আব কি বার... কুমার

টেস্ট ও ওয়ান ডে মিলিয়ে পঁচিশ হাজারেরও বেশি রান। এগারোটা ডাবল সেঞ্চুরি। কিন্তু আজও তিনি কাব্যে উপেক্ষিত। সময় এসেছে কুমার সঙ্গকারা-কে যোগ্য সম্মান জানানোর। আনন্দplus-এর জন্য এক্সক্লুসিভলি লিখছেন শিল্ড বেরিটেস্ট ও ওয়ান ডে মিলিয়ে পঁচিশ হাজারেরও বেশি রান। এগারোটা ডাবল সেঞ্চুরি। কিন্তু আজও তিনি কাব্যে উপেক্ষিত। সময় এসেছে কুমার সঙ্গকারা-কে যোগ্য সম্মান জানানোর। আনন্দplus-এর জন্য এক্সক্লুসিভলি লিখছেন শিল্ড বেরি

Advertisement
শেষ আপডেট: ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ ০০:০১
Share:

কাল থেকে বিশ্বকাপ শুরু। অনেকে অনেককে নিয়ে লিখেছে, কিন্তু আমার মনে হয় এই বিশ্বকাপে একজনের ব্যাপারে আলাদা করে না লিখলে ক্রিকেট লিখিয়ে হিসেবে আমি আমার কাজের প্রতি সুবিচার করব না।

Advertisement

হ্যাঁ, এ বার কিন্তু সময় এসে গেছে একজনের যোগ্য সম্মান পাওয়ার।

কুমার সঙ্গকারা। বহু দিন ধরে ওকে সচিন তেন্ডুলকর, জাক কালিস, রিকি পন্টিং, ব্রায়ান লারার ছায়ায় বাঁচতে হয়েছে। ঠিক যেমন শ্রীলঙ্কাকে ঢাকা পড়তে হয়েছিল ভারতের ছায়ায়। কিন্তু নিজের সমসাময়িকদের পিছনে ফেলে দিয়েছে সঙ্গকারা। মর্যাদা এখন ওর প্রাপ্য। নিজের সমসাময়িকদের থেকে। আন্তর্জাতিক মিডিয়ার থেকে।

Advertisement

সঙ্গকারার কৃতিত্বকে কী ভাবে ব্যাখ্যা করব?

এক) বলব, ও শ্রীলঙ্কার সর্বকালের সেরা ব্যাটসম্যান। অতীতের কেউ কেউ সীতারামের সিল্কের মতো মসৃণ স্ট্রোকপ্লের কথা ভাবলে দীর্ঘশ্বাস ফেলবেন। অরবিন্দ ডি’সিলভা আবার নিজের সতীর্থদের দেখিয়েছিল টেস্টে কী ভাবে ব্যাটিংটা করতে হয়। মাহেলা জয়বর্ধনে সংখ্যার দিক দিয়ে সমস্ত ফর্ম্যাটে সঙ্গকারার খুব কাছাকাছি। কিন্তু গোটা বিশ্ব জুড়ে সঙ্গকারার সাফল্য এত বেশি যে ওকে এক নম্বরে রাখতেই হবে।

দুই) এশিয়ার আজ পর্যন্ত সেরা বাঁ হাতি ব্যাটসম্যান। সনৎ জয়সূর্য আর সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় দাবি করতে পারে যে, ওয়ান ডে ক্রিকেটে তাদের প্রভাব অনেক বেশি। কিন্তু সমস্ত ফর্ম্যাট ধরলে সঙ্গকারাই এক নম্বর।

তিন) উইকেটকিপার ব্যাটসম্যান হিসেবে সঙ্গকারার আসন অ্যাডাম গিলক্রিস্টের ঠিক পরেই। ক্রিকেটের সমস্ত ফর্ম্যাট ধরেই বলছি। টি-টোয়েন্টি ও ওয়ান ডে-তে এমএস ধোনির প্রভার বিশাল হলে কী হবে, সব ধরনের ক্রিকেটে সঙ্গকারার রেকর্ড তো উপেক্ষা করা যায় না। এটা সত্যি যে ওর কেরিয়ারের গোড়ার দিকে কিপিং করার সময় ওর ব্যাটিং গড় চল্লিশ ছিল। কিন্তু ওর বেশির ভাগ শিকার এসেছে ওয়ান ডে থেকে। আর এটা এমন একটা পরিসংখ্যান যে, এখানেই যাবতীয় তর্ক-বিতর্ক শেষ হয়ে যায়।

গত বছর তাড়াহুড়োয় যে ওয়ান ডে সিরিজটা ভারতে হল, তাতে যে সঙ্গকারা মোটেও ভাল কিপিং করেনি সেটা ভারতীয় সমর্থকদের ভোলার কথা নয়।

কয়েকটা খোঁচা ওর গ্লাভসে ধাক্কা লেগে বেরিয়ে গিয়েছে। গোলকিপারদের যেটা করতে দেখা যায়। কিন্তু এটাও মাথায় রাখতে হবে সঙ্গকারা তখন ঠিকমতো প্রস্তুত ছিল না। যে প্রস্তুতিটা ওর ক্রিকেটের সারমর্ম। শ্রীলঙ্কায় ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে ওর সিরিজটা ভাবুন। উইকেটের পিছনে সঙ্গকারাকে তখন মারাত্মক দেখিয়েছিল। যেন ইলেকট্রিক ইল! সাঁইত্রিশ বছরের কারও কথা ছেড়ে দিন, যে কোনও বয়সের কিপারের কাছেই ওটা দুর্ধর্ষ পারফরম্যান্স।

সঙ্গকারা কী করে এমন শ্রেষ্ঠত্বের চুড়োয় পৌঁছল? শুধু পরিশ্রম আর খাটুনি দিয়ে। এটা ঠিক যে, বল গেমের প্রয়োজনীয় প্রতিভা নিয়ে ও জন্মেছে। ওর বোন শ্রীলঙ্কার সেরা মহিলা টেনিস প্লেয়ার। কিন্তু সব মাথায় রেখেও বলতে হবে, প্র্যাকটিসের উঁচু মান আর ঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতাই ওকে এই জায়গায় পৌঁছে দিয়েছে। সঙ্গকারার প্রতিভাকে এক ভাবেই ব্যাখ্যা করা যায়। ও এমন একজন যে এসেছে কষ্ট সহ্য করার অসীম ক্ষমতা নিয়ে।

একটা উদাহরণ দিচ্ছি। সঙ্গকারা বরাবর চাইত, লর্ডসে একটা সেঞ্চুরি থাকুক। যা লারা, পন্টিং, কালিস বা সচিনের মতো ওর সমসাময়িকদের কারও নেই। তো সঙ্গকারা পুরোপুরি ওটার মধ্যে ঢুকে গেল। মানে, ওই লক্ষ্যটার মধ্যে। আর লক্ষ্য ছুঁয়েও দেখাল। ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে দু’টেস্টের সিরিজ খেলার আগে ডারহামে খেলতে চলে গিয়েছিল সঙ্গকারা। নিজেকে তৈরি করতে।

ওর মহানুভবতাই বলতে হবে, ডারবান পৌঁছে আমাকে একটা একান্ত সাক্ষাৎকার দিয়েছিল। দেখেছিলাম, নিজের স্ত্রী, যমজ সন্তান কাউকে সঙ্গে আনেনি ও। কারণ ও চেয়েছিল হাতে যে কাজটা আছে, তার মধ্যে পুরোপুরি ডুবে যেতে। মনটাকে ও একমুখী রাখতে পারে, কিন্তু বাড়াবাড়ি রকম নয়। ও বড় ক্রিকেটার, বড় মানুষ। বুদ্ধিমান ক্রিকেটার, বুদ্ধিমান মানুষ। যার ক্রিকেট স্পিরিট নিয়ে লর্ডসে দেওয়া বক্তৃতাটা ক্রিকেট নিয়ে লেকচারের মধ্যে সেরা। ও আমাকে সাক্ষাৎকারে বলেছিল যে, টেস্টে ব্যাটিং গড়টা ৬০-এ নিয়ে যেতে চায়। যেটা ওকে ডন ব্র্যাডম্যানের পরের জায়গায় বসিয়ে দেবে। কারণ ও মনে করে ব্যাটসম্যান যদি টার্গেট সামনে ঝোলানোর বদলে মনের মধ্যে নিয়ে ঘোরে, তা হলে ব্যাটসম্যানের তাতে ভালই হয়।

ডারহামে বল খুব সিম করে। ইয়র্কশায়ারের বিরুদ্ধে চ্যাম্পিয়নশিপ ম্যাচে খুব একটা ভাল ব্যাট করতে পারল না ও। কিন্তু সাসেক্সে গিয়ে বড় সেঞ্চুরি করল। লর্ডসে ওর প্রথম টেস্টে ১৪৭ করার আগে ওকে দেখে একবারও মনে হয়নি আউট হতে পারে বলে। আর মনে রাখতে হবে পরিস্থিতির বিচারে ওই রানগুলোর মূল্য মারাত্মক ছিল। কারণ তার আগে জো রুট ডাবল সেঞ্চুরি করে দিয়েছে। ইংল্যান্ডও তুলেছে ৫৭৫। ন’উইকেট পড়ে যাওয়ার পর সঙ্গকারার ওই সেঞ্চুরি ছাড়া টেস্ট বাঁচাতে পারত না শ্রীলঙ্কা। পরের টেস্টে ওর দু’টো হাফসেঞ্চুরি শ্রীলঙ্কাকে দ্বিতীয় টেস্টে জিতিয়ে দিল, তার পর হেডিংলেতে সিরিজটাও ওরা জিতল।

কোন ফর্মুলায় ও সাফল্য পায়, সেটাও বলেছে সঙ্গকারা। প্র্যাকটিসে প্রস্তুতির জন্য যা যা করা দরকার, ও সবই করে। তার পর মাঠে নেমে পরিস্থিতি যেটা চায়, সেই অনুযায়ী রিঅ্যাক্ট করে। অর্থাৎ, ও আগে ঠিক করে ম্যাচে নেমে কোন কোন শট খেলবে। নেটে সেগুলো ঝালিয়ে নেয়। তার পর মাঠে নেমে সেগুলো খেলে। করতে পারলে কাজটা খুবই সহজ। একমাত্র যে বলটা ও মনে মনে খেলে রাখেনি, তার সামনে পড়লেই সমস্যায় পড়ে। ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে গত বছর ওয়ান ডে সিরিজে ও আউট হয়েছিল ফুলটস আর স্টাম্পের বেশ বাইরে শর্ট ডেলিভারিতে।

প্রশ্ন হচ্ছে, জীবনের শেষ ওয়ান ডে টুর্নামেন্টে সঙ্গকারা কি বিশ্বকাপ জয়ের দিকে টিমকে চালিয়ে নিয়ে যাবে? ও কি পারবে ডন ব্র্যাডম্যানের বারোটি টেস্ট ডাবল সেঞ্চুরির রেকর্ড ছুঁতে? প্রথমটা পারবে কি না, তা নিয়ে আমার সন্দেহ আছে। লাসিথ মালিঙ্গাকে যদি না পাওয়া যায়, তা হলে ওদের বোলিং আর ফিল্ডিং কোনওটাকেই শক্তিশালী বলা যাবে না।

কিন্তু ও যে ভাবে পরের পর ডাবল সেঞ্চুরি করে যাচ্ছে, তাতে বারোটা ডাবল সেঞ্চুরির রেকর্ড ছোঁয়া অসাধ্য হওয়ার কথা নয়। তেরোটাও করতে পারে। যেটা পারলে ব্র্যাডম্যানকে পিছনে ফেলে দিতে পারবে ও, সবাইকে বাধ্য করতে পারবে কুমার সঙ্গকারাকে তার প্রাপ্য মর্যাদাটা দিতে।

(লেখক সানডে টেলিগ্রাফ-এর ক্রিকেট করেসপন্ডেন্ট এবং উইসডেন-এর প্রাক্তন সম্পাদক)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement