‘সিটিলাইটস্’, ‘শাহিদ’য়ের সাফল্যের পরে তাঁর ব্যস্ততা বেড়েছে। তাঁর সঙ্গে যখন মুম্বইতে মামাগোতো রেস্তোরাঁয় দেখা হল, তখন ঘড়িতে বাজে সন্ধে সাড়ে ছ’টা! কিন্তু রাজকুমারের লাঞ্চ করা হয়নি। একটা গরম ভেজিটেবল স্যুপ খেতে খেতে বলে চললেন বলিউডের রাজকুমার হওয়ার দীর্ঘ যাত্রার গল্প।
সেরা অভিনেতার জাতীয় পুরস্কার পাওয়ার পর আপনি কি ফেসবুককে ধন্যবাদ জানিয়েছেন?
সত্যি, আমার ইচ্ছে আছে সেটা করার। মার্ক জুকারবার্গকে আমার একটা বড় থ্যাঙ্ক ইউ দিতেই হবে। ফেসবুক না-থাকলে হয়তো বলিউডে ঠিক ভাবে আমার লঞ্চই হত না। দিবাকর বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘এলএসডি’র কাস্টিং ডিরেক্টর অতুল মোঙ্গিয়ার সঙ্গে আমার যোগাযোগ হয় ফেসবুকের মাধ্যমে। ফেসবুকে ওর নাম টাইপ করে দেখি আমাদের এক মিউচুয়াল ফ্রেন্ড আছে। তিনি এফটিআইআই-এ আমার সিনিয়র। তাঁর কাছ থেকে অতুলের নম্বরটা নিই। তার পর ফোন করে বলি যদি আমাকে অডিশনে ডাকেন। অতুল আবার অন্য একজনের নাম দিয়ে আমাকে বলেন যদি আমি তাঁর কনট্যাক্ট নাম্বার দিতে পারি, কারণ সে নাকি এফটিআইআই-এর ছাত্র। ভেবেছিলাম, এটা করলে হয়তো আমাকে অডিশনে ডাকা হবেই। কিন্তু আমি ওকে খুঁজে পাইনি। যদিও অডিশনে আমার ডাক পড়েছিল। গিয়ে দেখি ওই ছেলেটিও উপস্থিত! ও একই রোলের জন্য অডিশন দিচ্ছিল।
অডিশনে তো আপনি একেবারে মাচো সেজে গিয়েছিলেন?
হ্যাঁ। আমি শুনেছিলাম অডিশনে একজন মাচো অ্যাক্টর দরকার। শুনে জিমে গিয়ে পাম্প-আপ করি। টাইট টি-শার্ট পরে মাসল তৈরি করে অডিশন দিতে গেলাম। অতুল আমাকে দেখে বলে চরিত্র তো একদম এ রকম নয়। একেবারে নর্মাল একটা ছেলে। তা-ও বলি আমাকে যদি অডিশন দিতে দেওয়া হয়। শেষ পর্যন্ত আমার অডিশন দিবাকরের ভাল লাগে। তবে একটাই কন্ডিশন। মাসল ঝরাতে হবে।
‘শাহিদ’, ‘সিটিলাইটস্’য়ের মতো ছবি করলেও শুনেছি আপনি মূলধারার বলিউড নাচ আর সিনেমার দারুণ ভক্ত...
একদম তাই। ক্লাস থ্রি-ফোরে থাকার সময়ই মার্শাল আর্টস শিখেছি। ন্যাশনাল লেভেল পর্যন্ত গিয়েছিলাম। অনেক বার সোনা জিতেছি। তার পর জীবনে নাচ চলে এল। কনটেম্পোরারি, সেমি-ক্ল্যাসিকাল, ফোক, বলিউড সব ধরনের নাচই করতাম। গুরগাঁওতে ‘প্রয়াস রঙ্গমঞ্চ’ দলে জয়েন করি। ক্লাস টেনে প্রথম বার নাটক করি। অ্যাটেনশনটা দারুণ লাগে।
এ দিকে আমি তত দিনে বলিউডের দারুণ ফ্যান হয়ে গিয়েছিলাম। শাহরুখ, আমির, অমিতাভ। যে ছবি দেখতাম তার পর টানা দু’সপ্তাহ ওই ক্যারেকটারের মতো ব্যবহার করতাম। ‘ডিডিএলজে’ দেখে ‘রাজ’ হয়ে গিয়েছিলাম।
তার মানে মিমিক্রি করতেন ভাল?
হ্যাঁ। ‘দেবদাস’য়ের শাহরুখের সেই দৃশ্যটা, যেখানে শাহরুখ বলছে, আজকে বাদ ইস চৌকাঠ পর কভি নেহি আউঙ্গা। সবাই দেখে বলত, ‘দেবদাস’ওয়ালা সিন করে দেখাও। আর আমি খুশি মনে সেটা করে দেখাতাম।
দিল্লিতে থাকাকালীন অভিনেতা হতে গিয়ে নাকি আপনার একটা অদ্ভুত অভিজ্ঞতা হয়েছিল?
হ্যাঁ। ১০ হাজার টাকা মার গিয়েছিল। ক্লাস ইলেভেনে পড়তাম। গুরগাঁওয়ের একটা কাগজে পড়েছিলাম, একটা সিরিয়ালের জন্য অভিনেতা নিচ্ছে। আমি সোজা চলে যাই। টিপিক্যাল ফিল্ম অফিস। এক দিকে রাজা মুরাদ, গুলশন গ্রোভার। আমি তো দারুণ ইমপ্রেস্ড। আমার থেকে ১০ হাজার টাকা নিয়ে একটা বাগানে হাঁটতে বলল। পিছনে জগজিত্ সিংহের গান চলছে। তাই দিয়ে শো-রিল তৈরি করবে বলেছিল। আমি তাতেও খুশি। কিছু দিন পরে অফিসে গিয়ে দেখি তালা মারা।
এফটিআইআই-য়ে গিয়ে বেশি বেশি ওয়ার্ল্ড সিনেমা দেখার পরে কি বলিউডের অ্যাট্রাকশন খানিকটা হলেও কমেছিল?
ফিল্ম স্কুলে থাকতে ইন্টারন্যাশনাল সিনেমা দেখি। তখন বলিউডের সঙ্গে সে সব ছবির তুলনা হত। কিন্তু বলিউডকে অসম্মান করেনি কেউই। কারণ কেউ পড়তে পড়তে ভাবিনি ফিল্ম স্কুল থেকে বেরিয়ে ইরানে গিয়ে ছবি করব। সব সময় মাথায় থাকত যে কাজ বলিউডে করতে হবে। এটাও তো ঠিক ভারতেও অনেক ভাল ছবি হয়েছে। সত্যজিত্ রায়, ঋত্বিক ঘটক, বিমল রায় ...কত বলব?
এফটিআইআই থেকে অভিনয়ে পাশ করা কত জন কাজ করছেন বলিউডে? তুলনায় তো এফটিআইআই পাশ করা কলাকুশলীদের সংখ্যা বেশি....
তা ঠিক। তবে এর মানে এটা নয় যে এফটিআইআইতে যাওয়ার প্রয়োজন নেই। অ্যাক্টিংয়ে কম্পিটিশন বেশি। শুধু ট্যালেন্ট দিয়ে তো অভিনেতা হওয়া যায় না। ডেস্টিনি, লাক ...সব কাজ করে। ইউ হ্যাভ টু ওয়ার্ক অন ইওর ক্র্যাফ্ট। লেগে থাকতে হবে। আমি পত্রলেখাকে (‘সিটিলাইটস’য়ে সহ-অভিনেতা আর তাঁর গার্লফ্রেন্ড) সব সময় বলি।
পছন্দের অভিনেতা...
আমির
ভাল লাগে ওর বুদ্ধিদীপ্ততা। খুব সাহসী অভিনেতা।
মনোজ বাজপেয়ী
খুব পরিশ্রমী। অ্যাক্টর হিসেবে ওর গভীরতাটা দারুণ লাগে।
ইরফান
সিনেমা সম্পর্কে দারুণ জ্ঞান। অভিনেতা হিসেবে ওর পারফর্ম্যান্সে সাবলীল ভাবটা খুব পছন্দের আমার।
নওয়াজউদ্দিন
খুব বিনয়ী। মাটিতে পা রেখে চলেন। অভিনেতা হিসেবে দারুণ ভার্সেটাইল।
রণবীর কপূর
কোনও ভান নেই। যে চরিত্রে অভিনয় করেন, সেই চরিত্রের সঙ্গে একাত্ম হয়ে যান রণবীর। এটাই দারুণ লাগে আমার।
মুম্বইতে এসে কি ওই শাহরুখের মতো মেরিন ড্রাইভে দাঁড়িয়ে মনে হয়েছিল যে একদিন এই শহরের রাজকুমার হবেন আপনিই?
না। মনে হয়নি। আমি ভীষণ নার্ভাস ছিলাম। এমন কোনও ইলিউশন ছিল না মুম্বইতে আসার পর দশ জন আমার ফিল্ম নিয়ে বসে থাকবেন। একটা-দুটো বিজ্ঞাপনের কাজ করেছিলাম। বাড়ি থেকেও তেমন চাপ ছিল না। একটা প্যাকেজড শো-রিল নিয়ে ঘুরতাম। সেখানে আমার কয়েকটা ছবি, মার্শাল আর্ট করছি তারও ফোটো। স্টুডেন্ট ফিল্মের কিছু দৃশ্য। কাস্টিং ডিরেক্টরদের সঙ্গে দেখা করলে ওটা দিতাম।
শিকে ছিঁড়তে তো সময় লেগেছে...
হ্যাঁ। কেউ বলেছে আমি তেমন ফর্সা নই। আবার একজন বলেন আমার ভুরুগুলো নাকি একটা পার্টিকুলার ছবিতে একটু অদ্ভুত দেখতে।
যে গানগুলোর তালে নাচতে পছন্দ করেন...
• হাওয়া হাওয়া
• ইয়ে কালি কালি আঁখে
• তম্মা তম্মা
• বদতমিজ দিল
• শাড়ি কে ফল সা
আপনার এফটিআইআই ব্যাচের অন্য বন্ধুরা তো এখনও আপনার মতো সাফল্য পাননি। কী ভাবে জটিলতা বা মনোমালিন্য এড়িয়ে যান?
মুম্বইতে আমার দুই বন্ধু আছে। একজন অভিনেতা (‘সিটিলাইটস’য়ের ওই বার-ওনার)। আর এক জন ডিওপি। চার বছর ধরে এক বাড়িতে থাকি। আমাদের মধ্যে কোনও ঝামেলা নেই।
আজকাল আপনার সঙ্গে নওয়াজউদ্দিনের তুলনা শুরু হয়েছে...
আমার সঙ্গে অনেকেরই তুলনা করে লোকে। মহেশ ভট্ট সাব বলেন আমি ইয়ং দিলীপকুমার। হনসল স্যার বলেন আমি ইয়ং বলরাজ সাহনি। কেউ বলেন আমি ইয়ং ইরফান।
অনেক সময় এগুলো বলা হয় কেবলমাত্র এক জন নবাগতকে প্রমোট করার জন্য...
হ্যাঁ। এটা হয়। তাই আমি চাই লোকে আমায় বলুক আমি ইয়ং রাজকুমার রাও। ও রকম কম্পিটিটিভ মনোভাব নেই।
মাঝখানে একটা লেখায় আপনার নাম না করে বলা হয়, যে আপনি অডি কিউ-সেভেন কিনেছেন বলে অন্য এক সিনিয়র অভিনেতাও সেটা অর্ডার দিয়েছেন।
ভুলভাল লেখা হয়েছিল। নওয়াজকে আমার দারুণ ভাল লাগে। ওই আর্টিকেলে ইঙ্গিত দেওয়া ছিল যে আমি নাকি নওয়াজের বাড়িতে গিয়েছিলাম। কিন্তু আজ পর্যন্ত তা হয়নি। আমি জানিও না নওয়াজ কোথায় থাকেন!
নওয়াজের সঙ্গে কাজ করার কথা ভেবেছেন?
হয়তো দেখবেন কিছু দিনের মধ্যেই হবে। ভাল সহ-অভিনেতা হলে আমার সুবিধে হয়।
আপনি জাতীয় পুরস্কার পাওয়ার পর কলকাতাতে অনেকেই আলোচনা করেছেন যে প্রসেনজিত্ চট্টোপাধ্যায় ‘জাতিস্মর’-এর অভিনয়ের জন্য সেরা অভিনেতার পুরস্কারটা পেলেন না...
আমি ‘জাতিস্মর’ দেখিনি। তাই বলতে পারব না। আসলে অ্যাওয়ার্ড এমন ব্যাপার যে, কাউকে না কাউকে সেটা তো পেতেই হবে।
তারকার দুনিয়ায় কোন জিনিসটা আপনার পছন্দ নয়?
এই ১০০ কোটি নিয়ে যে কথা বলা হয়, সেটার মানে বুঝি না। এটা মিডিয়া হাইপ। যদি একটা ছবি ৮০ কোটিতে তৈরি হয়, এবং ১০০ কোটির ব্যবসা করে, তা নিয়ে এত চর্চা কীসের? ‘সিটিলাইটস’ তৈরি হয়েছিল ৪-৫ কোটির মধ্যে। ছবি মুক্তি পাওয়ার আগেই ৭ কোটির ব্যবসা করে ফেলেছিল। এখনও ছবিটা থিয়েটারে চলছে।
দিবাকর ‘ব্যোমকেশ’ করার সময় মনে হয়নি আপনাকে কেন বললেন না?
না, একদম নয়। আমি সব পরিচালকের সঙ্গে কাজ করছি। পরিচালকরাও তো সবার সঙ্গে কাজ করতে চাইবেন।
‘কুইন’ করার পর পত্রলেখা রেগে যাননি আপনাকে ও-রকম এক বয়ফ্রেন্ডের চরিত্রে দেখে?
না, ওর ভাল লেগেছিল। অনেকে আমাকে বলেছেন আমি ‘কুইন’য়ে এত খারাপ একটা লোকের চরিত্রে এত ভাল অভিনয় করেছি যে অভিনেতা হিসেবে ওঁদের আমাকে দারুণ লেগেছে।
‘সিটিলাইটস’-এর পর কী?
‘ফোকাস’ করছি। তার পর রাজকুমার গুপ্তর ‘রেভোলিউশন ২০২০’। কাই পো চে-র পর আবার চেতন ভগত-এর গল্প নিয়ে ছবি করছি।
এক সময় নাচ-গান, মূলধারার বলিউডের ছবি করতে চেয়েছিলেন। এখনও সেই খিদেটা আছে?
নাচের শখ এখনও আছে। ‘ডলি কি ডোলি’ ছবিতে একটা গানে নেচেছি। ভাল মূলধারার ছবি এলে করব।
জাতীয় পুরস্কারের পরেও যে বাংলা ছবিতে অভিনয় করলেন, সেটা এখনও আটকে আছে। এটাই কি নিয়তি?
হুমম, ‘সায়রা বানু’ ছবিটা আটকেই গিয়েছে। এক হিজড়ের চরিত্রে অভিনয় করেছিলাম। আমিও টাকা পাইনি কাজের জন্য। তবে ছবির পরিচালকের জন্য আমার কষ্ট হয়। ওর প্রথম কাজ তো!
ফাইনালি, শুনলাম ‘সিটিলাইটস’-এর পরে আপনি এফটিআইআই-এর বন্ধুদের ছেড়ে পত্রলেখার সঙ্গে এক বাড়িতে শিফ্ট করছেন...
না। পত্রলেখা আলাদা থাকে। এখনও ওই দু’কামরা আর একটা বারান্দাওয়ালা ফ্ল্যাটেই বন্ধুদের সঙ্গে আছি।
ছবি: সুব্রত কুমার মণ্ডল।