টলিউড এখনও ‘সাবালক’-এর অপেক্ষায়। তবে কিছু ‘সাবালিকা’ এসে গিয়েছেন বোধহয়। ছবি: ‘নির্বাক’ সিনেমা থেকে নেওয়া।
মিমি কি চুমু খাবেন?
প্রশ্নটা অরিন্দম শীলের। যে প্রশ্নে এখনই নিজেকে জড়াতে নারাজ মিমি চক্রবর্তী। তবে এটা ঠিক যে, তিনি একেবারে সটান ‘না’-ও বলছেন না।
পর্দায় চুমু খাওয়া নিয়ে সাধারণ, আটপৌরে বাঙালি নায়িকাদের আপত্তি থাকতে পারে। সেটা সম্ভবত অস্বাভাবিকও নয়। কিন্তু ডাকসাইটে এবং প্রতিষ্ঠিত নায়িকাদেরও প্রবল বাধা! ১৯৬৯ সালে তো পর্দায় চুমু খাওয়া নিয়ে আস্ত কমিশনই বসিয়ে দিয়েছিল সরকার! সেই খোসলা কমিশন কড়া নির্দেশ জারি করেছিল— ছবিতে প্রকাশ্যে চুমু খাওয়া দেখানো যাবে না! ফলে ১৯৭০ সালে ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’ তৈরি করতে গিয়ে সমস্যায় পড়েছিলেন সত্যজিৎ রায়। ছবিতে ‘সিদ্ধার্থ’ ধৃতিমান চট্টোপাধ্যায়ের এক নার্সের অন্তর্বাস খুলে দেওয়ার দৃশ্য ছিল। চুমুও নয়। স্রেফ অন্তর্বাস খুলে দেওয়া। তাতেই হই-হই পড়ে যায়। নার্স সংগঠনের দাবিতে সত্যজিৎ বাধ্য হন সেই দৃশ্য সংক্ষিপ্ত করতে। ফলস্বরূপ ১৯৮০ সালে ভিক্টর বন্দ্যোপাধ্যায়-অপর্ণা সেনকে নিয়ে ‘পিকু’ ছবি বানাতে গিয়ে যৌনতা দেখালেও চুম্বনের দৃশ্য দেখাতে পারেননি সত্যজিৎ। তবে পরবর্তীকালে ‘ঘরে বাইরে’-তে বিমলা-সন্দীপের প্রত্যক্ষ চুম্বন দেখিয়ে সত্যজিৎ বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, ওই বিষয়ে তাঁর কোনও ছুঁৎমার্গ নেই।
সত্যজিতের আপত্তি ছিল না। কিন্তু অপর্ণার ছিল। তবে কি না, সে পলাশিও নেই। সে ওয়ারেন হেস্টিংসও নেই। পরিচালক হিসেবে অপর্ণা তাঁর দ্বিতীয় ছবি ‘পরমা’য় চুম্বনদৃশ্য দেখিয়েছিলেন।
আরও পড়ুন: ‘নিজের চেষ্টায় কিছু অর্জন করতে চাইলেও মেয়েদের প্রাপ্য কৃতিত্ব দেওয়া হয় না’
পরিচালক সৃজিত মুখোপাধ্যায় মনে করেন, ‘দ্বিতীয় পুরুষ’-এ পরমব্রত-অনির্বাণের চুম্বনদৃশ্য, ‘নির্বাক’-এ সুস্মিতা সেন-যিশু সেনগুপ্তের স্মুচিং সিন এবং ‘রাজকাহিনি’-তে আবির-পার্নোর গভীর চুম্বন বাংলা ছবিকে ‘সাবালক’ করে তুলেছে। তবে পাশাপাশিই নাম না করে সৃজিত বলছেন, “এখনও বাংলা ইন্ডাস্ট্রিতে এমন অনেক অভিনেতা আছেন, যাঁরা অনস্ক্রিন চুমু খেতে পারবেন না বলে আমার ছবি থেকে বাদ পড়েছেন!”
স্বয়ং উত্তমকুমার প্রশ্ন তুলেছিলেন, “বাংলা ছবিতে ধূমপান আর মদ্যপানের দৃশ্য থাকলে চুমুর দৃশ্য থাকবে না কেন?” ছবি: ‘তবে তাই হোক’ সিনেমা থেকে নেওয়া।
২০১৩ সালে ‘আমি আর আমার গার্লফ্রেন্ড’ এবং ২০১৪ সালে ‘টেক ওয়ান’ ছবিতে ‘ন্যুডিটি’ বা নগ্নদৃশ্য নিয়ে কাজ-করা মৈনাক ভৌমিক অবশ্য মনে করেন, বাঙালি কোথাও আদরকে প্রকাশ্যে আনতে চায় না। সমাজের এই মনোভাবই ছবিতে দেখা যায়। যদিও বাঙালি আদর দেখতে ভালবাসে। তাই বন্ড মুভির স্মুচিং সিন তাদের এত প্রিয়।
মৈনাকের কথায়, “স্বস্তিকা,পাওলি, পার্নো, সৌরসেনী যেমন ছবিতে চুম্বনের দৃশ্যে যথেষ্ট স্বচ্ছন্দ। অনেকে আবার ততটা নয়। তবে শুধু হলিউড-বলিউড নিয়ে কথা বললেই চলবে না। আটের দশকে বাংলায় ‘পরমা’-র মতো ছবিও তো হয়েছিল। এখন যা মুম্বইয়ে হলে হইহই পড়ে যেত। ‘গাণ্ডু’-র মতো ছবিও তো বাংলাতেই হয়েছে। ‘আমি আমার গার্ল ফ্রেন্ড’-এর সাহসী দৃশ্য বাঙালি অনেক আগেই দেখে নিয়েছে।”
প্রাত্যহিক প্রেম আর ছবির চুম্বনদৃশ্য এ প্রজন্মের বাংলা অভিনেত্রীদের অধিকাংশের জীবনে একাকার। ছবি: ‘ক্ষত’ সিনেমা থেকে নেওয়া।
রাজেশ শর্মার সঙ্গে ‘টান’ ছবিতে চুম্বনের দৃশ্যে অভিনয় করে নজর কেড়েছিলেন দেবলীনা দত্ত। তিনি আবার বলছেন, “অরিন্দম শীলের ‘এ বার শবর’-এ আমার আর রাহুলের স্মুচিং সিন ছিল। খুব যত্ন নিয়ে সেটা শ্যুটও করা হয়। কিন্তু পরে ছবি থেকে সেটা বাদ দেওয়া হয়। কেন, জানি না। সেক্সের মতো বিষয় সাজেশন হিসেবে ছবিতে দেখানো যেতেই পারে। কিন্তু চুম্বন এমন একটা অনুভূতি যেটা সোজাসুজি না দেখালে খুব হাস্যকর লাগে। বাংলা ছবিতে হয় ওই রকম হাস্যকর দৃশ্য বন্ধ হোক! নয় সোজা চুম্বনদৃশ্য দেখানো হোক।” একই সুর অভিনেত্রী শ্রীলেখা মিত্রের গলায়। ‘একমুঠো’ ছবিতে এক মডেলের সঙ্গে তাঁর স্মুচিং সিন ভাইরাল হয়ে গিয়েছিল।
শ্রীলেখার কথায়, “চুম্বনদৃশ্য একটা অনুভূতির ব্যাপার। বিদেশে যৌনদৃশ্য শ্যুট করতে গিয়ে পুরুষ অভিনেতা সেক্সুয়ালি উত্তেজিত হয়ে পড়লে ছেলেদের ‘মডেস্টি প্যাচ’অবধি পাওয়া যায়। কেউ কেউ সে সময় স্প্রে করে নেয়। বিষয়টাকে খুব স্বাভাবিকভাবে নেওয়া হয়। আমাদের এখানে বেডসিন বা স্মুচিং সিনের সময় কিছু পরিচালক তো লজ্জা পেয়ে লুকিয়েই পড়েন!”
রাজেশ শর্মার সঙ্গে ঋতুপর্ণার শারীরিক আদানপ্রদানের দৃশ্যটি ‘টান’ ছবির উত্তেজনার পারদকে বেশ খানিকটা বাড়িয়ে দিয়ে। ছবি: ‘টান’ সিনেমা থেকে নেওয়া।
বাণিজ্যিক ছবির পাশাপাশি প্যারালাল ছবিতেও সমানতালে কাজ করেছেন ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত। পর্দায় তিনি বরাবর চরিত্রের প্রয়োজনে খোলামেলা৷ সমসাময়িক অন্য অভিনেত্রীরা যখন সিনেমা থেকে সরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন, তখন তিনি একের পর এক সাহসী চরিত্রে কাজ করছেন। মুকুল রায়চৌধুরির ছবি ‘টান’-এর বিষয়টাই ‘জলবেশ্যা’ হওয়ায় তাতে যে উত্তেজক দৃশ্য থাকবে, তা স্বাভাবিক৷ কিন্তু রাজেশ শর্মার সঙ্গে ঋতুপর্ণার শারীরিক আদানপ্রদানের দৃশ্যটি ছবির উত্তেজনার পারদকে বেশ খানিকটা বাড়িয়ে দিয়েছিল৷ অনিরুদ্ধ রায়চৌধুরির ‘অনুরণন’ ছবিতেও গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন ঋতুপর্ণা৷ ছবিতে তাঁর স্বামী রাহুল বসুর সঙ্গে বেশ কিছু চুম্বনদৃশ্যে অভিনয় করেছিলেন তিনি৷ ‘অনুরণন’-এর প্রসঙ্গ টেনে ঋতুপর্ণা বললেন, “আমি চিট করে চুমুর দৃশ্য করিনি। চরিত্রের খাতিরেই করেছি। আর শুধু ঠোঁটে-ঠোঁট ছোঁওয়া নয়। অভিনেতাদের বডি ল্যাঙ্গোয়েজ দিয়ে বুঝিয়ে দিতে হয় যে, চুম্বন থেকে শারীরিক ওম পেতে তারা কতটা আগ্রহী। রাহুল থেকে রাজেশ— সব ক্ষেত্রেই এই পারস্পরিক প্রস্তুতি কাজ করেছিল।”
আরও পড়ুন: বাজি, ভিড়ে রাশ টানতে ফের হাইকোর্ট ভরসা, কী বলছেন তারকারা?
(গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ)
ছ’য়ের দশকে এক সাক্ষাৎকারে স্বয়ং উত্তমকুমার প্রশ্ন তুলেছিলেন, “বাংলা ছবিতে ধূমপান আর মদ্যপানের দৃশ্য থাকলে চুমুর দৃশ্য থাকবে না কেন?” তার অনেক আগেই নির্বাক বাংলা চলচ্চিত্রের যুগে দেবিকারানি-হিমাংশু রায়ের চুম্বনের দৃশ্য শ্যুট করা হয়ে গিয়েছিল। ১৯৩১ সালের ‘জামাইবাবু’ ছবিতে রাধারানি দেবীর চুম্বনদৃশ্য নিয়ে শোরগোল পড়েছিল টলিপাড়ায়। ছবির পরিচালক ছিলেন কালীপদ দাস। সে সময় কাননদেবী একটি ছবি তুলিয়েছিলেন তাঁর খোলা পিঠের। কাননের ‘পিঠস্থান’ ঘিরে চলেছিল নানা রসালো গল্প। কিন্তু তার পর থেকে বাংলা ছবিতে চুম্বনের ‘নো এন্ট্রি’। তা যেন ‘স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকর’! নইলে কি আর মিমি চক্রবর্তী-নুসরত জাহানরা অনস্ক্রিন চুমু নিয়ে মন্তব্য এড়িয়ে যান! সাধে কি আর অরিন্দম শীল বাংলায় জেমস বন্ড বানাতে পারবেন না বলে আনন্দবাজার ডিজিটালের লেখায় হা-হুতাশ করেন! সখেদে লেখেন, ‘বাংলায় আগে সকলে চুমু খাওয়াটা ভাল করে প্র্যাকটিস করুক’!
কাননের ‘পিঠস্থান’ ঘিরে চলেছিল নানা রসালো গল্প। ছবি: আনন্দবাজার আর্কাইভ।
তার পর বেশ কিছু বছর বাংলা ছবির পরিচালকেরা নায়ক-নায়িকার মুখের ওপর আলো নিভিয়ে, বিছানার চাদরে মুখ লুকিয়ে বা দুই ফুলের জড়াজড়ি দেখিয়ে চুম্বনদৃশ্য বুঝিয়ে আসছিলেন। সেই ‘ধরি মাছ না ছুঁই পানি’র অস্পষ্টতা ভেঙেছিলেন অধুনাপ্রয়াত পরিচালক বাপ্পাদিত্য বন্দ্যোপাধ্যায়। ‘এলার চার অধ্যায়’ ছবিতে পাওলি চুম্বনের দৃশ্যে শুধু অভিনয়ই করেননি। ছবিতে দেখানো হল, ‘এলা’ বলিউডের ‘কর্মা’ ছবির দীর্ঘতম চুম্বনের দৃশ্যটি দেখছেন।
সে দৃশ্য এখনও বিলক্ষণ মনে আছে পাওলির। যিনি বললেন, “চুম্বনদৃশ্য চিত্রনাট্যে কতটা প্রয়োজন সেটাই প্রশ্ন। আর বিষয়টা তো পাওলি-কেন্দ্রিক নয়। যখন যে চরিত্র হয়ে উঠি, তার প্রতিক্রিয়া কী হবে, বিষয়টা তার। সেই চরিত্রের। তার বডি ল্যাঙ্গোয়েজ কেমন থাকবে, সে ওই নির্দিষ্ট মুহূর্তে কী করবে— এগুলো ভাবতে থাকি। ঠোঁটে-ঠোঁট মেলালেই তো হল না!” মৈনাক ভৌমিকের ‘ফ্যামিলি অ্যালবাম’ ছবিতে পাওলি-স্বস্তিকার ‘স্মুচিং সিন’ রীতিমতো হইচই ফেলে দিয়েছিল। পাওলি জানাচ্ছেন, ওই দৃশ্য যে আগে থেকে ঠিক করা ছিল, তা নয়। পাওলির কথায়, “আমি মৈনাক আর স্বস্তিকা বিষয়টা নিয়ে আলোচনা করছিলাম। আমার মনে হল, কোনও প্রেমিক-প্রেমিকা ভালবাসলে কী ভাবে পরস্পরকে আদর করে? আমরাও ঠিক সেটাই করলাম। সে ভাবেই দৃশ্যটা শ্যুট করা হয়েছিল”। ব্যক্তিগত সত্তা বাদ দিয়ে ছবিতে কাজ করেন পাওলি। তাই দরকার পড়লে চুম্বনের দৃশ্যেও তাঁর আপত্তি থাকবে না বলেই মনে করেন বাংলার দর্শক।
মৈনাক ভৌমিকের ‘ফ্যামিলি অ্যালবাম’ ছবিতে পাওলি-স্বস্তিকার ‘স্মুচিং সিন’ রীতিমতো হইচই ফেলে দিয়েছিল। ছবি: ‘ফ্যামিলি অ্যালবাম’ সিনেমা থেকে নেওয়া।
কিন্তু তবুও পরিচালক অরিন্দমের লেখায় প্রশ্ন থেকে যায়, ‘মিমি-নুসরত কি পর্দায় চুমু খেতে রাজি হবে’?
মিমি-নুসরত মন্তব্য করতে চাননি। কিন্তু ওয়েব সিরিজের জমানায় টলিউডের উঠতি নায়িকা শ্রীতমা দে, তুহিনা দত্ত, দর্শনা বণিক থেকে অলিভিয়া সরকার, অনুরাধা মুখোপাধ্যায়, বিবৃতি চট্টোপাধ্যায় চিত্রনাট্যের খাতিরে ‘নান্দনিকতা’ বজায় রেখে চুম্বনদৃশ্যে আড়ষ্ট নন। উল্টে অভিনয়ের খাতিরে তাঁরা যে কোনও দৃশ্যেই ১০০ শতাংশ দিয়ে অভিনয় করতে চান। প্রাত্যহিক প্রেম আর ছবির চুম্বনদৃশ্য এ প্রজন্মের বাংলা অভিনেত্রীদের অধিকাংশের জীবনে একাকার।
টলিউড এখনও ‘সাবালক’-এর অপেক্ষায়। তবে কিছু ‘সাবালিকা’ এসে গিয়েছেন বোধহয়।