সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়কে নিয়ে কলম ধরলেন সৈকত মিত্র
শ্যামল গুপ্ত। লোকে বলেন, তিনি নাকি সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের নিয়ন্তা। আমি কিছুটা হলেও চোখে দেখেছি। শ্যামল মিত্রের ছেলে। তাই ছোট থেকেও সন্ধ্যা পিসি এবং শ্যামল গুপ্ত আমায় চিনতেন। ভালও বাসতেন। একটু বড় হওয়ার পরে দেখেছি, ব্যক্তি শ্যামল গুপ্ত মানুষ যতটা ভাল, ততটাই একরোখা। এক কথার মানুষ। সবার সঙ্গে মিশতে পারতেন, এমন নয়। মিশে গেলে তিনি তাঁর বুকের কাছের মানুষ। পরে বড় হয়ে যখন ওঁর লেখা গান করেছি, কত সময়ে ফোন করে আমায় গানের কথা বুঝিয়ে দিয়েছেন। শিখিয়ে দিয়েছেন, কী করে উচ্চারণ করব। বলতেন, ‘‘তুই তো খুব ছোট। যদি বুঝতে না পারিস! তাই ধরিয়ে দিচ্ছি।’’
সেই মানুষটিই তাঁর স্ত্রী সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় সম্পর্কে দারুণ সজাগ। কত সময়ে আমি ওঁদের বাড়িতে গিয়েছি। শ্যামল গুপ্ত কথা বলেছেন। সন্ধ্যা পিসি আসেনইনি! কথা হয়ে গিয়েছে। চলে এসেছি। খুব দরকার পড়লে উনি ডাকতেন। তখন সন্ধ্যা পিসি এসে হয়তো সামান্য কিছু কথা বলতেন। তার পরেই ভিতরে চলে যেতেন। যত দিন জীবিত ছিলেন, তাঁকে ডিঙিয়ে বা এড়িয়ে সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের নাগাল কেউ কখনও পাননি।
বাস্তবে এঁরা কিন্তু পরস্পরকে চোখে হারাতেন। সেই সময়ে তাঁদের প্রেম অসম ছিল। মুখোপাধ্যায় পরিবারের মেয়ে গুপ্ত পরিবারে যাবে, একেবারে মানতে পারেননি সন্ধ্যা পিসির বাড়ির কেউ। ফলে, বহু দিন পর্যন্ত তাঁরা অপেক্ষা করেছেন একে অন্যের জন্য। তাঁদের সেই প্রেম জন্ম দিয়েছে কিছু চিরদিনের গানের। ‘আমি এত যে তোমায় ভালবেসেছি’ বা ‘আর জনমে হয় যেন গো তোমায় ফিরে পাওয়া’-র মতো গান তাঁদের ভালবাসার চিহ্ন। অবশেষে দুই শিল্পীর প্রেমের কাছে নতিস্বীকার করতে বাধ্য হয়েছিলেন সন্ধ্যা পিসির পরিবার। বিয়ে যখন ঠিক, তখন নাকি শ্যামল গুপ্ত হবু স্ত্রীকে বলেছিলেন, ‘‘যত বড় শিল্পীই হও, আমায় বিয়ে করে তোমায় কিন্তু থাকতে হবে আমার ছোট একতলা বাড়িতেই।’’ পিসি কোনও দিনই মুখ ফুটে কিছু বলার মানুষ নন। সে দিনও চুপচাপ শুনেছিলেন।
অনেকের কৌতূহল, স্ত্রী স্বামীর থেকে জনপ্রিয় হলে পুরুষমন কি নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে? সেই অনুভূতি থেকেই কি এই দাপট? আমি বলব, এর পাশাপাশি আরও একটি কারণ ছিল। সন্ধ্যা পিসি ভীষণ নার্ভাস ছিলেন। তার উপরে যখনই কোথাও যেতেন, তাঁকে ঘিরে লক্ষ লোকের ভিড়। সেই মুহূর্তে এক জন নারীকে আগলাতে এক জন দাপুটে পুরুষেরই প্রয়োজন। শ্যামল গুপ্ত ছিলেন সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের জীবনের সেই আগল। যিনি শেষ দিন পর্যন্ত তাঁর দায়িত্ব পালন করেছেন। আর তাঁর হাতে নিজেকে সঁপে দিয়ে নিশ্চিন্তে গান নিয়ে জীবন কাটিয়েছেন ‘গীতশ্রী’ সন্ধ্যা।