রাণী রাসমণির ভূমিকায় দিতিপ্রিয়া। গ্রাফিক: তিয়াসা দাস।
ইতিহাসের রাসমণি অতি দীর্ঘজীবী। ১৭৯৩ থেকে ১৮৬১ অবধি তিনি বেঁচেছিলেন। তিনি ছিলেন একাহারী। নিরামিষ খেতেন। সম্পূর্ণ ধার্মিক জীবন কাটিয়েছিলেন। কিন্ত ধারাবাহিকের রাসমণি ইতিহাসকেও ছাপিয়ে এক হাজার এপিসোডে পা দিলেন। ধারাবাহিকের রানিমাও ছোট বয়সের রাসমণি থেকে চুলে পাক ধরা বিধবার চরিত্রে অসাধারণ অভিনয়ে এক নম্বরে পৌঁছে দিয়েছেন ধারাবাহিককে। দিতিপ্রিয়া রায়ের ম্যাজিকাল প্রেজেন্সে মুগ্ধ বিশ্বের বাঙালি। আগে বাংলা টেলিপর্দায় আর কোনও নাবালিকা অভিনেত্রীকে তিরিশ বছরের মায়ের চরিত্রে এত সফল ভাবে অভিনয় করতে দেখা যায়নি। রানির চরিত্রে দিতিপ্রিয়া রায় নিঃসন্দেহে একটি ফেনোমেনন।
ভাবেননি কেউ, এই ধারাবাহিক এক হাজার এপিসোড ছোঁবে। প্রথম স্লটে সন্ধে সাড়ে ৬টায় রাসমণিকে রাখাও হয়নি। ভাবেননি কেউ, রাসমণির সব বয়সের চেহারাতেই দিতিপ্রিয়া থাকবেন। দিতিপ্রিয়া জানিয়েছেন, তাঁকে বলা হয়েছিল তিন মাসের কাজ। তার পর কারা কারা রাসমণির চরিত্রে করবে সেটাও নাকি ঠিক হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু দর্শকেরা বলেই দিয়েছিলেন, দিতিপ্রিয়া না থাকলে তাঁরা রাসমণি দেখবে না। ‘‘স্বয়ং রানিমার পরিবারের অনেকে চেয়েছিলেন রাসমণির পরিবর্তন হোক। কিন্তু দিতিপ্রিয়াকে সাধুবাদ, পরিণত বয়সের রাসমণিকে ও অভিনয় দিয়ে ধরে রেখেছে।’’ যোগ করলেন 'জি বাংলা'-র ‘করুণাময়ী রানি রাসমণি’ ধারাবাহিকের গবেষক শিবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায়। আসলে ‘আর্কিটাইপল আইডেন্টিটি’-র বদল হয় না। সেই কারণে রাসমণির মতোই ‘মহাপ্রভু’ ধারাবাহিকে চৈতন্যদেব হিসেবে যিশু সেনগুপ্তের বদল হয়নি কখনও।
রাসমণির যে ছবি পাওয়া যায় তাতে তিনি সুন্দরী, বড়লোক বাড়ির বউ। বয়সের কোনও ছাপ নেই। বোঝা যায় নিজেকে যথেষ্ট যত্ন করতেন। অধিকাংশ দিন স্বপাকে খেতেন। এই ভাবেই রাসমণি এসেছেন ধারাবাহিকে। লোকে এই গ্রাম্য, অশিক্ষিত মেয়ের ক্রমশ তৈরি হওয়া ব্যক্তিত্ব, বনেদিয়ানা আর আভিজাত্য মুগ্ধ হয়ে দেখেছে। এই অশিক্ষিত রাসমণির উত্থান, লড়াইকে দর্শক নিজের জয় হিসেবেও দেখেছেন বলে মনে করছেন শিবাশিস। তিনি বললেন, ‘‘পূর্বতন প্রযোজক সুব্রত রায়ের অবদানের কথা ভুললে চলবে না। চ্যানেল প্রচুর টাকা খরচ করেছে এই ধারাবাহিকে। আর রাসমণির জীবনীকার থেকে আর্কাইভাল যা তথ্য পাওয়া যায় তার মাধ্যমেই রাসমণি কিন্তু দাঁড়িয়ে আছে।’’
দর্শকমন জয় করেছে টিম রাসমণি।
রাসমণি নিয়ে ধারাবাহিক যদিও এই প্রথম নয়। ‘রাজেশ্বরী’ ধারাবাহিকে রানি রাসমণিকে দেখানো হলেও এত পুঙ্খানুপুঙ্খ ঘটনাপ্রবাহ চোখে পড়েনি। রাসমণি হিসেবে অনুরাধা রায় যথেষ্ট জনপ্রিয় হয়েছিলেন। পরবর্তীকালে বাংলা ধারাবাহিকের মোড় ঘুরে যায় সম্পর্কের গল্পের দিকে। সেখানেও আসে একঘেয়েমি। সম্পর্কের কুটকচাল থেকে ইতিহাসকে জীবন্ত দলিলের চেহারায় নিয়ে এল রাসমণি।’’ ইতিহাসের গল্প, রামকৃষ্ণের লীলা আর রাসমণির বৈচিত্রময় জীবন যে আমরা তুলে ধরতে পারছি, এটাই সবচেয়ে ভাল লাগার’’, আবেগ রাসমণি ধারাবাহিকের লেখক শাশ্বতী রায়ের। ইতিহাসে গল্প জোড়া হয়েছে প্রথম থেকেই।
আরও পড়ুন: নেই কোনও ‘গডফাদার’, প্রতিভাবান হয়েও তাই বলিউডে ব্রাত্যই থাকেন এই বহিরাগতরা
রাসমণির প্রথম জীবন নিয়ে বিশেষ কিছু জানা যায় না। শোনা যায়, রায়চন্দ্র দাস পুকুরে একটি মেয়েকে স্নান করতে দেখেন। তাকে ভাল লাগে। তাকে বিয়ে করেন। সেই সূত্র ধরেই ধারাবাহিকে গল্প তৈরি হতে থাকে। গ্রামের মেয়ে রাজ পরিবারে এলে তার কী সমস্যা হতে পারে? রাসমণির জীবনের মধ্যে এই মেগা কনটেন্ট ধারাবাহিকের সাফল্যের অন্যতম কারণ। অন্য দিকে তার সঙ্গেই চলে ইতিহাস, সতীদাহ, বিধবা বিবাহ...। ‘‘ব্যক্তিজীবনের মেগা কনটেন্ট আর ইতিহাস দুটো মিশেছে বলেই আজ হাজার এপিসোড হচ্ছে’’, বললেন শাশ্বতী।
রানি রাসমণির সব বয়সের চরিত্রেই দিতিপ্রিয়াকে সাদরে গ্রহণ করেছেন দর্শক।
সব বাঙালির ‘প্রথম আলো’ বা ‘সেই সময়’ পড়া হয়নি। বাঙালি দর্শক সচরাচর যা দেখেনি সেটা তারা দেখল, সঙ্গে এক সাধারণ মেয়ের উত্থানের কাহিনি। রানি রাসমণি আর পাঁচটা বাঙালি বউয়ের চরিত্র হয়ে এল। মানুষ নিজেকে খুঁজতে থাকল। রাসমণির স্বামী রাজচন্দ্র দাস সামাজিক কাজ করছেন, সেই কাজে পর্দানসীন রাসমণির সমর্থন ছিল। স্বামী চলে যাওয়ার পর তিনি জানবাজারের জমিদারি নিজের হাতে নিলেন। তার পরে তাঁর রামকৃষ্ণের সঙ্গে দেখা। ভোগিনী থেকে রাসমণির যোগিনী হওয়ার পর্ব। এক মেয়ের জীবনে দাম্পত্য, একার সংসার, জমিদারি চালনা, আধ্যাত্মবাদ সব জুড়ে আছে। এত বৈচিত্রই রাসমণির তুমুল জনপ্রিয়তার কারণ। অন্য দিকে এই ধারাবাহিক নিঃসন্দেহে মিউজিক্যাল। সঙ্গীত আয়োজক উপালি চট্টোপাধ্যায় কবিগান, তর্জা, ঢঙ, কীর্তন, টপ্পা, রূপচাদ পক্ষ্মী— সব কিছুই ব্যবহার করেছেন এই ধারাবাহিকে। ‘‘শ্যামাসঙ্গীতের এমন কোনও পদ নেই যা রাসমণিতে ব্যবহার হয়নি। এই সব উপাদান ঠিকমতো কাজ করেছে বলেই রাসমণি এত জনপ্রিয় হল’’, বললেন শিবাশিস। ফলত কখনওই দর্শকের একঘেয়েমি আসেনি।
আরও পড়ুন: ‘বউ সামলাতে পারেনি, আবার অন্যকে জ্ঞান দিচ্ছে!’ মুখ খুলতেই ট্রোলড অনুরাগ
শোনা যাচ্ছে, হাজার এপিসোডে মা ভবতারিণীর দেখা পাবেন রামকৃষ্ণ। কিন্তু তাঁকে সবাই ভণ্ড বলবে। রামকৃষ্ণ তথা গদাধরের শক্তিকে প্রতিষ্ঠা করবেন রাসমণির জামাই মথুরামোহন। এই জার্নির শুরু হাজার পর্ব থেকে।
'রাণী রাসমণি'-র একটি দৃশ্য।