Tele Serial

ধারাবাহিকে যুক্তিহীন, বাস্তববর্জিত ঘটনাই কি দর্শক টানছে?

সাম্প্রতিক কয়েকটি বাংলা ধারাবাহিকের ঘটনা পরম্পরায় যুক্তিগ্রাহ্যতার লেশমাত্র নেই। তার কারণ খুঁজল আনন্দ প্লাসসাম্প্রতিক কয়েকটি বাংলা ধারাবাহিকের ঘটনা পরম্পরায় যুক্তিগ্রাহ্যতার লেশমাত্র নেই। তার কারণ খুঁজল আনন্দ প্লাস

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

কলকাতা শেষ আপডেট: ০৪ মার্চ ২০২০ ০০:০১
Share:

‘কে আপন কে পর’-এর সেই দৃশ্য

সোশ্যাল মিডিয়ার সুবাদে এত দিনে অনেকেই জেনে গিয়েছেন, জবা একটি সাধারণ কাঁচি দিয়ে বোমা নিষ্ক্রিয় করেছে। আর শ্যামার গায়ের রং একটি দুর্ঘটনার পরে দুধ-সাদা হয়ে গিয়েছে। ‘কে আপন কে পর’ ধারাবাহিকের মুখ্য চরিত্র জবা। ‘কৃষ্ণকলি’ ধারাবাহিকের প্রধান চরিত্র শ্যামা। দু’টি ধারাবাহিকই টিআরপি রেটিংয়ে তালিকার প্রথম দিকে। এই দু’টি সাম্প্রতিক উদাহরণ মাত্র। নামী চ্যানেলে যে ধারাবাহিকগুলি চলছে, তার প্রায় সবক’টিতেই যুক্তিহীন, বাস্তববর্জিত বিভিন্ন ঘটনা প্রায়ই দেখতে পাবেন। তবে আপাত ‘অস্বাভাবিক’ এই ঘটনাগুলিই দর্শকের চোখে এখন স্বাভাবিক হয়ে গিয়েছে। না-হলেও, অন্তত স্বাভাবিক করে দেওয়ার চেষ্টা চলছে। কারণ একটাই। টিআরপি আসে এই পথেই।

Advertisement

বাংলা ধারাবাহিকের বিবর্তনের পথ বেশ দীর্ঘ। চ্যানেলগুলির মধ্যে পারস্পরিক প্রতিযোগিতা, টিআরপির দৌড়, আর প্রায় ৩৬৫ দিন ধরে সিরিয়াল চালানোর ঝক্কি সামলাতে হয় নির্মাতা-চিত্রনাট্যকারদের। তাই একটি চরিত্রকে ঘিরে গল্প শুরু হয়। টানতে টানতে তা এমন জায়গায় পৌঁছয়, যেখানে চমক ছাড়া দর্শক ধরে রাখার আর কোনও পথ বোধহয় বাকি থাকে না। ‘‘প্রায় ৬৫০ পর্ব হতে চলেছে ‘কৃষ্ণকলি’র। শ্যামার জীবন এক খাতে বইছিল। তাতে নতুন টুইস্ট দেওয়া হয়েছে। দর্শকের মধ্যে তাই ফের আগ্রহ তৈরি হয়েছে,’’ বলছিলেন চিত্রনাট্যকার সুশান্ত দাস। কিন্তু যে ধারাবাহিকের মূল ভাবনা ছিল শ্যামবর্ণা মেয়ে, তাকেই ফর্সা দেখালেন? ‘‘এতে এখনও অবধি তো টিআরপি কমেনি,’’ জবাব তাঁর।

সুশান্তের হাউসেরই আর একটি ধারাবাহিক ‘কে আপন কে পর’। গত চার বছর ধরে এটি টিআরপি তালিকায় শীর্ষে। পরিচারিকা জবা পড়াশোনা করে আইনজীবী হয়েছে। আবার সে ভয়ে ভয়ে বোমাও নিষ্ক্রিয় করে ফেলেছে। ‘‘জানি, এটা সোশ্যাল মিডিয়ায় ট্রোলড হয়েছে। তবে আমার কাছে এটা আবেগের প্রশ্ন। কোনও মা যদি জানতে পারে, তার সন্তানের গায়ে বোমা বাঁধা, সে কি ঝুঁকি নেবে না?’’ প্রশ্ন তুললেন তিনি। সুশান্তের বক্তব্য, নতুন প্রজন্ম এই ধরনের সিরিয়াল দেখে না। তারা মিম বানিয়েই খুশি। হয়তো তা কিছুটা সত্যিও। তাই ধারাবাহিক নির্মাতাদের টার্গেট অডিয়েন্স নতুন প্রজন্ম নয়। গৃহবধূ, মধ্যবয়স্কা এবং প্রবীণাদের বিনোদন দিতে পারলেই তাঁদের লক্ষ্যপূরণ হয়ে যায়। তাই চিত্রনাট্যের যুক্তিবুদ্ধি নিয়ে যতই প্রশ্ন তোলা হোক, মিম বানিয়ে যতই অপপ্রচার চালানো হোক, টিআরপিতে আদৌ কি তার প্রভাব পড়ে?

Advertisement

আর একটি চ্যানেলে চলছে ‘বাঘ বন্দি খেলা’ নামে একটি ধারাবাহিক। যেখানে মূল পুরুষ চরিত্রটি বাঘের রূপ নেয়। এই ধারাবাহিকের চিত্রনাট্যকার সাহানা দত্তের মতে, ‘‘এটি মডার্ন ফ্যান্টাসি। সুন্দরবন বা মেঘালয়ের জনজাতিদের মধ্যে বাঘরূপী মানুষের মিথ রয়েছে। ধারাবাহিক তৈরির মূল উদ্দেশ্য তো বিনোদন। ফ্যান্টাসি ড্রামায় যুক্তি খোঁজার প্রশ্ন নেই।’’

পারিবারিক ড্রামার পাশাপাশি বিভিন্ন চ্যানেলে ফ্যান্টাসি, সুপারন্যাচারাল ড্রামার আধিক্যও বেড়েছে। বাংলা ধারাবাহিক কি এখন সহজ কথা সহজ ভাবে বলতে পারে না? অবাস্তবতাই বিনোদন জোগানোর মুখ্য পথ? জোছন দস্তিদারের কন্যা খেয়ালী দস্তিদার বললেন, ‘‘ভেজাল দেখালে যদি টিআরপি আসে, তবে নির্মাতারা সেটাই দেখাবেন। কারণ ব্যবসাই এখন মুখ্য। আমার বাবা যখন ধারাবাহিক করতেন, সেটা প্রাগৈতিহাসিক যুগের কথা। তার সঙ্গে এখনকার কোনও মিল নেই। একতা কপূর ঘরানার প্রভাব অনেক দিনই বাংলা ধারাবাহিকে ঢুকে পড়েছে।’’ টিআরপির কারণে ‘গানের ও পারে’র মতো ধারাবাহিক বন্ধ হয়ে যাওয়া, খেয়ালীর মতে, বাংলা টেলিভিশন ইন্ডাস্ট্রির কাছে একটা বড় ধাক্কা ছিল।

ইন্টারনেট পরবর্তী যুগে বিনোদন প্রদানকারী মাধ্যমের সংখ্যা এতটাই বেড়ে গিয়েছে যে, টিআরপি বাড়ানোর সহজ পথেই হাঁটতে চাইছেন নির্মাতারা। তাতে গল্পের গরু গাছে উঠলেও, সেটাই চলছে। ‘জননী’র প্রযোজক অশোক সুরানার কন্যা ঈশিতা সুরানার কথায়, ‘‘যুক্তিহীন বিষয় দেখিয়েও টিআরপি আসছে। তবে মূল্যবোধের সঙ্গে কখনও আপস করব না। হয়তো তাতে আমার সিরিয়ালের টিআরপি কম হবে। তবে ভাল কাজ হলে, লোকে মনে রেখে দেবে।’’

অদূর ভবিষ্যতেও টিআরপির ঊর্ধ্বে উঠে যুক্তিগ্রাহ্য, বাস্তবসম্মত গল্প বলতে বাংলা ধারাবাহিকের চিত্রনাট্যকাররা উদ্যোগী হবেন কি না, তা জানা নেই। তবে আশাটুকু রাখতে ক্ষতি কী!

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement