স্ত্রী-র অসুখ, গাইতে বসলেন মান্না দে

মান্না দে কলকাতায় আসা মানেই বাড়িতে ১৪ কেজি পাঁঠার মাংস-লিখছেন দেবপ্রসাদ চক্রবর্তী মহঃ রফি সবাইকে এমন অভ্যর্থনা জানালেন, এমন বিনীত ভাবে আপ্যায়ন করলেন অতিথিরা অত্যন্ত লজ্জায় পড়ে গেলেন। তখন রফি সাহেব যে সব গান গাইছেন, তার জনপ্রিয়তা কোনও হিরোর থেকে কম কিছু নয়। তাঁকে একবার দেখার জন্য মানুষ পাগল।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০৮ সেপ্টেম্বর ২০১৬ ০০:০০
Share:

মহঃ রফি সবাইকে এমন অভ্যর্থনা জানালেন, এমন বিনীত ভাবে আপ্যায়ন করলেন অতিথিরা অত্যন্ত লজ্জায় পড়ে গেলেন। তখন রফি সাহেব যে সব গান গাইছেন, তার জনপ্রিয়তা কোনও হিরোর থেকে কম কিছু নয়। তাঁকে একবার দেখার জন্য মানুষ পাগল। মান্নাদার কিছু ঘনিষ্ঠ আত্মীয় মুম্বই এসেছে। খুব ইচ্ছে কাছ থেকে রফিকে দেখা, সুযোগ পেলে দু’একটা কথা বলা। ভয়ে ভয়ে ইচ্ছের কথা মান্নাদাকে জানানো হল। মান্নাদা ফোন করলেন—‘রফিমিঞা, ওরা একটু তোমার সঙ্গে আলাপ করতে চায়।’ মান্নাদাকে অত্যন্ত শ্রদ্ধা করতেন রফিজি। সব সময় বলতেন, মান্নাদার গান শুনে অনেক কিছু শেখা যায়। তিনিও শিখেছেন। মান্নাদার আত্মীয়রা এসেছেন। মনে হল রফিজিই যেন ধন্য হয়ে গেছেন। হাত জোড় করে সবাইকে নমস্কার করলেন। খুব আস্তে আস্তে কথা বলতেন। সবার কুশল জিজ্ঞাসা করলেন। বেশ কিছুক্ষণ গল্প-গুজব হল। রফিজি বারবার বলছেন, ‘আমি তো মান্নাদাকা কুটুম হ্যায়। বলিয়ে, আপ কে লিয়ে ক্যা কর সকতা?’ এমনই শ্রদ্ধা মান্নাদার জন্য।

Advertisement

মান্নাদার জন্য দারা সিংহের বাইসেপেও হাত বোলানো যায়। ঘটনাটা বলি। অনেক বছর আগের কথা। মুকুল দে, মানে মান্নাদার সব থেকে বড় ভাইপো, মুম্বই গেছে মান্নাদার কাছে। বহু দিন ধরে একটা ইচ্ছে মনের মধ্যে। কলকাতায় ফোর্টউইলিয়ামে বাবার সঙ্গে প্রায় যেতেন কুস্তি প্রতিযোগিতা দেখতে। ওখানেই দেখেছেন দারা সিংহের কুস্তি। সেই থেকে দারা সিংহকে সামনে থেকে দেখার ইচ্ছে। একেই নামকরা কুস্তিগীর, তার উপরে পর পর সিনেমাতে অভিনয় করছেন। মান্নাদা শুনে-টুনে বললেন, দেখি কী করা যায়। ভীষণ ব্যস্ত সিডিউল। ভাগ্য প্রসন্ন থাকলে যা হয়। একদিন সময় বের করে মান্নাদা নিজেই ড্রাইভ করে মুকুলকে সঙ্গে নিয়ে চলে এলেন দারা সিংহের বাড়ি। বাড়িতেই কুস্তির আখড়া। সেখানে কোদাল দিয়ে মাটি কুপিয়ে কোনও শারীরিক কসরত করছিলেন। মান্নাদাদের দেখে ব্যস্ত হয়ে ছুটে এলেন। চোখে-মুখে আনন্দ উপচে পড়ছে। কী সৌভাগ্য। মান্নাদা এসেছেন তার বাড়িতে। সুন্দর একটা দোলনা ছিল সেখানে। দারাজি বসলেন সেখানে। সামনে চেয়ারে মান্নাদা, মুকুল। জমিয়ে আড্ডা চলছে। এ বার স্পেশ্যাল অতিথি আপ্যায়ন। মানন্নাদার মতো অতিথি। একটা দারুণ ব্যাপার। বড় গ্লাস ভর্তি লস্যি এল। ট্রে-তে আরও বড় দুটো পাত্র। দারা সিংহ সস্নেহে মুকুলকে বললেন, ‘খোকা, লস্যি কা সাথ ক্যা লেঙ্গে—ঘি অর মালাই। আপ মান্নাদাকা ভাতিজা। মুঝে তো কুছ করনা হোগা।’ দেখে-শুনে মুকুলের তো সাহস বেড়ে গেছে। এ বার আবদার করে বসল, ‘একটু বাইসেপটা ধরে দেখব।’ দারা সিংহ হেসে বললেন, ‘হা হা, কিউ নেহি, দেখো, দেখো।’ অবাক কাণ্ড। অত বড় বাইসেপ কিন্তু একেবারে তুলোর মতো নরম। মুকুল অবাক হয়ে দারাজির দিকে তাকালেন। দারা সিংহের মুখে দুষ্টু হাসি। বললেন, ‘ফির দেখো, বেটা।’ কিশোর মুকুল এ বার আরও অবাক। একই বাইসেপ, এ বার লোহার মতো শক্ত। আঙুল তো দুরের কথা, দাঁত ফোটালে, দাঁতও ভেঙে যাবে নির্ঘাত।

এই ঘটনা বলতে বলতে আর একটা গল্প মনে পড়ল। গল্প তো নয়, সত্যি ঘটনা। কলকাতার টেকনিসিয়ান স্টুডিয়োতে সুটিং চলছে। মান্নাদাকে নিয়ে টিভি সিরিয়াল—‘স্বপ্নের গান, স্বপ্নের নায়ক’। পরিচালক অভিনেতা পার্থ মুখোপাধ্যায়। মূলত তার এবং সুরকার অসীমা মুখোপাধ্যায়ের উদ্যোগে বাংলায় এই মূল্যবান কাজটি হচ্ছে। সে কথায় পরে আসছি। যে কথা বলছিলাম। মান্নাদাকে এত ব্যস্ত সিডিউলের মধ্যেও অভিনয় করতে রাজি করানো গেছে। ফ্লোরে বসে স্ক্রিপ্টে চোখ বোলাচ্ছেন। অল্প বয়সি একটি ছেলে ফ্লোরে কাজ করছিল। খুব গরম। ছেলেটি জামা খুলে শুধু স্যান্ডো গেঞ্জি পরে এক মনে কাজ করছে। মান্নাদার রস-বোধ তো সবাই জানেন। গম্ভীর ভাবে ছেলেটিকে কাছে ডেকে বললেন, ‘কী ব্যাপার ভাই, আমাকে মাসল্ দেখানো হচ্ছে? বেশ, এক খেপ লড়াই হয়ে যাক তা হলে। আমিও একটু-আধটু কুস্তি লড়েছি ভাই। চলো হয়ে যাক।’ সেই কর্মীটির অবস্থা ভাবুন। লজ্জায় একেবারে জড়োসড়ো হয়ে গেল। মান্নাদা এ বার সস্নেহে বললেন, ‘তোমার সঙ্গে একটু মজা করলাম। খুব সুন্দর স্বাস্থ্য তোমার। তুমি কি ব্যায়াম করো?’ উত্তরে ‘হ্যাঁ’ শুনে মান্নাদা খুব খুশি হলেন। যত দিন সুটিং চলল টেকনিসিয়ানে, মান্নাদা এসেই ছেলেটির খোঁজ করতেন। তাঁর কাছে শরীর-চর্চাও যে একটা মস্ত বড় সাধনা।

Advertisement

কয়েক দিন আগে ফেসবুকে একটা পোস্টিং দেখছিলাম—‘মা এখনও বলেন সবাইকে একদিন ফিরে যেতে হবে যৌথ পরিবারে।’ পড়ার পরে মান্নাদার কথা মনে পড়ল। পরিবার ছিল তাঁর প্রাণ। মদন ঘোষ লেনের বাড়ি তখন গমগম করত সব সময়। মান্নাদারা চার ভাই, এক বোন। তারা এবং তাদের পরিবার। তিন জন কাজের লোক। সব মিলিয়ে প্রায় চল্লিশ জন। মান্নাদা কলকাতায় এলে এখানেই থাকতেন, হোটেলে ক্বচিৎ-কদাচিৎ। মান্নাদা আসা মানেই উৎসব। জমিয়ে খাওয়া। মূল উদ্যোক্তা মান্নাদা। চোদ্দো কেজি পাঁঠার মাংস তো আসবেই। সাড়ে তিন কাঠা জমির ওপর বাড়ি। মাঝখানে ছোট ছোট উঠোন। ও পাশে আউট হাউসে রান্না হত মাংস। মাংসের নানা ধরনের মশলা রাখার একটা পৃথক আলমারি। সাধারণত রাতের দিকেই হত রান্না। মাংসটা রান্না করতেন প্রভাসবাবু, মানে মান্নাদার পিঠোপিঠি ছোট ভাই প্রভাস দে। বেশ কয়েক জন অ্যাসিসটেন্ট থাকত, তার মধ্যে ‘চিফ অ্যাসিসটেন্ট ছিলেন বড় ভাইপো মুকুল। মান্নাদার পছন্দ করা মেনু সবারই খুব পছন্দ।—বড় বড় আলু দিয়ে পাঁঠার মাংস, মেটে দিয়ে ডাল, স্যালাড এবং হাতে গড়া রুটি। সে দিন আর বাড়িতে রুটি হত না। এখন যেখানে নকুড়ের মিষ্টির দোকান, তার পাশে একজন উড়িয়ার রুটির দোকান ছিল। ওখান থেকে আসত হাতে-গরম রুটি। তা শ’ দেড়েক তো হবেই। সে এক হই চই কাণ্ড। আউট-হাউসে রান্না হচ্ছে। চারিদিকে ঘুরে বেড়াচ্চে মাংসের গন্ধ। মান্নাদা বারান্দায় এসে হাঁক পারতেন—‘কত দূর?’ মাঝে মাঝে রান্নার ইনস্ট্রাকসনও দিতেন। এই যে বাড়ির সবাই মিলে খাওয়া-দাওয়া, আড্ডা, মান্নাদা ভীষণ পছন্দ করতেন। শুধু এ বাড়িতে যারা থাকেন, তারাই নয়, বাইরে যারা আছেন গাড়ি যেত তাদের জন্যও। দমদমে প্রায় কুড়ি কাঠা জমির উপর বাড়ি করেছিলেন কৃষ্ণ চন্দ্র দে। মদন ঘোষ লেনে যখন জায়গা একটু কম পড়তে থাকল, তখন কৃষ্ণচন্দ্রের মেজদা হেমচন্দ্র দে স্ত্রী মণিমালাকে নিয়ে সংসার পাতেন দমদমের বাড়িতে। তাদের ছয় পুত্র। খাওয়া-দাওয়ার দিন সবাইকে আসতেই হবে। যারা একান্তই আসতে পারতেন না, তাদের জন্য খাবার যেত টিফিন বাক্স করে। শিক্ষণীয় বিষয় কি জানেন? এত খাবার, মান্নাদা বেশি হলে দুটো রুটি, দু’ পিস মাংস, একটু ডাল ও স্যালাড। কেউ চাপাচাপি করলে বলতেন—‘এই তো এত সবাই আছে, ওদের দাও না। আমাকে নিয়ে কেন টানাটানি করছ?’ মান্নাদার একটাই লজিক, ‘সারা জীবন ধরে খেতে চাও তো রোজ অল্প অল্প করে খাও।’

মান্নাদার সেই টান শেষ পর্যন্ত ছিল। শেষ বার কলকাতায় আসেন ২০১০ সালে। মানসিক ভাবে খুবই বিপর্যস্ত ছিলেন। ম্যাডামের অসুখটা ধরা পড়েছে। মন ভাল নেই। তবু রেকর্ডিংটা করতেই হবে। মদন ঘোষ লেনের গানের ঘরটায় হারমোনিয়ামটা টেনে নিয়ে মান্নাদা বসলেন প্রাক্টিসে । ঘরে কাকার মূর্তি। মান্নাদা তখন সুরের সাধনায় নিমগ্ন এক তপস্বী। জাগতিক সুখ-দুঃখের অনেক ঊর্ধ্বে।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement