Suman Mukhopadhyay

এই নারীদেহই কি একমাত্র বাধা? জবাব খুঁজতে মহাভারতের ‘শিখণ্ডী’কে জাগিয়ে তুলছেন সুমন

এই প্রথম ‘শিখণ্ডী’র অভিনয় হতে চলেছে ভারতে। আরও নির্দিষ্ট করে বললে কলকাতা শহরে। পরিচালক সুমন মুখোপাধ্যায়ের কথায়, ‘কলকাতা প্রিমিয়ার’।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

কলকাতা শেষ আপডেট: ২৬ ডিসেম্বর ২০২২ ০৯:৫৬
Share:

আগামী ৭ জানুয়ারি, সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় অ্যাকাডেমির মঞ্চে সুদীপ্তা আসবেন ‘শিখণ্ডী’ হয়ে। নিজস্ব চিত্র

নতুন বছরে ‘চেতনা’ নাট্যদলের নতুন শুরুয়াত। পঞ্চাশ পূর্তির আনন্দে এই প্রথম কলকাতার বুকে মঞ্চস্থ হবে সুমন মুখোপাধ্যায়ের নাটক ‘শিখণ্ডী’। বিদেশেই নির্মাণ। তবে নির্যাসে দেশের ঐতিহ্য। মহাভারতের অন্যতম বর্ণময় চরিত্রকে কী ভাবে এখনকার সময়ে প্রাসঙ্গিক করে দেখছেন পরিচালক, সে গল্পই শোনালেন আনন্দবাজার অনলাইনকে।

Advertisement

শীতের মরসুম, সুদূর আমেরিকা থেকে অভিনেত্রী সুদীপ্তা মজুমদার এসে পড়েছেন কলকাতায়। টের পেলেন, শীত এখানে অর্ধেকেরও কম। তবে বহু বছর পর বাংলার মাটিতে পা রেখে রোমাঞ্চ হচ্ছে। শিলিগুড়িতে শৈশব কাটিয়ে এখন আমেরিকায় ক্যানসার নিয়ে গবেষণা করেন সুদীপ্তা, সুমনের চোখে ‘শিখণ্ডী’ যে তাঁকে ছাড়া মানায় না! আমেরিকার মঞ্চে অন্য এক নাটকে তাঁকে অভিনয় করতে দেখে সুমন নিজের ইংরেজি নাটকে একক অভিনয়ের জন্য ভেবে ফেলেন সেই গবেষককেই। তার পরই বিদেশের মাটিতে চূড়ান্ত সফল হয় ‘শিখণ্ডী’।

সুমন দেখেন, যুদ্ধ শেষের ধ্বংসস্তূপে বিষাক্ত আবর্জনা পড়ে আছে। সভ্যতার ক্লেদ। যেন কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধক্ষেত্রই বদলে গিয়েছে আজকের ইউক্রেনে। যোদ্ধা, তথা মূল চরিত্র একা অভিনয় করে চলে। তার শরীর নারীর মতো, কিন্তু সেই খাঁচা থেকে বেরিয়ে আসার জন্য প্রাণ ছটফট করে। এত নিয়ম- নিষেধের বেড়াজালের মধ্যে বাঁচা যায়? নারীদেহে বন্দি প্রাণ হেনস্থার শিকার হতে হতে বহু বহু যুগের পিতৃতন্ত্রের মুখোশ টেনে খুলে দিতে চায়। কিন্তু শুধু এক জন নারী হয়ে পারবে কি ‘শিখণ্ডী’?

Advertisement

সুদীপ্তা বললেন, ‘‘এই নাটকের আখ্যান যদিও বহু পুরনো, কিন্তু আমরা তো এখনও এই সমস্যাগুলো নিয়ে লড়াই করছি। মহাকাব্যের টেক্সটকে সমকালীন ভাবনার রসে জারিয়ে নিয়েছেন সুমন।’’

পরিচালকের মতে, ‘‘শিখণ্ডীর গোটা আখ্যানেই পিতৃতন্ত্রের ক্ষমতার কথা আছে। ক্ষমতা কী ভাবে নির্ধারণ করে দেয় ব্যক্তির নিজস্ব জীবন, বেঁচে থাকা, সে কথা আছে। আজকের সমাজেও আমরা এর অন্যথা দেখি না। নারীর উপর তৈরি হওয়া নানা চাপ, প্রত্যাখ্যান আজকের সমাজেও সত্য।’’

আখ্যানের মধ্যে সচেতন ভাবেই ‘শিখণ্ডী’র লিঙ্গপরিচয় নিয়ে একটা অস্পষ্টতা রাখা হয়েছে। সুদীপ্তার কথায়, ‘‘আমরা কাউকে বলে দিচ্ছি না যে, এ ভাবেই ভাবতে হবে। দর্শকের নিজস্ব বোধ-বিবেচনার উপরেই ছেড়ে দিচ্ছি।’’

মহাভারতের চরিত্র নিয়ে এই নাটক নির্মাণের কথা কেন ভাবলেন সুমন? জানালেন, তিনি ফুলব্রাইট ফেলোশিপ নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে সে দেশে ভারত ও বাংলাদেশের নাট্যচর্চার প্রবহমান ধারার সঙ্গে পরিচিত হন। যৌথ ভাবে কাজ করতে চেয়ে প্রবাসী নাট্যকার সুদীপ্ত ভৌমিকের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। তাঁর থিয়েটার দলের সঙ্গেও যুক্ত হন। কী থিয়েটার করবেন—তা নিয়ে ভাবনাচিন্তার বিনিময় থেকেই হয়ে ওঠে ‘শিখণ্ডী’। তাই এ নাটকের স্বত্ব সুদীপ্তেরই বলে জানান পরিচালক।

সুমনের কথায়, ‘‘মহাভারতে পিতৃতন্ত্রের ভূমিকা এই নাটকে বড় ভূমিকা নিয়েছে। অম্বা থেকে শিখণ্ডিনী হয়ে শিখণ্ডী— এই হয়ে ওঠার মধ্যে লিঙ্গপরিচয়ের সঙ্কটটা ধরতে চেয়েছি। পুরুষ হিসাবে তাকে বড় করা হয়েছিল, পরে তার মধ্যে এল নারীত্বের অনুভব। তার অস্তিত্বের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা নানাবিধ সমস্যা এই নাটকে উঠে আসে।’’

শিলিগুড়িতে শৈশব কাটিয়ে এখন আমেরিকায় ক্যানসার নিয়ে গবেষণা করেন সুদীপ্তা, সুমনের চোখে ‘শিখণ্ডী’ যে তাঁকে ছাড়া মানায় না! নিজস্ব চিত্র।

এই সঙ্কটের সঙ্গে জুড়ে যায় ক্ষমতার প্রশ্ন। সুমন বলেন, ‘‘কৃষ্ণ শিখণ্ডীকে ব্যবহার করেন ভীষ্মকে থামাতে। অর্জুন শিখণ্ডীকে সামনে রেখে আড়াল থেকে লড়েন। এই ভাবে ক্ষমতা, পিতৃতন্ত্র, ব্যক্তির নিজস্ব সঙ্কট, ক্ষমতার ফাঁদ— অনেকগুলো দিক নিয়ে গড়ে ওঠে এই নাটক।’’

তবে অভিনেতা এক জনই। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকেই তাঁকে খুঁজে পান সুমন। তিনি প্রবাসী বাঙালি অভিনেত্রী সুদীপ্তা।

সুমনের কথায়,‘‘নৃত্যশিল্পী হওয়ায় তাঁর শরীরী ভঙ্গিমায় সেই নমনীয়তা আছে। মুদ্রা পরিবর্তন করে করে চরিত্রের নানা বদল ফুটিয়ে তুলতে হয়েছে। দীর্ঘ মহড়ার প্রয়োজন হয়েছে এ জন্যে।’’

এ নাটকে অভিনয় করতে কলকাতায় এসেছেন তিনিই। সুমন বললেন, ‘‘এই চরিত্রের জন্য কলকাতার কারও কথা আমি ভাবিনি।’’

মূল আখ্যান গল্প বলা হয় মঞ্চে। কিন্তু মহাকাব্যের আখ্যানের সঙ্গে মিশে থাকে সমসাময়িকতা। সুমন বলেন, ‘‘কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের কথা বলতে বলতেই কোথাও এসে পড়ে ইরাকের যুদ্ধের কথা। দাগিয়ে দেওয়ার মতো করে বলা নয়, কিন্তু সূক্ষ্ম ভাবে ওই মজাটা রেখেছি নাটকে।’’

প্রযোজনার ক্ষেত্রে সব রকম সহায়তা করছে ‘চেতনা’। নাটকের একমাত্র কুশলী সুদীপ্তা জানালেন, সাড়ে ৩ বছর বয়স থেকে তিনি কত্থক শিখতে শুরু করেন করবী শর্মার কাছে। তখন তাঁরা থাকতেন শিলিগুড়িতে। পুণে যাওয়ার পরেও নানা ধরনের পারফরম্যান্সের সঙ্গে জড়িয়ে ছিলেন। তবে তা থিয়েটার নয়, ব্যাপক অর্থে। তা ছিল মূলত নাচ এবং নৃত্যনাট্য। বিদেশেও প্রাথমিক ভাবে থিয়েটার করেননি তিনি গোড়ায়। যখন যেখানে কর্মসূত্রে গিয়েছেন, সেখানেই নানা প্রযোজনার সঙ্গে জড়িয়ে ফেলেছেন নিজেকে।

সেই নাটকের টানেই ছুটে এসেছেন কলকাতায়। আগামী ৬ জানুয়ারি, সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় অ্যাকাডেমির মঞ্চে সুদীপ্তা আসবেন ‘শিখণ্ডী’ হয়ে।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement