সালটা ১৯৯৫-৯৬ হবে। হায়দরাবাদে নুর মহম্মদের বাড়িতে গেছি। তখন প্রায় আশি ছুঁইছুঁই প্রাক্তন এই কিংবদন্তি ফুটবলার। কিন্তু যতক্ষণ ছিলাম, তার বেশিটায় শৈলেন মান্নার গল্প। একবারও মান্নাদার নামও বলছেন না, শুধু বলছেন ‘সেরা ক্যাপ্টেন’। কী অপরিসীম শ্রদ্ধাবোধ সতীর্থ সম্পর্কে, যাঁর সঙ্গে অন্তত চার দশক আগে ফুটবল খেলেছেন। শৈলেন মান্নার আরেক সতীর্থ, আরেক কিংবদন্তি বজ্রভেলুর ছেলে আমাদের প্রোডাকশন টিমে মাঝেমধ্যে কাজ করে। বেঙ্গালুরুতে থাকে ওরা। নানা সময় বাবার কথা উঠতেই বলে শৈলেন মান্নার কথা, ‘‘বাবাকে দেখতাম শৈলেন মান্নার সম্পর্কে প্রবল শ্রদ্ধাবোধ। নিজের ফুটবল জীবনের কথা বলতে হলেই ওঁর কথা বলতেন। বলতেন উনি ছিলেন আসল লিডার।’’।
সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় সম্পর্কে ওঁর সতীর্থ কিংবা চারপাশের মানুষদের অন্তরমহলে ওই শ্রদ্ধাবোধটাই চুঁইয়ে চুইয়ে পড়তে দেখি। এখনও যুবরাজ, বীরেন্দ্র সহবাগ, হরভজনদের ক্যাপ্টেন যেন সৌরভই। সৌরভের সঙ্গে একই ফ্রেমে এঁদের কাউকে দেখলেই দেখবেন মুখের জ্যামিতি, ত্রিকোণমিতিগুলো সব বদলে যাচ্ছে। একসঙ্গে সবাই মিলে ফিরে যাচ্ছেন সেই সময়টায় যখন ক্যাপ্টেন গাঙ্গুলি এঁদের সবাইকে বিশ্বাস করতে শিখিয়েছিলেন দেশের মাটিতে তো জিতবই। এ বার অস্ট্রেলিয়া, পাকিস্তান, ইংল্যান্ডে গিয়েও ওদের মারতে হবে। আর ওই বিশ্বাসটা যে কত গভীরে, এখনও বোঝা যায়।
শুধু ক্যাপ্টেন গাঙ্গুলির টিম ইন্ডিয়ার ওই পনেরোজন সদস্য তো নয়। বিশ্বাস, শ্রদ্ধাবোধ সবটা রেখে গেছেন ভারতের ক্রিকেট ম্যাপের প্রতিটা ইঞ্চিতে ইঞ্চিতে। দিল্লির এক সাংবাদিক বন্ধু সম্প্রতি মুম্বইয়ে বদলি হয়েছেন কর্মসূত্রে। প্রথম দিকে ট্রেনে করেই যাচ্ছিলেন অফিস। ওঁর মুখেই শুনছিলাম সে দিন, ‘‘বিশ্বাস করবেন না, ওয়েস্টার্ন রেলে আমার ওই দু’মাসের ডেইলি প্যাসেঞ্জারিতে দেখেছি, এখনও দাদার সম্পর্কে কী অপরিসীম শ্রদ্ধা মুম্বইয়ের লোকজনের। ক্রিকেট নিয়ে আলোচনা হলেই হল। লোকজন বলতে থাকত, ইন্ডিয়া কা আসলি ক্যাপ্টেন থা গাঙ্গুলি।’’
ওঁর মুখেই শুনলাম, ‘‘বিশ্বকাপের সময় অস্ট্রেলিয়ার একটা ফুড কোর্টে দাদার সঙ্গে ডিনারে গিয়েছি। ইন্ডিয়ান রেস্তোরাঁ। ওখানকার কর্মীদের দাদাকে নিয়ে ছবিটবি তোলা, এগুলো তো চলতেই থাকে। ওখানেও হল। হঠাৎ দেখি বাংলাদেশি বোলার তাকসিন আহমেদ এল। দাদাকে দেখতে পেয়ে কাছে এসে বলল, ‘‘দাদা, আপনি যদি আমার বোলিংয়ে কী কী ভুল হচ্ছে সেটা বলেন।’’ দাদা দেখলাম গড়গড় করে বলে যাচ্ছেন কোন বলে ও কী করেছে। তাকসিন নিজেও অবাক। যেন বিশ্বাস করতে পারছে না। দাদাকে সেটা বলেও ফেলল। দাদার জবাব ছিল একটাই, ‘‘আমার তো কাজই এটা।’’
আসলে অধিনায়করা এমনই। যখন যেটা করেন হৃদয় নিংড়ে করেন। সামনে থেকে নেতৃত্ব দেন। আর ‘লিডার্স আর বর্ন’, এটা যে কত খাঁটি কথা, সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়দের কাছ থেকে দেখলে বোঝা যায়। সে ক্রিকেট মাঠে হোক, কমেন্ট্রি বক্সে হোক, কিংবা ক্রিকেট প্রশাসনেই হোক—দখলদারি নিতে সময় লাগে না। একটা রাত পোহালে ইডেনের বুকে বিশ্বকাপের ফাইনাল। হাতে গোনা কয়েক ঘণ্টার নোটিসে ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশন অব বেঙ্গল আয়োজন করে ফেলেছে ভারত-পাকিস্তানের মতো হাইভোল্টেজ ম্যাচ— সবটা ভাবলে আমার মনে হচ্ছে ওই ‘দখলদারি’ শব্দটাই একেবারে নির্ভুল।
জগমোহন ডালমিয়ার ফেলে যাওয়া চেয়ারটায় বসে পাঁচ মাসের মধ্যেই বিশ্বকাপ আয়োজন করাটা সহজ কাজ ছিল না। ক্ষমতার জটিলতার রীতিমতো রাফ উইকেট তখন সিএবিতে। কোষাধ্যক্ষের বিবৃতি সভাপতির বিরুদ্ধে, প্রতিদিনই কিছু খবর ‘খাইয়ে’ দেওয়ার চেষ্টা সৌরভের বিরুদ্ধে, হঠাৎ জনপ্রিয় হয়ে ওঠা একটা বিরুদ্ধ গোষ্ঠী— এগুলো দিনের আলোর মতো প্রকাশ্যে চলে আসছিল। সৌরভ মুখ খুললেন একদিনই। যেদিন গুলাম আলি কনসার্ট ইডেনে আয়োজন করার অনুমতি দিয়েছেন বলে মিথ্যে খবর রটানো হল সিএবি থেকেই। সাংবাদিক সম্মেলন ডাকলেন। রাগে ফুঁসছিলেন, ‘এমন মিথ্যে এখানে চলতে পারে না।’ দু’মাস আগের সৌরভের ওই চেহারা দেখে মনে মনে ‘গুডলাক’ বলতে হচ্ছিল। এই টিম নিয়ে ম্যাচ জিতবেন ক্যাপ্টেন গাঙ্গুলি! অসম্ভব।
সেই ইডেন... সেই টেলিফোন... শুধু পাল্টে গেল যুগ
দু’মাসেই যে খেলাটাকে ঘুরিয়ে নিজের দিকে নিয়ে এসেছেন, এই বিশ্বকাপই তার প্রমাণ। বিকেলের দিকে ক্লাবহাউসে দাঁড়ান, চওড়া হাসির ক্লাবকর্তাদের পাবেন। নতুন প্রেসিডেন্ট ভরিয়ে দিয়েছেন টিকিটে। পাকিস্তান ম্যাচের টিকিট হাতে পেয়েই চলে গেছিলেন ময়দানি পিতামহ বিশ্বনাথ দত্তের বাড়ি। ঠিক যে ভাবে জগমোহন ডালমিয়া যেতেন। নিজের হাতে তুলে দিয়েছেন তাঁর টিকিট। নিয়ে এসেছেন আশীর্বাদ। গোটা ইডেনের টিকিট ডিস্ট্রিবিউশন সিস্টেমটা নিজের হাতে দেখাশোনা করেছেন। ক্লাবগুলোর টিকিটের কোটা বাড়িয়েছেন। ডিস্ট্রিক্ট হোক কী ইউনিভার্সিটি— সবাইকে ব্যক্তিগত ভাবে চেনেন সৌরভ। এ ভাবেই সিএবি-তে নিজের টিমও বানিয়ে ফেললেন। সঙ্গী ডালমিয়া-পুত্র অভিষেক। অভিষেকের অভিজ্ঞতা কম, কিন্তু ক্রিকেট আবহে বেড়ে ওঠার সৌজন্যে কোথাও একটা ইতিবাচক দিকও আছে। সৌরভ কাজে লাগাতে চান সেটাকেও। সঙ্গে গৌতম দাশগুপ্ত, চিত্রক মিত্র, বাবলু কোলেদের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগান। দু’মাসে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ১৮ ঘণ্টাই বোধহয় দিয়েছেন সিএবি-কে। সকালে আসছেন, ফিরছেন রাত ১০টায়। সিএবি-র কাজ করবেন বলে ক্রিকেট কন্ট্রোল ছেড়েছেন অনেক দিনই। এখন ব্যক্তিগত এনডোর্সমেন্টগুলোতেও বেশি সময় দিতে পারেন না। অথচ যেগুলোয় রাজি হলেই ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে বাড়তি কয়েক কোটি টাকা। এক কর্মী তো সরাসরি সৌরভের মা-কেই সেদিন অভিযোগ করে বলল, ‘‘মহারাজদাকে কিছুতেই রাজি করাতে পারছি না। একদিনের কাজ। আমাদের সব শর্ত মেনে নিয়েছে। তবু যাবে না বলল। তুমি একটু বলো না জেঠিমা!’’
আসলে এই সাফল্যের পিছনেও শর্ত ওটাই। যখন যেটা করব ভাল ভাবে করব। ভিশন ২০-২০ করে নিয়ে এলেন ভিভিএস লক্ষ্মণ, মুরলিধরন, ওয়াকার ইউনিসদের। প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব নেবার পরই ইডেনের ড্রেনেজ সিস্টেম বদলে ফেললেন। জায়ান্ট স্ক্রিন বসালেন। বিদেশ থেকে পিচ কভার আনলেন। গ্রাউন্ড কভার আনলেন। প্রসূন মুখোপাধ্যায়ের জমানায় বৃষ্টিতে ম্যাচ ভেস্তে গেছে। তাজ বেঙ্গলে দাঁড়িয়ে প্রতিপক্ষ জগমোহন ডালমিয়া প্রেস কনফারেন্স করেছেন, কোথায় ভুল করলেন প্রসূনবাবুরা। আবার ডালমিয়ার সময়েও একই ভুল। বৃষ্টি, ম্যাচ বানচাল। অথচ পাঁচ মাসে সৌরভ যা পারলেন, অতগুলো বছরে ওরা পারলেন না। আর এই বাড়তি উদ্যোগটা ভারত-পাকিস্তান ম্যাচে আসা ৭০ হাজার দর্শককে হতাশ হয়ে বাড়ির রাস্তা ধরতে দিল না। সকালে আকাশে মেঘ দেখেই ইডেন ঢেকে ফেলার নির্দেশ দিয়েছিলেন। পুলিশের সঙ্গে কথা বলে পুলিশি পাহারা রাখলেন গ্রাউন্ড কভারেজের ওপর। বিকেলের বৃষ্টির সময়েও কভারের ওপরে ঠায় দাঁড়িয়ে রইলেন গ্রাউন্ড স্টাফরা। তদারকি করলেন নিজে, বাইরে থেকে। মাঠের ভিতরে দেবব্রত দাস, সুজন মুখার্জির মতো টিম-সৌরভের অন্দরমহলের লোকেরা। সিএবি প্রেসিডেন্টের ঘরে কিন্তু তখন অমিতাভ বচ্চন, ইমরান খান, রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী। আর প্রেসিডেন্ট সব ছেড়ে তখন অন্য লক্ষ্যে। খেলা শুরু করার তদারকিতে। হ্যাঁ, বিকেলে টানা এক প্রস্ত বৃষ্টির পরও তাই খেলা হল। ইডেনে অন্য রকম এক অভিজ্ঞতা। অথচ এই ম্যাচটা আয়োজনের জন্য হাতে গোনা কয়েকটা দিন সময় পেয়েছিলেন। কিন্তু টিম-সৌরভের এ বারের হোমওয়ার্ক এতটাই জোরালো ছিল যে সমস্যা হয়নি কিছুতেই। ভারত-পাকিস্তান শুনেই ছকে নিয়েছিলেন অন্য রকম কিছু একটা করবেন বলে। ম্যাচ ঘোষণা হবার রাতেই সিএবি সভাপতির একটা ফোন এল। ‘‘অরিজিৎ সিংহকে একবার বলবে যদি ১৯ তারিখ ইডেনে কয়েকটা গান গেয়ে দেয়’’। অরিজিৎকে বলাতে সে রীতিমতো দ্বিধায়। সেদিন পূর্বনির্ধারিত কিছু অনুষ্ঠান রয়েছে। অন্য দিকে দাদার ডাক। পরিস্থিতি সামলাতে সৌরভই জানালেন, ‘‘দরকার নেই তাহলে। আমি দেখছি কী করা যায়।’’ যা করলেন, সেটাও একেবারে ‘বাপি বাড়ি যা’ গোছের। অমিতাভ বচ্চনের গলায় জাতীয় সঙ্গীত শুনল ইডেন। সৌরভের ছোট এক অনুরোধেই রাজি মিস্টার বচ্চন। নিজের খরচে চলে এলেন। সেই রাতে ইডেন সংবর্ধিত হতে দেখল ওয়াসিম, ওয়াকার, ইমরান, গাওস্কর, তেন্ডুলকর, সহবাগদের। এঁরা সবাই সবুজ আর তেরঙার মাঝে বুক চাপড়ে, দাপিয়ে ইন্ডিয়া-পাকিস্তান ম্যাচ খেলেছেন। তবে এই নামগুলির মধ্যে একজনকে আমি অন্তত মিস করছিলাম। সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে তাঁর মতো আর ক’জন জিতিয়েছেন ভারতকে? কিন্তু এই সৌরভ নিজে সংবর্ধনা দেন, নিতে পারেন না। সেদিনই সকালে বাড়িতে স্তূপীকৃত টিকিটের মধ্যে বসে মজা করছিলেন, ‘‘আগে ইন্ডিয়া-পাকিস্তান ম্যাচে টস করতে যেতাম, এখন টিকিট বিলি করছি’’।
মজা, না আক্ষেপ! হয়তো মজা। কিন্তু আক্ষেপও আছে। সেটাই কখনও কখনও বাড়ে, যখন সিএবি-তেই ক্রিকেটের সংস্কারের কাজে বাধা দেবার চেষ্টা করেন কয়েক জন। ইডেনের টাইটল স্পনসর পেয়েও এগোতে পারলেন না এই বাধায়। নাম পরিবর্তন হত না, শুধু ইডেনের আগে কোনও কোম্পানির নাম জুড়ত। বাংলার ক্রিকেটের ঘরে আসত অনেকটা অর্থ। এখন দুনিয়া জুড়ে মানুষের মুখে মুখে যাদের নাম সেগুলি হল এমিরেটস স্টেডিয়াম, যেটা এক ঐতিহাসিক স্টেডিয়াম। কিন্তু ইডেনের ক্লাব হাউসে এমন মুক্ত চিন্তাভাবনার প্রবেশ নিষেধ। ঢেলে সাজাতে চান সিএবি-র অ্যাডমিন্সট্রেশন। বিশ্বকাপের আগে নিজের দায়িত্বে নিয়ে এসেছেন এক স্পোর্টস ম্যানেজমেন্ট বিশেষজ্ঞকে। কিন্তু ৩৬৫ দিন কেন সিএবি-র একজন আলাদা সিইও থাকবে না? কেন মিডিয়া সামলাবে না কোনও পাবলিক রিলেশন এজেন্সি? কেন ইডেন ঘিরে একটা স্টেডিয়াম ট্যুর হতে পারে না? প্রশ্নগুলো সবার, সৌরভেরও। কিন্তু সত্তর দশকের ঘরানায় ময়দান চালানো মানুষগুলো যে শিখে আসা, দেখে আসা নিয়মের বাইরে হাঁটতেই চায় না। এ সব কি সৌরভকে তাড়িত করে না? নিশ্চয়ই করে। আর এখানেই খানিকটা নিশ্চিন্তিও। ‘দখলদারি’র পর্বটা সম্পূর্ণ হলে এ রকম অনেক অচলায়তন ভেঙেও দেবেন। এ বারেও একটা একটা করে শৃঙ্গজয় করতে নেমেছেন। প্রথমে বিশ্বকাপ, তার পর নির্বাচন, তার পর আরও কত কিছু...
যদি থাকেন, বাংলার ক্রিকেটকে অনেক কিছু দিয়ে যাবেন। মিলিয়ে নেবেন। ক্যাপ্টেনরা যে এ রকমই হয়! সময়ের আগে, নিয়মের বাইরে।