ওয়াহিদা রেহমান। ছবি: পিটিআই।
‘‘সবচেয়ে আনন্দ কেন হচ্ছে জানো? আজ দেব আনন্দের জন্মদিন।’’
দেব আনন্দের শতবর্ষের জন্মদিনেই ঘোষণা করা হল ২০২৩ সালের দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কার। পুরস্কার পাচ্ছেন দেবের অন্যতমা নায়িকা ওয়াহিদা রেহমান। সুখবরটা পাওয়ার মিনিট কুড়ির মধ্যে ফোনে ধরা গেল তাঁকে। গলায় তখনও উচ্ছ্বাস টাটকা। বললেন, ‘‘এমন একটা দিনে এই সুখবর পেলাম! দেব নিশ্চয় দেখছেন যেখানেই থাকুন।’’
১৯৫৬ সালে ‘সিআইডি’র সেটে ওয়াহিদাকে প্রথম বার দেখেই দেব বলেছিলেন, “আমাকে দেব বলেই ডেকো কেমন? দেবসাব নয়। আনন্দজি তো একেবারেই নয়!” আজ ওয়াহিদার আনন্দ মুহূর্তে ‘রাজু গাইড’-এর স্মৃতি তো মিশে থাকবেই। দেব আনন্দের সঙ্গে ওয়াহিদার রুপোলি পর্দার রোমান্স পঞ্চাশ এবং ষাটের দশক জুড়ে ভাসিয়ে দিয়েছিল কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারিকা। সিআইডি, সোলওয়াঁ সাল, কালা বাজার, বাত এক রাত কি, গাইড, প্রেম পূজারি— একের পর হিট ছবি দিয়েছেন এই জুটি।
কেন্দ্রীয় তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী অনুরাগ ঠাকুর আজ এই পুরস্কার ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে এক দীর্ঘ বিবৃতি দিয়েছেন। নিজের এক্স (সাবেক টুইটার) হ্যান্ডলে তিনি লেখেন, ‘‘ভারতীয় সিনেমায় ওঁর অসাধারণ কৃতিত্বের জন্য ওয়াহিদা রেহমানজির হাতে দাদাসাহেব ফালকে জীবনকৃতি পুরস্কার তুলে দেওয়া হবে। এই ঘোষণা করতে পেরে অত্যন্ত আনন্দ ও গর্ব বোধ করছি। হিন্দি ছবিতে তাঁর কাজ সমালোচকদের দ্বারা বিশেষ ভাবে প্রশংসিত হয়েছে। তার মধ্যে পিয়াসা, কাগজ কে ফুল, সাহেব বিবি অউর গোলাম, গাইড, খামোশী এবং আরও কিছু ছবি।’’
কেন্দ্রীয় মন্ত্রীকে ‘আন্তরিক কৃতজ্ঞতা’ জানিয়েছেন ওয়াহিদাও। তাঁর কথায়, ‘‘সিনেমার জগতে এক দীর্ঘ পথ পেরিয়ে এলাম। উপরওয়ালা সহায় না হলে সম্ভব ছিল না। আমার সমস্ত বন্ধুকে কৃতজ্ঞতা জানাই। আমি কৃতজ্ঞ তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রকের কাছে, বিচারকমণ্ডলীর কাছে, যাঁরা আমাকে এই সম্মানের জন্য উপযুক্ত মনে করছেন। যে জিনিস সম্মানের সঙ্গে, ভালবাসার সঙ্গে দেওয়া হয়, তার দামই আলাদা।’’
এত ছবি করেছেন, কিন্তু কোন দু’টি ছবিকে আলাদা করে উল্লেখ করতে চাইবেন আজ? জানতে চাওয়ায় ওয়াহিদার জবাব, ‘‘গাইড তো অবশ্যই। আর পিয়াসা। এই দু’টি ছবিতে কাজ করে বিশেষ আনন্দ পেয়েছি। মানুষ আমার অভিনয়কে ভালবাসায় ভরিয়ে দিয়েছেন। এখনও যেখানে যাই, এই দু’টি ছবির প্রতি ভালবাসার কথা মানুষ জানাতে ভোলেন না।’’
‘রে’ অর্থাৎ সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে কাজের অভিজ্ঞতার কথাও কখনওই ভোলেননি ওয়াহিদা। ষাটের দশকের গোড়ায় ‘অভিযান’ ছবিতে ‘গুলাবি’র চরিত্রে যখন অভিনয় করতে বাংলায় যান, তখন খুবই নার্ভাস অবস্থা তাঁর। অবশ্য সেটা কয়েক দিন বাদেই কেটে যায়। ওয়াহিদা বলছিলেন, ‘‘ইউনিটের সবাই হাসিঠাট্টা করে পরিস্থিতি সহজ করে দিয়েছিলেন। বিশেষ করে সৌমিত্র (চট্টোপাধ্যায়)। কয়েক দিনের মধ্যেই মানিয়ে নিয়েছিলাম আদ্যন্ত বাঙালি ইউনিটের সঙ্গে। কখনও মনে হয়নি নিজের কর্মক্ষেত্র থেকে দূরে আছি। ওই ছবিতে সৌমিত্র ছাড়া আরও একজনের কথা মনে পড়ে যিনিও আমাদের মধ্যে নেই। তিনি রবি ঘোষ। অবশ্য রবির সঙ্গে আমার নিজস্ব বন্ধুত্ব খুব জমেনি। কারণ হিন্দিতে উনি একদমই সড়গড় ছিলেন না আর আমি সড়গড় ছিলাম না বাংলায়!’’
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের প্রয়াণের পরে আনন্দবাজারকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে ‘অভিযান’ ছবি সংক্রান্ত একটি মজার ঘটনা শুনিয়েছিলেন ওয়াহিদা। ঘটনাটি তাঁর সামনে ঘটেনি, কিন্তু পরে সৌমিত্র অভিনয় করে দেখানোয় তিনি হেসে খুন। ওয়াহিদার কথায়, ‘‘অভিযান ছবিতে আমায় নেওয়ার কথা উনি আর ‘রে’ আলোচনা করছেন একটি ঘরে বসে, রাতের বেলা। হঠাৎ দেখেন সেই ঘরের জানলার কাচে আমার মুখ! দু’জনেই নাকি বেদম চমকে উঠেছিলেন। ভেবেছিলেন ভৌতিক কাণ্ড। পরে বোঝা যায় রহস্যটা কী। তখন কলকাতার গলিতে পর্দা খাটিয়ে প্রজেক্টরে ছবি দেখানো হত। আমার ছবি পর্দায় পড়ে তার প্রতিবিম্ব জানলার কাচে এসে পড়েছিল। ঘটনাচক্রে তাঁরা তখন আমাকে নিয়েই আলোচনা করছিলেন। সৌমিত্র এই ঘটনাটা পরে আমায় নিখুঁত অভিনয় করে দেখিয়েছিলেন।’’