শুক্রবার থেকে পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেল কলকাতা ও শহরতলির কিছু সিঙ্গল স্ক্রিন সিনেমা হল।
শুক্রবার থেকে পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেল কলকাতা ও শহরতলির কিছু সিঙ্গল স্ক্রিন সিনেমা হল। প্রিয়া, মেনকা, প্রাচী, ইন্দিরা, অশোকা, জয়া, বায়োস্কোপ (দুর্গাপুর), ডাকবাংলো (বারাসাত) সিনেমা হলে শনিবার সকাল থেকেই তালা ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে। হল মালিকেরা কর্মীদের বেতনের আওতায় না এনে শুধু তাঁদের কাজের দিনে বেতন দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
কেন এই সিদ্ধান্ত? প্রিয়া সিনেমার মালিক অরিজিৎ দত্ত আনন্দবাজার ডিজিটালকে বললেন, ‘‘হল খোলার পর থেকে দেখলাম সারাদিনে ৪-৫ জন লোক আসছে সিনেমা দেখতে। আর পেরে উঠছি না। এত বড় এস্টাবলিশমেন্ট চালাব কী করে?’’ তবে অরিজিতের পাল্টা যুক্তি দিয়েছেন নবীনা সিনেমার মালিক নবীন চোখানি। তাঁর কথায়, ‘‘ব্যবসায় লাভ-লোকসান তো থাকবেই। যে ব্যবসা আমায় এত দিন লাভের মুখ দেখাল তাতে ক্ষতি হলেই কি কর্মচারীদের মাইনে দেব না? হল বন্ধ করব?’’ নবীন আরও জানান, যে বাংলা ছবি এতদিন ধরে তাঁকে লাভের মুখ দেখিয়েছে, তার খাতিরে তিনি কষ্ট সহ্য করবেন। কিন্তু হল বন্ধ করবেন না।
প্রসঙ্গত, গত ১৫ অক্টোবর সরকারি নির্দেশ মেনে রাজ্যে সিনেমা হল খুলেছিল। ছবি বিশেষজ্ঞ পঙ্কজ লাডিয়ার কথায়, ‘‘এক মাসের মধ্যেই কিছু হল দুম করে বন্ধ হল কেন? আরও কিছুদিন নিশ্চয়ই সময় দেওয়া যেত। একবার হল খুলছে। আবার বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। বড় ব্যানারের ছবি এলে এই হলগুলোই আবার খুলে যাবে। এই ভাবনা বোধহয় ঠিক নয়।’’ পঙ্কজের মতে, সারাদিন হল না খুলে রেখে শো হিসেবে হল খোলার সিদ্ধান্ত নিলে যে বাংলা ছবিগুলি এখনও চলছে, সেগুলির ক্ষতি হত না।
তা হলে করোনাকালে বাংলা ছবির ভবিষ্যৎ কি অন্ধকার?
প্রশ্ন শুনে কিঞ্চিৎ উত্তেজিত পরিচালক শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় বলছেন, ‘‘বিষয়টা বোঝা এত সহজ নয়। এখানে প্রযোজকদের বিশেষ ভূমিকা আছে। একজন প্রযোজক পুজোতে ছবি রিলিজ করল দেখে সবাইকেই পুজোতে ছবি রিলিজ করতে হল? এ বার হল বন্ধ হলে তাঁরা কোথায় যাবেন? কই বড় ব্যানারের হিন্দি ছবি তো হল-এ রিলিজ হয়নি এখনও। আমরা কি বলব হিন্দি ছবি চলছে না!’’ ছবি ব্যবসা না দিলে হল মালিকেরা সিনেমা হল বন্ধ করতেই পারেন, এ বিষয়ে শিবপ্রসাদ একমত হলেও তিনি মানতে চান না যে, বাংলা ছবির ‘কনটেন্ট’-এর জন্য হল বন্ধ হয়েছে।
বেশ কিছু সিনেমা হলে শনিবার সকাল থেকেই তালা ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে
নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক এক পরিচালক জানালেন, পুজো থেকে এখনও পর্যন্ত বাংলা ছবির হল কালেকশনে ছবির তৈরির ব্যয়ের ২০% অর্থও প্রযোজকের ঘরে আসেনি। সেই সূত্রেই পরিচালক অরিন্দম শীল বলছেন, ‘‘করোনার সময় মানুষের মনে এতটাই ভয় ঢুকে গেছে যে, তারা পয়সা দিয়ে বদ্ধ এয়ারকন্ডিশন্ড হল-এ অন্য লোকের সঙ্গে সিনেমা দেখতে রাজি নয়।’’ তবে অরিন্দম বাংলা ছবির ‘কনটেন্ট’ নিয়েও সংশয় প্রকাশ করেছেন। তাঁর মতে, ‘‘এখন হল-এ শিবপ্রসাদ-নন্দিতার ছবি এলে হয়ত দর্শক হলে যেতেন। কী ছবি রিলিজ করছে, এই সময় সেটাও গুরুত্বপূর্ণ।’’
লকডাউনের সময় থেকে কর্মীদের ন্যূনতম বেতন দিয়ে আসছেন ‘জয়া’ সিনেমার মালিক মনোজিত বণিক। তিনি বললেন, ‘‘নিজের ব্যবসা কি কেউ বন্ধ করতে চায়? ভেবেছিলাম, কালীপুজোর পরে হিন্দি ছবি আসবে। ব্যবসা চলবে। হল না। বাংলা ছবি দিয়ে হল চালাতে পারছি না। রাজ্য বা কেন্দ্রের সরকারও কোনও রিলিফ দিল না। উপরন্তু একজন ছেড়ে ছেড়ে হল-এ বসার নির্দেশ হল। এই সেক্টরটাই দেখলাম করোনায় সবচেয়ে অবহেলিত।’’ মনোজিত জানান, পরিবারের সদস্যরা একসঙ্গে এক গাড়িতে হল-এ আসছেন। অথচ তাঁদের একটা করে সিট ছেড়ে বসানো হচ্ছে। তাঁর বিস্ময়, ‘‘ভিড় বাসে ঝুলতে ঝুলতে মানুষ যাচ্ছে। তাতে তো কিছু হচ্ছে না! সিনেমা হলে গেলেই করোনা হবে? তাই সব নিয়ম সিনেমা হলের জন্য?’’
সরকারের ভূমিকা নিয়ে হলমালিক হিসেবে নবীনের যুক্তি আবার সম্পূর্ণ আলাদা। তাঁর কথায়, ‘‘সরকার কী করবে? সিনেমা হলের লভ্যাংশ তো সরকার নেয় না। এটা তো আর কো-অপারেটিভ সোসাইটি নয়!’’
আরও পড়ুন: সুশান্তের অ্যাকাউন্ট থেকে গায়েব ১৭ কোটি টাকা নিয়ে ইডির জিজ্ঞাসাবাদ 'রাবতা'র প্রযোজককে
বাংলা এবং হিন্দি ছবির ডিস্ট্রিবিউটর রাজকুমার দামানি মনে করেন, সিনেমা হল চালাতে গেলে যে ধরনের কনটেন্ট দরকার, এখন তা নেই। তাঁর কথায়, ‘‘প্রযোজক থেকে ডিস্ট্রিবিউটার— পুজোর সময় থেকে সকলেরই লোকসান হচ্ছে। হল তো বন্ধ হবেই। শুধু বাংলা ছবি দিয়ে সিনেমা হল চলে না। তার উপর দর্শক সংখ্যা ৫০%। দর্শকরাও সে ভাবে বেরোচ্ছেন না। ফলে বলিউডও বড় বাজেটের ছবি রিলিজ করবে না।’’
আরও খবর: মাদককাণ্ডে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য স্বামী-সহ ভারতী সিংহকে নিয়ে গেলেন এনসিবি কর্তারা
হল আপাতত বন্ধ রাখলেও সৃজিত মুখোপাধ্যায়ের ‘কাকাবাবুর প্রত্যাবর্তন’’ মুক্তির সময় আবার সেগুলি খুলতে পারে বলে ইঙ্গিত দিলেন কয়েকজন হল মালিক। সৃজিত বললেন, ‘‘আমি সিনেমা বানাই। ভ্যাকসিন নয়। কাকাবাবু হল-এ এলে বেশ কিছু দর্শক হলে যাবেন। অ্যাডভেঞ্চার, আফ্রিকা দেখতে চাইবেন ঘরবন্দি মানুষ। কিন্তু সবটা তো আর বদলাবে না। আমরা সবাই ভ্যাকসিন আসার অপেক্ষায়। সিনেমার এত ক্ষমতা নেই।’’