বিজয়ী: অ্যাকাডেমি পুরস্কার হাতে (বাঁ দিক থেকে) স্যাম রকওয়েল, ফ্রান্সিস ম্যাকডোরম্যান্ড, অ্যালিসন জেনি এবং গ্যারি ওল্ডম্যান। রবিবার রাতে লস অ্যাঞ্জেলেসে। ছবি: এপি
শব্দবন্ধটা কিঞ্চিৎ অচেনা। মানে বোঝার জন্য অনেকেই তত ক্ষণে স্মার্টফোন হাতড়াতে শুরু করে দিয়েছেন।
মাত্র আড়াই মিনিটের বক্তৃতা। মনোগ্রাহী। শক্তিশালীও বটে। শুনতে শুনতে বেশ কয়েক বার প্রেক্ষাগৃহ ফেটে পড়েছে হাততালিতে। কিন্তু ‘ইনক্ল্যুশন রাইডার’ এই শব্দ দু’টো দর্শকদের দিকে ছুঁড়ে দিয়ে যখন স্টেজ থেকে নেমে যাচ্ছেন ফ্রান্সিস ম্যাকডোরম্যান্ড, তখন ভিড়ে ঠাসা ডলবি থিয়েটারে অনেকেরই মনে প্রশ্ন— ঠিক শুনলাম তো? মুহূর্তে গুগ্ল-এ সব থেকে বেশি ‘সার্চ’ করা শব্দ হয়ে যায় ‘ইনক্ল্যুশন রাইডার’!
পরে, ব্যাকস্টেজে, নিজেই ব্যাখ্যা করে দিলেন এ বারের সেরা অভিনেত্রী। কোনও অভিনেতা বা অভিনেত্রী যখন ছবি-নির্মাতার সঙ্গে চুক্তি সই করছেন, তখন তিনি একটি ‘ইনক্ল্যুশন রাইডার’ বা ‘অন্তর্ভুক্তির শর্ত’ রাখতে পারেন। এই শর্তটি হল, ছবির কুশীলব নির্বাচনে বহুত্বের পরিচয় রাখতে হবে। ছবির অন্তত ৫০ শতাংশ কলাকুশলী ‘অ-শ্বেতাঙ্গ’, ‘অ-পুরুষ’ এবং ‘অ-বিসমকামী’ হওয়া বাঞ্ছনীয়। হলিউড যে এই প্রত্যাশা সাধারণত পূরণ করে না, তারই ইঙ্গিত ছিল ফ্রান্সিসের বক্তৃতায়। দু’বছর আগের ‘মুনলাইট’ বা সেই ২০০৫-এর ‘ব্রোকব্যাক মাউন্টেন’ ব্যতিক্রম-ই। তবে সম্প্রতি শ্বেতাঙ্গ পুরুষকেন্দ্রিক ঘরানা থেকে বার হওয়ার সচেতন প্রয়াস দেখা গিয়েছে হলিউডে। যেমন বিষয়বস্তু, তেমনই অভিনেতা ও কলাকুশলীর নিরিখে। যার ফসল এ বছরের বেশ কয়েকটি অন্য ধরনের ছবি— ব্ল্যাক প্যান্থার, কল মি বাই ইওর নেম, গেট আউট, দ্য শেপ অব ওয়াটার, দ্য ব্রেডউইনার, কোকো...তালিকাটা বেশ লম্বা।
মেয়েরাও তো এ রকমই ‘অন্য’। ৯০ বছর পার করল অ্যাকাডেমি অ্যাওয়ার্ডস, কিন্তু মনোনীতের তালিকায় ক’জনই বা মহিলা ছিলেন? তবু ‘কাচের অদৃশ্য সিলিং ভাঙছে’, সূচনা-বক্তৃতায় বললেন সঞ্চালক জিমি কিমেল। অস্কার-ইতিহাসে এই প্রথম সিনেম্যাটোগ্রাফিতে কোনও মহিলা মনোনয়ন পেলেন— মাডবাউন্ড ছবির জন্য রেচেল মরিসন। খেতাব অবশ্য জেতেননি।
সেরা যাঁরা
• ছবি: দ্য শেপ অব ওয়াটার
• পরিচালক: গিয়েরমো দেল তোরো (দ্য শেপ অব ওয়াটার)
• অভিনেত্রী: ফ্রান্সিস ম্যাকডোরম্যান্ড (থ্রি বিলবোর্ডস আউটসাইড এবিং, মিসৌরি)
• অভিনেতা: গ্যারি ওল্ডম্যান (ডার্কেস্ট আওয়ার)
• সহ-অভিনেত্রী: অ্যালিসন জেনি (আই, টনিয়া)
• সহ-অভিনেতা: স্যাম রকওয়েল (থ্রি বিলবোর্ডস আউটসাইড এবিং, মিসৌরি)
• অ্যানিমেটেড ছবি: কোকো
• তথ্যচিত্র: আইকেরাস
• বিদেশি ভাষার ছবি: আ ফ্যান্টাস্টিক ওম্যান (চিলি)
যে সব মহিলা এ বছর অস্কারে মনোনীত হয়েছেন, তাঁদের ফ্রান্সিস অনুরোধ করেন, ‘‘আপনারা দয়া করে উঠে দাঁড়ান। এই খেতাব সকলের সঙ্গে ভাগ করে নিতে চাই।’’ তারপরেই রসিকতার সুরে যোগ করেন, ‘‘আপনি যদি আগে উঠে দাঁড়ান মেরিল (স্ট্রিপ)। আপনি যা করেন, সকলেই সেটা অনুসরণ করে!’’ মুখের কথা শেষ হতে না হতেই প্রথম সারি থেকে তড়াক করে উঠে দাঁড়ালেন তিন বারের বিজেতা (এবং আরও ১৮ বার মনোনয়ন পাওয়া) মেরিল। সহাস্য করতালিতে থিয়েটার তখন ভরপুর।
আরও পড়ুন: মেয়ের পর এ বার যমজ ছেলের মা হলেন সানি
রেড কার্পেট মাতিয়ে রবিবার সন্ধেতে মেরিল পরেছিলেন একটা লো-কাট লাল গাউন। তাঁর সতীর্থদের পরনেও (নারী-পুরুষ দু’দলই) ডিজাইনার জাপাকাপড়। চোখে পড়ার মতো ব্যতিক্রম ফ্রান্সিস-ই। আজ ফ্যাশন পত্রিকা ‘ভোগ’ ফ্রান্সিসকে ‘শ্রেষ্ঠ সাজগোজ’-এর তকমা দিয়ে বলেছে, ‘‘শুধু প্রাণকাড়া হাসি আর একমাথা অগোছালো চুল। মেকআপ বলতে এ-টুকুই। তাতেই উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিলেন ফ্রান্সিস।’’ এই প্রথম নয়। ‘থ্রি বিলবোর্ডস আউটসাইড এবিং, মিসৌরি’তে তাঁর অভিনয়ের জন্য গত কয়েক মাসে অসংখ্য খেতাব জিতেছেন ফ্রান্সিস। প্রতিবার তাঁর উঁচুগলা, পা-ছোঁয়া গাউন নিয়ে ফ্যাশন দুনিয়ায় গুঞ্জন শোনা গিয়েছে। তাঁর চরিত্র মিলড্রেড হায়েসের ‘কেজো’ জাম্পস্যুটের মতোই ‘সাধারণ’ তকমা ঘোচেনি ফ্রান্সিসের পোশাক থেকে। বলা ভাল, সচেতন ভাবে তা ঘুচতে দেননি ফ্রান্সিস নিজেই।
অক্টোবরে হলিউডের প্রযোজক হার্ভি ওয়াইনস্টেইনের নামে যৌন হেনস্থার অভিযোগ ওঠার পরেই পাল্টে গিয়েছে পুরস্কার মঞ্চ। গোল্ডেন গ্লোব ও বাফটায় কালো গাউন আর #মিটু ব্যাজই ছিল প্রতিবাদের ভাষা। অস্কার-সন্ধ্যা সে দিক থেকে কিছুটা আলাদা ছিল। প্রতিবাদের পরে এগিয়ে চলা আর ইতিহাস গড়াকেই কুর্নিশ জানিয়ে গেল অ্যাকাডেমি-মঞ্চ। তবে রসিকতার মোড়কে। যৌন হেনস্থার প্রসঙ্গ ছুঁয়ে সঞ্চালক কিমেল বললেন, ‘‘পুরুষদের এমনই খারাপ ভাবমূর্তি যে একজন মাছকেই প্রেমিক হিসেবে বেছে নিচ্ছেন মহিলারা।’’ শ্রেষ্ঠ ছবি ‘দ্য শেপ অব ওয়াটার’-এর বিষয়বস্তু তো তাই। এখানেই শেষ নয়। মঞ্চের উপরে বিশাল সোনালি অস্কার মূর্তি দেখিয়ে কিমেলের মন্তব্য— ‘‘ইনি-ই হচ্ছেন আদর্শ পুরুষ। হাত গুটিয়ে রাখেন, মুখ খুলে উল্টোপাল্টা কথা বলেন না। আর সব থেকে বড় কথা, ওঁর পুরুষাঙ্গটিও নেই। ভাগ্যিস!’’