Subhankar Bandyopadhyay

Subhankar Banerjee: মানুষ শুভঙ্কর সব সময়ই ছাপিয়ে গিয়েছেন শিল্পী শুভঙ্করকে

Advertisement

ঋতপ্রভ বন্দ্যোপাধ্যায়

কলকাতা শেষ আপডেট: ২৫ অগস্ট ২০২১ ১৯:৩০
Share:

ঠিক যেন ‘ফাঁক’-এ এসে থেমে গেল! ‘সম’-এ ফিরল না।
তবলা বললেই লোকে বোঝে জাকির হুসেন। সঙ্গত। বিশ্ববন্দিত তবলা শিল্পী আর কে-ই বা! কিন্তু সেই জাকির হুসেন যদি কোনও সমসাময়িক শিল্পীকে স্বীকৃতি দেন? যদি নিমন্ত্রণ করে নিয়ে যান তাঁর বাবা প্রয়াত কিংবদন্তি উস্তাদ আল্লারাখা খাঁ সাহিবের স্মৃতিতে আয়োজিত কোনও অনুষ্ঠানে? কিংবা অত্যন্ত ব্যস্ত সেই জাকির হুসেনই যদি স্বেচ্ছায় চলে আসেন শুভঙ্করের মা কাজলরেখা দেবীর স্মৃতিতে আয়োজিত কোনও অনুষ্ঠানে একক তবলা পরিবেশনে? জাকিরের স্বীকৃতিপ্রাপ্ত সেই শিল্পী তখন জনপরিসরে আর নিছক ‘তবলিয়া’ হয়ে থাকেন না। 'সহশিল্পী' থেকে হয়ে ওঠেন প্রকৃত শিল্পী। ফারুকাবাদ ঘরানার উস্তাদ কেরামতুল্লা খাঁ সাহিবের শিষ্য পণ্ডিত স্বপন শিবের ছাত্র শুভঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় প্রকৃতার্থেই সার্থক শিল্পী। মাত্র চুয়ান্ন বছর বয়সে যে শিল্পীকে চলে যেতে হল কোভিড-সংক্রমিত হয়ে।

কয়েক বছর আগের কথা। শহরের একটি অনুষ্ঠানে এসেছেন পণ্ডিত শিবকুমার শর্মা। প্রশ্ন করেছিলাম, এই শহরে তো বহু গুণী তবলিয়া রয়েছেন, তা হলে আপনি এলেই শুভঙ্করের ডাক পড়ে কেন? উত্তরে বলেছিলেন, ‘‘শুভঙ্কর থাকলে মনে হয়, বাড়িতে বসে রিয়াজ করছি। এতটা ‘কমফর্টেবল’ অন্য কোনও তবলিয়ার সঙ্গে নই। এমনও হয়েছে, আমি বা রাহুল (শিবকুমারের পুত্র) কোনও শহরে গিয়েছি। শুভঙ্করও এসেছে। বিমান দেরিতে পৌঁছেছে। আমাদের দেখা হয়েছে স্টেজে। গ্রিনরুমে নয়। কিন্তু কোনও সমস্যা হয়নি।’’ কিংবদন্তি হরিপ্রসাদ চৌরাসিয়া শহরে এলেও ডাক পড়ত শুভঙ্করের। হরিপ্রসাদ নজরুল মঞ্চে শেষ যে বার অনুষ্ঠান করলেন, সেখানেও সঙ্গতে ছিলেন শুভঙ্কর।

Advertisement

যাঁর ওঠাবসা শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের কিংবদন্তিদের সঙ্গে, তিনি নিজে কিন্তু মাটির মানুষ। একটা উদাহরণ দেওয়া যাক। বছর কয়েক আগে বন্ধু এবং তৎকালীন সহকর্মী অনির্বাণ ভট্টাচার্যের বিয়ে। অনির্বাণ শিখেছেন পণ্ডিত অজয় চক্রবর্তীর কাছে। তখনও লড়ছেন। সাংবাদিকতা ছেড়ে গানকে কেরিয়ার হিসাবে বেছে নেওয়ার লড়াই করছেন। তাঁর বিয়ের অনুষ্ঠানে গিয়ে দেখা গেল, শুভঙ্কর চলে এসেছেন। কাছে যেতেই বললেন, "অনির্বাণ অনেক আগে থেকে বলে রেখেছিল। তাই আমি আজকের দিনে কোনও প্রোগ্রাম রাখিনি।’’ নিমন্ত্রিতের তালিকায় অনেকেই ছিলেন। কেউ কেউ এসেওছিলেন। শুভঙ্কর ছিলেন অনুষ্ঠান শেষ না হওয়া পর্যন্ত।

মানুষ শুভঙ্কর সব সময়ই ছাপিয়ে গিয়েছেন শিল্পী শুভঙ্করকে। অথচ তাঁর জীবনেও লড়াই ছিল। আর পাঁচজন বাঙালির থেকে যা কিঞ্চিৎ বেশিই। কারণ, শুভঙ্করের মা কাজলরেখা দেবী ছিলেন পোলিয়ো আক্রান্ত। দু’হাত, দু’পা মাটিতে রেখে চলতে হত তাঁকে। আনন্দবাজার অনলাইনে শুভঙ্কর লিখেছিলেন, ‘মা বলত, আমি তো আর পাঁচটা মায়ের মতো নই। তাই তুইও আর পাঁচটা ছেলের মতো তৈরি হবি না।’ সত্যিই আমার মা আর পাঁচটা মায়ের মতো নন। জন্ম থেকেই দেখছি, আমার মা হাতে-পায়ে একসঙ্গে এগিয়ে চলেন। ইংরেজি ওই ‘ডিজএবল’ শব্দটা মায়ের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হলেও মায়ের মতো ‘এবল’ আলোকশক্তি তেমন করে আর চোখে পড়েনি আমার। মা আশৈশব পোলিও আক্রান্ত। তবুও এমন কাজ ছিল না, যা তিনি করেননি বা করতে পারেননি।’ সেই মায়ের ছেলে শুভঙ্কর তাই বিশ্বের তাবড় শিল্পীর কুর্নিশ আদায় করে নিলেও নিজের অতীত ভুলে যাননি কখনও। যত অকিঞ্চিৎকর শিল্পীই হন না কেন, শুভঙ্করের কাছে পৌঁছলে সাহায্য পাবেন তিনি, এটা ছিল স্বতঃসিদ্ধ।

আইএসসি পরীক্ষা না দিয়ে সতেরো বছর বয়সে ন’মাসের জন্য বিদেশ পাড়ি দিয়েছিলেন শুভঙ্কর। মা ছেড়ে দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, ‘এ রকম মায়ের জন্য আমার কিছু হল না’, এই চিন্তা যেন কখনওই তাঁর পথ চলাকে আটকে না দেয়। আগুনে পুড়েছেন তাঁর মা। শুভঙ্করকেও পুড়তে শিখিয়েছেন। সোনা সে তো খাঁটি সোনা হয় পুড়ে গেলে আগুনে!

আরও পড়ুন:

মায়ের স্মৃতিতে তৈরি করলেন ‘কাজলরেখা ফাউন্ডেশন’। বিশেষ ভাবে সক্ষম গুণী শিল্পীদের সাহায্য করে শুভঙ্করের সংস্থা। তার বার্ষিক অনুষ্ঠানে ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের এমন কোনও শিল্পী ছিলেন না, যিনি আসেননি। নিজে ভাল গান করতেন। তার রেকর্ডিংও রয়েছে। দেশে-বিদেশে অনুষ্ঠান করার পাশে তৈরি করেছেন একাধিক ছাত্র। যাঁদের মধ্যে পুত্র আর্চিকও পড়েন।

বিশ্বের এমন কোনও বড় শিল্পী নেই, যাঁর সঙ্গে শুভঙ্কর সঙ্গত করেননি। একই সঙ্গে বিশ্বের একাধিক শহরে আয়োজিত হয়েছে তাঁর একক অনুষ্ঠানও। তেমন এক খ্যাতনামীকে শহরে এক অনুষ্ঠানের পর এক তরুণ সাংবাদিক বললেন, কিছুক্ষণ আগে শুভঙ্কর যাঁর সঙ্গে সঙ্গত করলেন, সেই হরিপ্রসাদ চৌরাসিয়ার সাক্ষাৎকার প্রয়োজন। ভিড় ঠেলে গ্রিনরুমে ঢুকে হরিপ্রসাদের কানে কানে কিছু বলে সেই নবীন সাংবাদিককে শুভঙ্কর বসিয়ে দিলেন বাঁশির প্রবাদপুরুষের সামনে। তার পর একটু হাসি। যার অর্থ, এ বার তুমি লড়ে নাও।

সেই হাসি, সেই ভদ্রতা, সেই সম্মান নিয়েই বিদায় নিলেন শুভঙ্কর। শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের বিরল এক শিল্পী। নিছক ‘তবলিয়া’ নন। নাতিদীর্ঘ জীবন বুধবার হঠাৎ শেষ হল সেই বিখ্যাত তেহাই ছাড়া। ‘সম’-এ ফিরল না।

Advertisement

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement