‘চালচিত্র এখন’ ছবিতে অঞ্জন দত্ত। ছবি: সংগৃহীত।
মৃণাল সেনের শতবর্ষে অঞ্জন দত্ত তাঁকে উৎসর্গ করে ‘চালচিত্র এখন’ ছবিটি বানাবেন। গত বছর (২০২৩) এপ্রিলের এক প্রবল গরমের দুপুরে সদ্য লিখে ফেলা সেই টাটকা চিত্রনাট্যটি শোনার আহ্বান পেয়েই তাই ছুটে গিয়েছিলাম বেনেপুকুরে অঞ্জনদার চেনা ঠিকানায়। তখনও জানতাম না, এ ছবির একটি চরিত্রে আমাকে অভিনয় করতে হবে। গোটা শুটিংয়ে আরও নানা ভূমিকায় জড়িয়ে পড়ব ছবিটির সঙ্গে। নানা সাক্ষাৎকার নেওয়ার সূত্রে শুধু এটুকু জেনেছিলাম যে, তাঁর ‘মেন্টর’ মৃণাল সেনের সঙ্গে অঞ্জনদার সম্পর্ক নিয়েই হবে ছবিটি। এর আগে গুরুকে নিয়ে একটি তথ্যচিত্র বানাতে চেয়েও পারেননি তিনি। তাই মৃণালবাবু ‘চালচিত্র’ ছবিটি শুটিং করার সময়ে তাঁর সঙ্গে আলাপ ও ঠিক যা যা ঘটেছিল, সবটাই পর পর সাজাচ্ছেন নিজের স্ক্রিপ্টে তিনি। এমন একটা ইতিহাসের দলিলের সঙ্গে থাকতে পারার উত্তেজনা নিঃসন্দেহে এপ্রিল মাসের গরমের চেয়েও বেশি ছিল।
স্ক্রিপ্টটা শোনার পর প্রথম এটাই মনে হয়েছিল, এ ছবিটিতে মৃণালবাবুকে কোনও দামি আসনে বসিয়ে পুজো করেননি অঞ্জন। তর্ক করেছেন, ঝগড়া করেছেন, বন্ধুতা করেছেন, ব্যক্তিগত কথাবার্তাও ঢাকেননি— ঠিক যেমন ছিল তাঁদের সম্পর্ক আসলে। সত্তরের দশকে অঞ্জন আন্তর্জাতিক ব্যতিক্রমী থিয়েটার করতেন কলকাতায়। ম্যাক্স মুলার ভবনে জঁ জেনে, পেটার ভাইস, মুলার, ব্রেখটের সেই সব প্রযোজনার রেফারেন্স থাকছে ছবিতে। জঁ জেনের নাটক অশ্লীল তকমায় বন্ধ করে দেওয়াকে ঘিরেই মৃণালবাবুর সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ঘন হয়। এই সবই বলতেন অঞ্জন। কিন্তু সে নাটকের দলের ছেলেদের খুঁজতে হবে এ বার। তার দায়িত্বও পড়ল আমার উপর।
বেশ কিছু বন্ধুকে নিয়ে হাজির হলাম পরের দিনের ওয়ার্কশপে। সে দিন জানলাম কে কে মহাজন করছেন সুপ্রভাত রায়, অল্পবয়সি অঞ্জন করছেন শাওন চক্রবর্তী। উৎপল দত্তের ভূমিকায় আছেন শেখর দাস, মৃণালবাবুর প্রোডাকশান কন্ট্রোলারের ভূমিকায় আছেন শুভাশিস মুখোপাধ্যায়। মৃণালবাবুর শ্যালক অনুপকুমারের ভূমিকায় থাকবেন রূপঙ্কর। অল্পবয়সিদের নিয়ে একটি ওয়ার্কশপ হয়েছিল সে দিন। অঞ্জনদা বলেছিলেন, সবার জীবনের সবচেয়ে দুঃখের কথা ভেবে বলতে। অনেকেই সে কথা বলতে বলতে কেঁদে ফেলেছিলেন সে দিন। পরে তাঁদের বেছে নিয়েই তৈরি করা হয় সিনেমায় অল্পবয়সি অঞ্জনের থিয়েটার দল। অঞ্জনদা ছবিটিতে চাইছিলেন বিখ্যাত চৈনিক সিনেমা পরিচালক ওং কার ওয়াইয়ের ছবির ট্রিটমেন্ট। সে ব্যবহার বুঝতে একসঙ্গে সবাই বসে দেখেছিলাম ওং কার ওয়াইয়ের নানা ছবি।
শুটিং ফ্লোরে মৃণাল সেনের সঙ্গে অঞ্জন দত্ত। —ফাইল চিত্র।
মৃণাল-পুত্র কুণাল সেন জানতেন গীতা-মৃণালের বেলতলার ফ্ল্যাটেই এই ছবির শুটিং হবে। তখনও বেলতলার ফ্ল্যাটটি বিক্রি হওয়ার প্রসঙ্গ ওঠেনি। সেই ফ্ল্যাটেই ছবিটির শুটিং থাকছে জানলাম। জানলাম, শুটিংয়ের জন্য নোনাপুকুরের ট্রাম ভাড়া করা হবে। বেলেঘাটার আর একটি বাড়িতে হবে মৃণালবাবুর ‘চালচিত্র’ ছবিটির বেশ কিছু দৃশ্যের পুনর্নির্মাণ। গোটা ছবিটিই নিজের খরচে বানাচ্ছেন অঞ্জন। সুতরাং অল্প বাজেটেই বানানো হবে ছবিটি। কারণ মৃণালবাবু বিশ্বাস করতেন, একমাত্র ভাল ছবি সম্ভব হবে তখনই, যখন তার বাজেট অল্প থাকবে। আর ছবি জুড়ে থাকবে কলকাতার উদ্যাপন, যে শহর ছেড়ে দুনিয়ার কোনও শহরে যেতে চাননি তিনি। কারণ এ শহরই তাঁর ‘এল ডোরাডো’।
অনেক আলোচনার পর এল সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। অঞ্জনদা জানালেন, আমাকে করতে হবে মৃণালবাবুর স্টিল ফোটোগ্রাফার সুভাষ নন্দীর চরিত্র। ছবিতে তাঁর নাম বদলে যাবে। মৃণালবাবুর বেলতলার ফ্ল্যাটে সকাল-সকাল হাজির হলাম শুটিংয়ে। সাদা পাজামা-পাঞ্জাবিতে মোটা চশমার ফ্রেমের অঞ্জনদাকে প্রথমে দেখে চিনতে পারিনি। মনে হল, স্বয়ং মৃণালবাবুই হেঁটে-চলে বেড়াচ্ছেন যেন তাঁর চেনা চার তলার ফ্ল্যাটে। প্রতিবেশীরাও বেশ চমকালেন কয়েক বার। পরে তাঁরা বুঝলেন শুটিং চলছে। মৃণালবাবু মানেই তো কলকাতার রাস্তা, সে রাস্তা বা গলিতেও, অনেকেই শুটিং চলার সময়ে অঞ্জনদাকে দেখে চমকেছেন— এতটাই মৃণালবাবুর মতো লাগছিল তাঁকে। স্কটিশ চার্চ কলেজের সামনে শুটিংয়ের সময় অঞ্জনদা যে ভাবে দ্রুত শট নিয়েই গাড়িতে উঠে পড়ছিলেন ‘মবড’ না হওয়ার ভয়ে, তা চিরকাল মনে থাকবে!
অঞ্জনদা নিজের স্মৃতি থেকেই তুলে আনছেন এক একটা মুহূর্ত। সেই স্মৃতিকেই শুট করা হচ্ছে ধীরে ধীরে। অতীতের স্মৃতি ও বর্তমান শ্রম মিলে গড়ে উঠছে সিনেমার মুহূর্ত। এই অভিজ্ঞতার কোনও তুলনা ছিল না এ ছবিতে।
ক্যামেরায় চোখ রেখে অঞ্জনদা বললেন, ‘অ্যাকশন!’ নির্দেশ মতো আমিও করে ফেললাম আমার সে দিনের অভিনয়। সত্তর দশকের একটা ঐতিহাসিক মুহূর্তে ফিরে গেলাম কিছু ক্ষণের জন্য। ‘কাট’ বলার পরেও যে মুহূর্ত আমার সঙ্গী থেকে যাবে আজীবন। শুট শেষে মৃণালবাবুর বইপত্র ঘাঁটতে গিয়ে দেখলাম ‘ইডিপাস রেক্স’ বইটি। হাতে নিয়ে খুলতেই দেখলাম, সেটি অঞ্জনকে উপহার দিয়েছিলেন তিনি। ফেরার আগে এক বার গিয়েছিলাম মৃণালবাবুর শোয়ার ঘরে। যে ঘরে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত কাটিয়েছিলেন বিশ্বসিনেমার ‘এনফ্যান্ট টেরেবল’ এই মানুষটি। পাশে রাখা ফোন থেকে কথা বলেছেন হয়তো বন্ধু মার্কেজ় বা গদারের সঙ্গে। অবাক হয়ে দেখছিলাম সবটা। তার পর চোখ গেল খাটের পাশের জানলায়, সে জানলা থেকে দেখা যাচ্ছে দ্বিতীয় হুগলি সেতু, ভিক্টোরিয়া স্মৃতিসৌধ আর সেন্ট পলসের চূড়া। মৃণালবাবুর স্বপ্নের ‘এল ডোরাডো’, কলকাতা! যে শহরে প্রায় বেকার জীবন কাটিয়েছেন তিনি যৌবনে, গীতা সেনের সঙ্গে উত্তরপাড়া ব্রিজে প্রেম করেছেন, মালা-বেলা নামের মেয়েরা এক রাত বাড়ি না-ফেরার সমাজ নিয়ে তাঁর ছবিতে ঢুকে পড়েছে, দাশ বা বসন্ত কেবিনের যে আড্ডারা, লাল ফুল ফুটে থাকা বিকেলের গান শেখার স্কুলের যে পাড়া, মিছিলের মাঝে চকিতে যে ক্যামেরা নিয়ে ঢুকে পড়ার দ্রোহ, খবর কাগজ থেকে যে ছবির ফ্রেম পেড়ে আনার মুনশিয়ানা– বাদল সরকার, বারীন সাহা, সন্দীপন, আইপিটিএ, বামপন্থা— এই সমস্তটা ছিল যে শহরে তাঁর জগৎ...আবেগ, ‘এনগেজমেন্ট’, তর্ক আর ‘ক্রিটিক্যালিটি’ই ছিল তাঁর ছবিতে যে শহরের মানসিকতা...
পরের দিনের শুটিং ছিল অঞ্জনদার বাড়িতেই। বাড়িতে ঢুকে চিনতে পারিনি বাড়িটিকে, কারণ ইতিউতি ছড়িয়ে শুটিং ইউনিটের লোকেরা, যন্ত্রপাতি। নীল দত্ত এ ছবিতে সঙ্গীতের পাশাপাশি, ছবি প্রযোজনার গুরুদায়িত্বও বহন করেছেন। আমাকে জানিয়েছিলেন, একটা পুরোনো গিটার আনতে ওই দিন, যেটা একটি বিশেষ মুহূর্তে ভেঙে ফেলা হবে। সেই মতো হাজির হয়েছিলাম গিটারটা নিয়ে। পরপর শট হতে হতে অবশেষে এল সেই মুহূর্ত। ঝগড়ার মুহূর্তে দড়াম করে ভেঙে ফেলা হল গিটারটা। হালকা ব্যথা করল মনে। কিন্তু সান্ত্বনা দিলাম নিজেকে, গিটারটারও বয়স হয়েছিল। তাই এ সিনেমাতে অন্তত ধরা থাকল তার জরাগ্রস্ত শরীর, আজীবনের জন্য।
নন্দনে কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের আন্তর্জাতিক বিভাগে প্রথম দেখানো হল ছবিটি। গত বছরে। পুরস্কারও পেল। সে দিন হলে হাজির ছিলেন অনেক ব্যক্তিত্বই। ছবি শেষের হলজোড়া মানুষের হাততালি আর চোখের জল দেখে মনে পড়ছিল শুটিংয়ের দিনগুলো। অঞ্জনদা নিজের জীবনের একটা অধ্যায়কে খামচে তুলে এনে ছেড়ে দিয়েছেন পর্দায়। আজ সে সময় হয়তো নেই। শহর বদলেছে। কিন্তু ‘ক্রাইসিস’গুলো বদলে যায়নি, বিশ্বাস করেন অঞ্জন। তাই ‘রিল’ আর ‘রিয়েল’ সময় একাকার করে দিয়েছেন এ ছবিতে। কারণ মৃণালবাবু নিজেও বিশ্বাস করতেন না এ বিভাজনে, আজীবন। স্বপ্ন আমরা অনেকেই দেখি কিন্তু তা সত্যি হয় কখনও কখনও। অঞ্জনদার সেই প্রথম দিনের স্ক্রিপ্ট পড়াটা আজও চোখে ভাসছে... আগামী ১০ মে ছবিটি মুক্তি পাচ্ছে। সে দিন হয়তো আবার টের পাব, স্বপ্ন সত্যি হলে কখনও, সেটা সেটা সত্যিকারের জীবনের থেকে ক-ত-টা বৃহদাকার ধারণ করতে সক্ষম হয় আসলে... হতে পারে কতটা সত্যিকারের এল ডোরাডো…