও ভাল কাটেনি শুনে আজও আমার খারাপ লাগে। কিশোরদাকে ভুলতে পারি না। প্রচণ্ড হাসাতেন। হৃষীদা মজা করতেন। সব বাংলায়। আমি যে ওখানে আছি অন্য ভাষার একটা লোক, সে সব কেউ পাত্তাও দিত না। হেমন্তদা আর কিশোরদা— দু’জনে ই ছিলেন আমার রাখিভাইয়া।
সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে নিশ্চয়ই আলাপ ছিল?
আরে, সন্ধ্যা তো আমার সহেলি। কী সব গান গেয়েছে! আমরা হিন্দিতে ডুয়েটও গেয়েছি। কলকাতায় গেলে আমি ওর বাড়িতে গিয়েছি। সন্ধ্যা মুম্বই এলে, ওর হোটেলে গিয়েছি আড্ডা মারতে।
ফুলো কা তারো কা
গায়িকা আশা ভোঁসলে সম্পর্কে লতা মঙ্গেশকরের মূল্যায়ন কী?
লতা ও নিকটজন ময়ূরেশ পাই
(একটু ভেবে নিয়ে) আশা খুব ভার্সেটাইল। ও যেসব গান গেয়েছে। আরডি আর ও একসঙ্গে যে সব গান তৈরি করেছে যার তুলনা নেই। ওই যে গানটা ‘আজা আজা, ম্যায় হু প্যার তেরা’— একমাত্র আশাই গাইতে পারে। ওর প্রচুর নাম দেশেবিদেশে। এখনও কী অসম্ভব এনার্জি! কাল মুম্বইতে তিন ঘণ্টা ফাংশন করে সকালের ফ্লাইটে চলে গেল কলকাতার ক্যাসেট রিলিজ ফাংশনে। আবার হয়তো পরের দিন ভোরে ফিরবে। ফিরে আবার গাইবে অন্য কোথাও।
রাজ সিংহ একবার আপনার সঙ্গে আশাজির তুলনার কথা কোনও লেখায় পড়ে খুব উত্তেজিত ভাবে চেঁচিয়ে বলেছিলেন, কান খুলে শুনে রাখুন, লতা হল সঙ্গীতের ব্র্যাডম্যান। বাকিরা যে যা করছে, সব তার পরে। আশাজির সঙ্গে আপনার তুলনাটা কি অনুচিত বলে আপনি মনে করেন?
(একটু ভেবে) এই যে আমার সম্পর্কে আপনি বলছেন এই কথাগুলো— কী মানুষের মনোভাব, তো আমি তৈরি করিনি। আমি গান ছাড়া বলতে গেলে আর কিছুই করিনি। গানই আমার প্রেম। গানই আমার সাধনা। আমাকে যা বানিয়েছেন সবই ঈশ্বর আর আমার মিউজিক ডিরেক্টরদের মূল্যবান সব পরামর্শ। এর বাইরে কিছু আমি বলতে পারব না।
আশাজিকে আপনি তো সম্মানিত করলেন সে দিন। নেটে সেই দুর্লভ ছবিটা রয়েছে।
হুঁ।
নাম গুম যায়েগা
প্রায় পঁচাশিতে বসে এই যে দেখতে হচ্ছে এত প্রিয়জন জীবন থেকে হারিয়ে যাচ্ছে, সেই অনুভূতিগুলো কতটা দুঃখ দেয়?
সীমাহীন দুঃখ দেয়। আমি তো একা বসে বসে ভাবি যে কিশোরদা নেই। মুকেশ ভাইয়া চলে গেছেন। মহম্মদ রফি নেই। এক-একটা কী গভীর ব্যক্তিগত ক্ষতি! কী কী সব রঙের শিল্পী এঁরা! কিশোরদাকে তো আমি ভুলতে পারি না। এমন হাসাবেন, এমন সব চুটকি বলবেন যে আপনি হেসে গড়িয়ে পড়তে বাধ্য। আমি তো রীতিমতো শাসাতাম, কিশোরদা রেকর্ডিংয়ের আগে এত ইয়ার্কি ফাজলামি চলবে না। সব পরে। নইলে হাসতে হাসতে আমার গলা বসে যাবে।
কিশোরকুমার মারা যাওয়ার দিন আপনি কোথায় ছিলেন? কোনও ছবিটবি তো দেখিনি...
আমি সেদিন সবে ম্যাড্রাস থেকে এসে মুম্বই এয়ারপোর্টে পা রেখেছি। আমারই একটা বহু দিনের বিশ্বস্ত ছেলে এসে বলল এই ব্যাপার। কিশোরদা আর নেই। এমনিতে আমাকে বাইরে থেকে যত টাফ মনে হোক না কেন, ভেতরে ভেতরে আমি খুব নরম। ডাক্তার আমায় বারণও করে রেখেছেন বহু বছর যে, আপনি একদম ডেডবডির কাছে যাবেন না। মৃতের বাড়ি তখনই তখনই যাবেন না। শরীরে খুব খারাপ এফেক্ট হবে। নিজের মা মারা যাওয়ার পরেও পায়ের কাছে বসে কেঁদেছি। মুখের দিকে ভয়ে তাকাইনি। কিন্তু কিশোরদার জুহুর বাড়িতে না গিয়ে পারিনি। গিয়ে দেখি সবাই গোল হয়ে বসে কাঁদছে। আর বলছে বডি মধ্যপ্রদেশে ওর আদি বাড়িতে নিয়ে যাবে।
খান্ডওয়াতে?
হ্যাঁ। খান্ডওয়াতে। যাই হোক, তার পর আমি তো ভীষণ মনখারাপ করে কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি ফিরে অসুস্থই হয়ে পড়লাম। ডাক্তার এসে দেখে আমার প্রেশারের ওপরেরটা ৩০০। নীচেরটা ১০০ ছাড়িয়ে গিয়েছে।
তার পর আর মৃতের বাড়ি যান না?
একটু ‘অ্যাভয়েড’ করি। আসলে আমার এই প্রবণতাটা শুরু আমাদেরই খুব কাছের এক সুরকার মারা যাওয়ার সময় থেকে। আমাকে ওঁর মৃতদেহের কাছে জোর করে টেনে নিয়ে গিয়েছিল মধুবালা। এসে বলল চলো, চলো। সেদিন থেকে এটা শুরু হল। চোখের সামনে মৃত্যু দেখলেই আমার প্রেশার বেড়ে যায়। তখনই ডাক্তার সাফ বলে দিলেন বাড়ি বসে দুঃখ করুন। মৃতদেহের কাছে যাবেন না।
রাজ কপূর মারা যাওয়ার পর তাই ওঁর এত প্রিয় হয়েও যাননি!
রাজসাব মারা যাওয়ার সময় আমি লন্ডনে ছিলাম। একটা শো করে নামার পর খবরটা পাই। ২ জুন ছিল ডেট-টা। এত বড় ‘শক’ যে আজও তারিখটা ভুলতে পারিনি।
শোনা যায় রাজের এক রকম রোম্যান্স ছিল আপনার গলার সঙ্গে। ‘সত্যম শিবম সুন্দরম’ নাকি আপনাকে নিয়েই গল্প!
না না। আমাকে নিয়ে গল্প নয়। তবে আমাকে ‘মেন’ চরিত্রে অভিনয় করার অফার দেওয়া হয়েছিল। আমি বলেছি, না বাবা, অ্যাক্টিংফ্যাক্টিং আমার দ্বারা হবে না।
কেন? সেই তেরো বছর বয়সেই তো আপনি মরাঠি কিছু ফিল্মে অভিনয় করেছিলেন।
করেছিলাম ঠিকই। কিন্তু সেটা পেটের দায়ে। তখন পরিবার চালানোর দায় ছিল। কাজটা কখনও ভালবাসিনি। এই মেক আপ করো। লাইট নাও। জোনের মধ্যে থাকো। এগুলো আমার অসহ্য লাগত।
রোলগুলো কেমন থাকত?
ওই তো কখনও নায়কের বোন। কখনও নায়িকার বোন (হাসি)। মরাঠি ফিল্মে তখন একজন জনপ্রিয় নায়িকা ছিলেন স্নেহপ্রভা প্রধান। আমি ওঁর বোনের রোল করেছিলাম একবার। আপনাকে বলতে বলতে মনে পড়ে গেল ভি শান্তারামও আমায় ফিল্ম করার অফার দিয়েছিলেন। আমি পত্রপাঠ না বলে দিই।
একই কারণ।
হ্যাঁ । কোনও কিছুতেই আমি নিজে যে কাজটা করি, সেটাকে আঁকড়ে থাকা থেকে সরতে চাইনি। আমাকে তো হৃষীকেশ মুখার্জি বলেছিলেন ‘আনন্দ’-এ মিউজিক ডিরেকশন করতে। আমি রাজি হইনি।
সেটা কেন ছাড়লেন?
ছাড়লাম কারণ মিউজিক ডিরেকশনে অনেক ঝামেলার ব্যাপার ছিল। এমনিতেই তখন আমি এত ওভারওয়ার্কড। নিয়মিত গেয়ে চলেছি। রোববারও ছুটি নেই। তার মধ্যে ডিরেকশন দেওয়া মানে আরও উটকো প্রেশার। যে গান লিখছে, তাকে নিয়ে বোসো। শিল্পীদের নিয়ে বোসো। একে শোনাও। ওকে শোনাও। টিউন তৈরি করো। অ্যাসিস্টেন্ট মিউজিক ডিরেক্টরের সঙ্গে সিটিং করো।
২৮ বছর পর আবার পুজোতে আপনার বাংলা গান গাওয়াটা রীতিমতো চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছে। কেউ ভাবেইনি হঠাৎ করে এত বছর বাদে আপনি পুজোয় গান করবেন।
পুজোতে আসলে প্রতিবছর আমি সলিলদার জন্য গাইতাম। তার পর মাঝখানে একটা সময় গান বন্ধ করে দিই। আমি তো হেমন্তদার জন্য গেয়েছি। বাপি লাহিড়ির জন্য গেয়েছি। তবে সলিলদার সঙ্গে বাংলা গান করার সেই সময় একটা আলাদা রোমাঞ্চ ছিল। আমার এখনও মনে পড়ে বিমল রায় আমায় স্টুডিয়োয় ডাকলেন। সেই সময় সলিলদাকে উনি কলকাতা
নিয়ে এসেছেন। সলিলদার গানের নিজস্ব গ্রুপ ছিল। তখন ‘দো বিঘা জমিন’ তৈরি হচ্ছে। সলিলদার গলায় সেই প্রথম শুনলাম ‘পাল্কি চলে’ আর ‘রানার’। একদিন বললেন, ‘লতা, আন্ধেরির বাড়িতে এসো।’ গেলাম। বৌদি ছিলেন। মেয়ে তখন অনেক ছোট। ও ছিল। বললেন, ‘তুমি আমার জন্য বাংলায় গাইবে?’ আমি রাজি। ওঁর সুরে রেকর্ড করলাম। ‘সাত ভাই চম্পা’ আর ‘না যেয়ো না’। দুটোই সুপারহিট হয়ে গেল। আমাদের পার্টনারশিপের সেই শুরু।
রহে না রহে হাম
একটা কথা বলুন। আপনি যে বয়সে এসে পৌঁছেছেন, তাতে লোকে একলা অনেক কিছু বসে বসে ভাবে। একটা অনিবার্য চিন্তা আপনার পর্যায়ের উত্তুঙ্গ সাফল্য পাওয়া মানুষের মনে আসে যে ভাবী কাল আমাকে কী ভাবে দেখবে? কী চোখে মনে রাখবে? লতাজি, আনন্দplus-এর পক্ষ থেকে জিজ্ঞেস করছি আপনি কী চান, কী ভাবে আপনাকে মানুষ মনে রাখুক?
এই রে! আমি এই সব বলতে পারব না।
কেন?
আমাকে কী ভাবে মনে রাখবে আমি কী করে বলব? সেটা তো আপনারা বলবেন। জনতা বলবে (হাসি)।
ঠিক আছে। তা হলে আপনার গাওয়া এমন কোনও গানের কথা বলুন যা আপনাকে সবচেয়ে ভাল ব্যাখ্যা করবে!
আমার নিজের গান?
হ্যাঁ আপনার গান!
তা হলে বোধহয় বলতে হয় মীরার কিছু ভজনের কথা যা আমি রেকর্ড করেছিলাম আমার ভাই হৃদয়নাথ মঙ্গেশকরের জন্য। মীরার জীবন নিয়ে সেই ভজনগুলো লেখা। আমার তখন জ্বর ছিল মনে পড়ছে। তার মধ্যেও রেকর্ডিং করেছিলাম। বোধহয় ১৯৭৩ হবে সালটা।
মীরার সেই আর্তিতে আপনাকে খুঁজে পাওয়া যাবে?
ওই গানগুলোতে আমাকে পাওয়া যাবে।
মীরার জীবনের সঙ্গে কি নিজের মিল পান?
মীরা একজন এত বড় সাধিকা, ঈশ্বরতুল্য। তাঁর সঙ্গে নিজের মিল কী করে বলি (সলজ্জ হাসি)? আমি তো সাধারণ একজন নারী।