গ্রাফিক- শৌভিক দেবনাথ।
করোনা-কালে যখন একের পর এক বলিউডের ছবি ওটিটি প্ল্যাটফর্মে মুক্তি পাচ্ছে, তখন বাংলা ছবি কোথায়? কোথাও নয়! কেন?
প্রযোজক-পরিচালকেরা বলছেন, বাংলা ছবির ‘কনটেন্ট’ অর্থাৎ বিষয়বস্তু এখন কার্যত মূল্যহীন!
করোনা-কালে অ্যামাজন প্রাইম, হটস্টার থেকে নেটফ্লিক্স— কোথাও কোনও বাংলা ছবির প্রিমিয়ার হতে দেখা গেল না। সাম্প্রতিককালে ওটিটি প্ল্যাটফর্মে যে দু’টি ছবি মুক্তি পেয়েছে, সেগুলি হল প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়ের ‘নিরন্তর’ এবং রাজা চন্দর ‘হারানো প্রাপ্তি’। দু’টি ছবির ক্ষেত্রেই স্যাটেলাইট রাইটস অনেক দিন আগে বিক্রি হয়ে গিয়েছিল। প্রেক্ষাগৃহে মুক্তির অপেক্ষায় না থেকে ছবিগুলি ওটিটি-তে আসে। প্রসেনজিতের কথায়, ‘‘জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক স্তরে নতুন ট্যালেন্টদের জন্য ওটিটি নিঃসন্দেহে একটা বড় প্ল্যাটফর্ম। আমরা এখন খুব খারাপ সময়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি। তবু বলব, সিনেমাহলের যে ম্যাজিক, সেটা অন্তত আরও ১০০ বছর থেকে যাবে!’’
পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়ের হিন্দি-বাংলা দ্বিভাষিক ছবি ‘টিকি টাকা’ জি ফাইভ সরাসরি কিনলেও ছবিটির বাংলা ভার্সন জি বাংলা চ্যানেলে দেখানোর সম্ভাবনা আছে। অর্থাৎ, এ ক্ষেত্রেও স্যাটেলাইট রাইটস আর ওটিটি মিলিয়েই ছবি মুক্তি পাচ্ছে। মোটের উপর, চ্যানেলের হাত ঘুরে বা পরে চ্যানেলে দেখানোর আবশ্যিক শর্তের বিনিময়েই হাতেগোনা বাংলা ছবির ওটিটি প্রিমিয়ার হয়েছে।
২০২০-তে ইতিমধ্যেই খান চল্লিশেক বাংলা ছবি মুক্তির অপেক্ষায়। কিন্তু হল খুলছে না। তবুও ওটিটি-তে তাদের দেখা মিলল না কেন?
'গুলাবো সিতাবো' ছবিটি অ্যামাজন প্রাইম কিনেছিল ৬০ কোটি টাকা দিয়ে
তথ্য এবং ইতিহাস বলছে, বক্স অফিসে সফল বাংলা ছবি প্রথমেই ওটিটি-তে আসেনি। আসবে, অচিরে এমন সম্ভাবনাও নেই। বলিউডের নিরিখে টলিউডকে দেখলে খানিকটা ব্যাখ্যা পাওয়া যেতে পারে। যেমন সলমন খানের ছবি ৩০০ কোটি ক্লাবের কোনও ছবি ওটিটি-তে মুক্তি পায়নি।
অভিজ্ঞরা বলছেন, বলিউডের সে সব ছবিই ওটিটি-তে মুক্তি পেয়েছে, যেগুলির ব্লকবাস্টার হওয়ার সম্ভাবনা ছিল না। যেমন, সুজিত সরকারের ‘গুলাবো সিতাবো’ ৪০- ৪৫ কোটি টাকার ছবি। যা অ্যামাজন কিনেছিল ৬০ কোটিতে। অর্থাৎ, প্রযোজকের ঘরে ১৫ থেকে ২০ কোটি টাকা এসেছিল। স্যাটেলাইট রাইটস বাবদ টাকা বাদ দিয়েও। সুশান্ত-অধ্যায়ের পরবর্তী ‘সড়ক ২’ হল-এ মুক্তি পেলে মুখ থুবড়ে পড়ার আশঙ্কা ছিল। সেখানে হটস্টার ৪০ কোটি টাকার ছবিটি ৬০ কোটি টাকায় কিনেছে। ওটিটি থেকে সুশান্ত সিংহ রাজপুতের শেষ ছবি ‘দিল বেচারা’-র বক্স অফিস সংগ্রহই হয়েছে ২০০০ কোটির কাছাকাছি।
টলিউড কিন্তু হিসেবনিকেশের এই দুনিয়ায় এখনও দুয়োরানি হয়েই আছে। টলিপাড়া সূত্রের খবর, এক বড় প্রযোজনা সংস্থা এক নামী পরিচালকের কাছে তাদের ওটিটি প্ল্যাটফর্মের জন্য ওই পরিচালকের নতুন বাংলাছবি কিনতে চাইলেও তিনি রাজি হননি। ওই পরিচালক নিজে প্রযোজকও বটে। তিনি হিসেব কষে দেখেছেন, ছবিটি হল-এ রিলিজ করালে দু’দিনের মাথায় তিনি ওটিটি-র প্রস্তাবিত অর্থ তুলতে পারবেন। ফলে সিনেমাহলে সফল হতে পারে, এমন ছবি ওটিটি প্ল্যাটফর্মে আনতে নারাজ তিনি।
তবে কিনা বাংলা ছবির ব্লকব্লাস্টার হওয়ার ঘটনা বিরল! এমন অনেক বাংলা ছবি আছে, যা সিনেমাহলেও চলবে না। ওটিটি-ও নেবে না! পরিচালক অরিন্দম শীলের কথায়, “বাংলা ছবির পরিচালকরা আর কত নিজেদের পিঠ চাপড়াবেন? অ্যামাজন, নেটফ্লিক্সে বাংলা ছবির দর নেই এটা সত্যি! অন্যান্য প্রাদেশিক ছবির তুলনায়ও আমরা পিছিয়ে আছি। এটা মেনে নিতে হবে। অ্যামাজন দর্শক পিছু প্রতি ঘণ্টা ভিউয়ারশিপে এখন বাংলা ছবির জন্য আড়াই টাকা দিচ্ছে। এই টাকায় কী হবে?” প্রসঙ্গত, অরিন্দমের পরিচালিত ‘ধনঞ্জয়’ এবং ‘আবার শবর’ অ্যামাজনে ভাল ফল করলেও হল-এ মুক্তি পাওয়ার পর সেগুলি ওটিটি-তে এসেছিল।
বাংলা ছবির দর কমে আসার পিছনে অন্যান্য কারণও আছে। ঘটনাচক্র বলছে, প্রযোজনা সংস্থা এসভিএফ ওটিটি প্ল্যাটফর্মে ছবি বিক্রির সময় অ্যামাজন থেকে টাকা পাওয়ার পরেই ছবি দিয়েছিল এসভিএফ। দেখাদেখি টলিউডের প্রযোজকদের লাইন পড়ে অ্যামাজন, নেটফ্লিক্সে ছবি বিক্রির জন্য। সুযোগ বুঝে অ্যামাজন, নেটফ্লিক্স এবং অন্যান্য ওটিটি ছবি নেওয়ার ক্ষেত্রে চালু করে নতুন নিয়ম— ‘পে পার ভিউ’। অর্থাৎ, দর্শক পিছু টাকা। ফলে একবারে থোক টাকা পেয়ে ছবি বিক্রি করার অবকাশ আর রইল না। বাজার পড়ে গেল বাংলা ছবির।
কী বলছেন পরিচালকেরা?
অ্যামাজন প্রাইম এবং নেটফ্লিক্সের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও তারা অবশ্য এ নিয়ে কোনও মন্তব্য করতে চায়নি।
এসভিএফ-এর অন্যতম কর্ণধার মহেন্দ্র সোনির অবশ্য বক্তব্য, বাংলা ছবি এখনও দুনিয়া জুড়ে চর্চিত। ওটিটি প্ল্যাটফর্মে বাংলা ছবি যাওয়া নিয়ে তাঁর সাফ বক্তব্য, “কোনও বড় বাজেটের বাংলা ছবির প্রিমিয়ার ওটিটি-তে হওয়া সম্ভব নয়। কারণ, ওটিটি বাংলা ছবির ডিজিটাল প্রিমিয়ারের জন্য যে পরিমাণ টাকা দেয়, তা থেকে ছবির খরচের ২০ শতাংশও ওঠে না!” প্রসঙ্গত, এসভিএফ তাদের অনলাইন প্ল্যাটফর্ম ‘হইচই’-এর জন্য ‘ডিটেকটিভ’, ‘তাসের ঘর’-এর মতো ছবি তৈরি করলেও ‘গোলন্দাজ’ বা ‘কাকাবাবুর প্রত্যাবর্তন’-এর মতো বড় বাজেটের ছবি যে সিনেমাহলেই রিলিজ করবে, তা স্পষ্ট করে জানিয়ে দিয়েছে।
সৃজিত মুখোপাধ্যায়ের ‘গুমনামী’ থেকে ‘চতুষ্কোণ’— সব ছবিই এখন ওটিটি-তে আছে। মহেন্দ্র সোনির সুরেই তিনি জানাচ্ছেন, অর্থনৈতিক কারণ ছাড়াও অভিনেতা থেকে ছবির কনটেন্ট উচ্চমানের হলে এখনও অ্যামাজন বা নেটফ্লিক্স বাংলা ছবি নেবে।
ওটিটি-তে ছবি কতটা লাভ করে? ‘তিন কাহন’-এর প্রসঙ্গ টেনে মুম্বই থেকে পরিচালক বৌদ্ধায়ন মুখোপাধ্যায় বললেন, ‘‘ওটিটি থেকে ছবির কোনও পরিসংখ্যান পাওয়া যায় না। বাংলা ছবির প্রযোজকেরা বেশির ভাগই এখনও হল-এ ছবি রিলিজ করতে চান।আর ওটিটি কতটা বাংলা ছবি নিয়ে আগ্রহী, সে প্রশ্নও থেকে যাচ্ছে।’’ প্রযোজনা সংস্থা ‘উইনন্ডোজ’-এর অন্যতম কর্ণধার তথা পরিচালক শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় অবশ্য স্পষ্টই বলছেন, ‘‘আমি থিয়েট্রিক্যাল রিলিজেই অভ্যস্ত। হল-এ রিলিজের জন্যই ছবি করার পক্ষপাতী। ওটিটি নয়, আমি হল খোলার অপেক্ষাতেই থাকব।’’
মুক্তির জন্য তৈরি কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘লক্ষ্মীছেলে’। পোস্ট প্রোডাকশনে রয়েছেতাঁর ‘অর্ধাঙ্গিনী’ এবং ‘কাবেরী অন্তর্ধান’। কৌশিক বলছেন, ওটিটি-র কথাভেবে ছবি হয় না। ছবি ওটিটি-তে চলে যায়। তাঁর কথায়, “এই ৩টি ছবি ওটিটি-র কথা ভেবে তৈরি হয়নি। পরিস্থিতি ওটিটি-কে সামনে এনেছে। তবে এই ছবিগুলো ওটিটি-তে যাবে কি না, তা ঠিক করবেন ছবির প্রযোজক। ওটিটি-তে কিন্তু মারাত্মক ভাল কাজ হচ্ছে। কিছু কাজ তো আমাদের বাংলা ছবির চেয়েও ভাল!” কৌশিক আশাবাদী, আগামী দিনে বাংলা ছবিও ওটিটি-তে রমরম করবে। ‘সিনেমাওয়ালা’-র মতো ছবির পরিচালক চান, বাংলা ছবি সিনেমাহলে আসুক। এ-ও বিশ্বাস করেন, পৃথিবীতে কোনও অতিমারি বছর দেড়েকের বেশি জ্বালায়নি। মানুষ যেমন মোবাইলে পাহাড় দেখবে না।
বেরিয়ে পড়বে। তেমনই সিনেমা লোকে হল-এ গিয়েইদেখবে। সঙ্গে থাকবে ওটিটি প্ল্যাটফর্ম।
বক্স অফিসে মুখ থুবড়ে পড়েছে 'সড়ক ২'
জি ফাইভে ‘টিকি টাকা’-র ডিজিটাল প্রিমিয়ারের পরে অভিনেতা-প্রযোজক পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়ের মনে হয়েছে অ্যামাজন, নেটফ্লিক্স মূলত হিন্দি আর ইংরেজি ছবিই দেখায়। সেখানে সাধারণ ভাবেই আঞ্চলিক ছবির জায়গা কম। তাঁর কথায়, “করোনার সময় হিন্দির পাশাপাশি কিছু বড় বাজেটের দক্ষিণ ভারতীয় ছবিও ওটিটি দেখাচ্ছে পেজ ভিউয়ের জন্য। পুরনো বাংলা ছবির
জায়গাও ওটিটি-তে আছে। হয়তো নতুন ছবির মানের জন্য বাংলা ছবি ওটিটি-তে এখনও জায়গা পাচ্ছে না।”
প্রযোজক অতনু রায়চৌধুরী আবার বলছেন, দেবকে নিয়ে করা ছবি ‘টনিক’ নেটফ্লিক্স কিনতে আগ্রহী হলেও তিনি ওটিটি-র চেয়ে প্রেক্ষাগৃহ নিয়েই আগ্রহী। অতুনার কথায়: “তেলুগু বা মালয়ালম প্রযোজকেরা ছবি তৈরি করে ওটিটি-তে দিয়ে পয়সা তুলে নিচ্ছেন। আমাদের সিনেমাহল ঘিরে একটা মূল্যবোধ আছে। আমরা তাই হল খোলার অপেক্ষায়।” তবে তিনিও মেনে নিচ্ছেন যে, বাংলা ছবির বিষয়বস্তু ওটিটি প্ল্যাটফর্মের চাহিদা মেটাতে পারছে না।
শেষ কুড়ি বছরে কোনও বাংলা ছবি দিয়ে বার্লিন বা কান ফেস্টিভ্যালের উদ্বোধন হয়নি। অন্য দিকে, এমন বাংলা ছবিও হয়নি, যে দ্যাখ-দ্যাখ করে ১০০ কোটি টাকার ব্যবসা দিয়েছে। বাংলা সিনেমার ভবিষ্যৎ এমনিতেই খুব আশাপ্রদ নয়। ওটিটি-তে দুয়োরানি হয়ে থাকাটা সেই অন্ধকার সম্ভবত আরও খানিকটা গা়ঢ় করে দিয়ে গেল।