বেঙ্গালুরুতে একটি অনুষ্ঠানে (বাঁ দিকে) জ়াকির হুসেন এবং অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়। ছবি: সংগৃহীত।
ছোটবেলা থেকে তাঁর বাজনা শুনেই বড় হয়েছি। পরবর্তী জীবনে যখন সঙ্গীতকে পেশা হিসেবে বেছে নিলাম, তখন জ়াকিরজির সঙ্গে আমার আলাপ। তার পর বহু অনুষ্ঠানে আমরা একসঙ্গে উপস্থিত ছিলাম। ওঁর সঙ্গে কাটানো অনেক স্মৃতিই আজ মনের মধ্যে ভিড় করছে।
জ়াকির হুসেনকে আমি যে ভাবে পেয়েছি, সেখানে তাঁর মধ্যে সব সময়েই একটা ইতিবাচক প্রাণশক্তি দেখেছি। অফুরান সেই প্রাণশক্তি। ব্যক্তিজীবন থেকে মঞ্চেও তাঁর প্রতিফলন ঘটত। সমকালে এটাই সত্য যে, তিনি ছিলেন বিশ্বের দরবারে ভারতীয় সঙ্গীতের সবচেয়ে পরিচিত মুখ। তবলার জগৎকে তিনি অনেক কিছুই দিয়ে গিয়েছেন। তবলাবাদনের ডায়মেনশন বদলে ফেলা থেকে শুরু করে সেখানে মৌলিকত্ব প্রতিষ্ঠা তাঁরই হাতে। আলাদা করে ভারতীয় ধ্রুপদী সঙ্গীতের বৃত্ত থেকে তবলাকে বার করে জ্যাজ়, ফিউশন-সহ বিশ্বসঙ্গীতের ময়দানে সম-সম্মান তিনিই পাইয়ে দিয়েছিলেন। তাই আমরা যাঁরা তবলা বাজাই, তাঁরা প্রত্যেকেই সে দিক থেকে তাঁর কাছে চিরকৃতজ্ঞ।
ওস্তাদজির পরিবারের সঙ্গে আমার সুসম্পর্ক ছিল। তাঁর স্ত্রীর সঙ্গেও আমার পরিচিতি ছিল। জ়াকিরজির সঙ্গে আমার শেষ দেখা হয় লস অ্যাঞ্জেলেসে। দুটো অনুষ্ঠান করেছিলাম। সেখানে তিনি এসেছিলেন বাজাতে। কয়েক মাস আগে পুণে ইউনিভার্সিটিতে আমি আমাদের বাচ্চাদের সঙ্গে ওঁকে একটু সময় কাটানোর অনুরোধ করি। কথা দিয়েছিলেন আগামী বছরের শুরুর দিকে সময় করে আসবেন। সেই ইমেল এখনও আমি সযত্নে রেখে দিয়েছি। কিন্তু দুঃখের বিষয়, সেই ইচ্ছা অপূর্ণই রয়ে গেল।
দু’মাস আগে আমি তখন আমেরিকায়। তখনও ফোনে কথা হল। আমাকে মজা করে বলেছিলেন, ‘‘স্বপনদার (স্বপন চৌধুরী) বয়স ৭৫। আমি ৭৩।’’ তখনও ওঁর শরীর এতটা খারাপ হয়নি। কথার মাঝেই বললেন, ‘‘আবার দেখা হবে। অনুষ্ঠান করব।’’ কিন্তু আর দেখা হল না।
জ়াকির হুসেনের বাজনার একটা বিশেষত্ব ছিল। তিনি জানতেন, কোথায় গিয়ে থামতে হয়। আজ যেন তিনি নিজের জীবন দিয়েই শিখিয়ে গেলেন, কী ভাবে কখন এবং কোথায় থামতে হয়। আজকাল ‘জিনিয়াস’ শব্দটা খুব সহজেই দেখি ব্যবহৃত হয়। কিন্তু প্রকৃত প্রতিভাধর ব্যক্তি কখনওই নিজেকে সেই ভাবে মেলে ধরেন না। আমার দেখা শেষ ‘জিনিয়াস’ জ়াকির হুসেন।
(সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে অনুলিখিত)