২০০৮ সালের ২০ সেপ্টেম্বর। সন্ধের সময় চেন্নাইয়ের খুব কাছে একটা বাইক অ্যাক্সিডেন্ট হয় হিথেন্দ্রনের। হেলমেট ছাড়াই বাইকে বসেছিল ১৫ বছরের হিথেন্দ্রন। সাউথ চেন্নাইয়ের একটি বেসরকারি হাসপাতালে ডাক্তারদের শত চেষ্টা সত্ত্বেও ব্রেন ডেথ হয়ে যায় হিথেন্দ্রনের।
এমন চরম একটা বিপর্যয়ের মুহূর্তেও অসম্ভব একটা ব্যতিক্রমী সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন হিথেন্দ্রনের বাবা-মা। তাঁরা ঠিক করেন, হিথেন্দ্রনের শরীরের চালু থাকা সব অঙ্গ (হার্ট, লিভার, কিডনি, কর্নিয়া, বোন ম্যারো) দান করে দেবেন অন্য রোগীদের। যাতে হিথেন্দ্রন নিজে না থাকলেও অন্য আরও অনেকের মধ্যে দিয়ে বেঁচে থাকবে সে এই পৃথিবীতে।
কিন্তু মুশকিল হল, শরীর থেকে বের করে নেওয়ার পর ‘হার্ট’ ব্যবহারযোগ্য থাকে মাত্র ৩০ মিনিট! অন্য শরীরে প্রতিস্থাপন করতে হলে করে ফেলতে হবে ওর মধ্যেই। এর চেয়ে বেশি দেরি হয়ে গেলে সব চেষ্টাই বিফলে যাবে। এমন এক সময় খোঁজ পাওয়া যায় ন’বছরের ছোট্ট মেয়ে ‘অভিরামী’র। বাবা শেখর, মা মঞ্জুলা, বাড়ি বেঙ্গালুরু। হার্টের চিকিৎসায় অভিরামী তখন ভর্তি পশ্চিম চেন্নাইয়ের অপর একটি বেসরকারি হাসপাতালে। হার্ট ট্রান্সপ্ল্যান্ট না করা গেলে এই পৃথিবীতে অভিরামীর আয়ু তখন আর খুব বেশিদিনের নয়।
এর পর শুরু সময়ের সঙ্গে লড়াই। চেন্নাইয়ের এই দু’টি হাসপাতালের মধ্যে দূরত্ব বা এক হাসপাতালে থেকে অন্য হাসপাতালে যেতে মোটামুটি ৪৫ মিনিট সময় লাগে। চেন্নাইয়ের পুলিশ কমিশনারের বিশেষ সহযোগিতায় ওই ৪৫ মিনিটের পথ বিনা বাধায় পাড়ি দেওয়া যায় মাত্র ১১ মিনিটে। সফল অপারেশনে বেঁচে যায় ছোট্ট মেয়ে ‘অভিরামী’ও।
এই ঘটনার উপর ভিত্তি করেই পরিচালক রাজেশ পিল্লাইয়ের ফিল্ম ‘ট্রাফিক’ একটি আড়াই ঘণ্টার রোমহর্ষক অভিযান! ঘটনার স্থান-কাল অবশ্য পাল্টেছে এ ছবিতে। চেন্নাই হয়েছে মুম্বই আর সন্ধে হয়েছে দুপুর। মুম্বইয়ের একটি বেসরকারি হাসপাতাল থেকে পুনের একটি হাসপাতাল। দূরত্ব প্রায় ১৬০ কিলোমিটার। এই ছবিতেই মুম্বইয়ের ট্র্যাফিক কমিশনারকে (অভিনয়ে জিমি শেরগিল) বলতে শোনা যাচ্ছে, ব্যস্ত সময়ে এ শহরের রাস্তায় গাড়ি থাকে কয়েক লক্ষ। আর এমন একটা সময়ে মুম্বইয়ের ট্র্যাফিক পরিস্থিতির তুলনা দেওয়ার জন্যে তিনি একে ‘মাকড়ি কা জাল’ বলছেন।
ঘুষ নেওয়ার অপরাধে সাসপেনশনের শাস্তি পাওয়া পুলিশ কনস্টেবল রামদাস গোড়বোলের চরিত্রে মনোজ বাজপেয়ী অসাধারণ।
এ ছবির শুরু থেকে শেষ অবধি ছবির এক্সাইটমেন্ট ধরে রেখেছেন বাংলার দুই স্টার, প্রসেনজিত্ আর পরমব্রত। বলতে গেলে তাঁরাই এ ছবির দু-দুটো শক্ত পিলার। মুম্বই থেকে পুনে পর্যন্ত হার্ট নিয়ে যাবেন ডক্টর অ্যাবেল ফার্নানডেজ (অভিনয়ে পরমব্রত)।
যে মেয়েটির শরীরে বসানো হবে রেহানের হার্ট, সেই রিয়া আবার বাস্তবের অভিরামীর মতো নেহাত কোন জনতা-ক্লাসের মেয়ে নয়। সে হলো গিয়ে বলিউডের সুপারস্টার দেব কপূরের মেয়ে! এই দেব কপূরের ভূমিকায় প্রসেনজিত অভিনয় দুর্দান্ত।
সুপারস্টার হয়েও বিপর্যয়ের মুখে এবং নিজের সন্তানকে তিলে তিলে মৃত্যুর দিকে যেতে দেখা ক্ষমতাবান অথচ অসহায় বাবার চরিত্রে প্রসেনজিতকে দেখে কখনও মনে হয়নি যে তিনি অভিনয় করছেন। এ ছবিতে দেব কপূরের অংশটা অবশ্যই মন জয় করবে দর্শকদের বলে অন্তত আমার বিশ্বাস।
ছবিতে বেশ কিছু অংশের সঙ্গে ২০০৮ সালের সেই বাস্তব ঘটনার কোনও মিল নেই। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য অ্যাবেল ফার্নানডেজের (পরমব্রত) স্ত্রীর গোপন প্রেম। ছবিতে অ্যাবেল ফার্নানডেজের অ্যাকশনের অংশটাও হয়তো ছবির দৈর্ঘ্য বাড়াতে এবং ‘ফিল্মী’ নাটকীয়তা আনতেই ব্যহার করেছেন পরিচালক।
২০০৮ সালের এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা ফিল্মের সংখ্যা নেহাত কম নয়। ২০১১-এ মালয়ালামে তৈরি ‘ট্র্যাফিক’ একটি ব্লকবাস্টার হিট ফিল্ম। এর পর তামিলে ২০১৩-এ ‘চেন্নাইয়াল ওরু নাল’ এবং ২০১৪-এ মুক্তি পাওয়া কন্নড় ভাষার ‘ক্রেজি স্টার’—সবই এই গল্পের পৃথক উপস্থাপনা মাত্র। সবশেষে হিন্দিতে তৈরি এই ‘ট্র্যাফিক’ এখন চলছে দেশের বিভিন্ন সিনেমাহলে, মাল্টিপ্লেক্সে। পরিচালকের হঠাৎ প্রয়াণের পর প্রায় বছরখানেক আটকে ছিল ছবির রিলিজ। তবে অসাধারণ একটি বাস্তব ঘটনা, একটি মহত্ সিদ্ধান্ত এবং টানটান উত্তেজনায় ভরা একটি শিশুর জীবনদানের ঘটনা ফিরে দেখার সুযোগ পাওয়া যাবে এ ছবিতে।