(বাঁ দিকে) ঋতুপর্ণ ঘোষ, শিলাজিৎ মজুমদার (ডান দিকে)। ছবি: সংগৃহীত।
অভিজ্ঞতার কথা বলতে গেলে প্রথমেই মনে হয় ‘বাপ রে’।
তখন ঋতুর আট থেকে দশ জন সহযোগী। তাঁদেরই একজন ঝুমদি (সুদেষ্ণা রায়) বললেন একবার দেখা করতে। নতুন ছেলে খুঁজছে। আমার ক্যাসেটের ছবি দেখিয়ে নাকি নাম প্রস্তাব করেছিলেন ঝুমদি। কিন্তু সে ছবি পছন্দ হয়নি ঋতুর। তবুও ঝুমদি চান আমাকে একবার সামনে থেকে দেখুন ঋতুপর্ণ।
গেলাম দেখা করতে। ঋতু দেখল, বলল ‘‘ওমা এ তো খুব সুন্দর দেখতে ।’’ তার পর একটু উঠে দাঁড়াতে বলল। আমার খুব অস্বস্তি হল, যেন কনে দেখছে! তার পর বলল ‘‘ও মা তুমি তো বেশ লম্বাও।’’ এর কী উত্তর দেওয়া উচিত, বুঝতে পারিনি। জিজ্ঞেস করল, ‘‘কখনও ডাবিং করেছ?’’
গানের ডাবিং করেছি, সংলাপ নয়। তবে চেষ্টা করতে পারি। সেই সময় ‘দহন’-এর ডাবিং চলছে। জয়ন্ত দত্ত বর্মণের কিছু সংলাপ আমাকে দিয়ে বলানো হল। আমার গলাটাই রেখে দিয়েছিল ঋতু। তারপর আমাকে বলল, ‘‘একটা ছোট ছবি করব, তোমার রোলটা খুব ছোট, তুমি কি করবে?’’
আমি রাজি হয়ে গেলাম, ছোট-বড় বলে কিছু হয় না। কিন্তু ‘অসুখ’-এ অভিনয়ের অভিজ্ঞতা আমার কাছে অদ্ভুত।
আমার চরিত্রের একটা চশমা ছিল। সেই চশমাটা প্রযোজনা সংস্থার। সামান্য পাওয়ার ছিল। তাই আমার একটু অসুবিধা হচ্ছিল। বেশি ক্ষণ পরে থাকলে মাথা ধরে যাচ্ছিল। জিজ্ঞেস করেছিলাম, একটা শট কি চশমা ছাড়া দিতে পারি, বা শটের মধ্যে চশমাটা খুলতে পারি?
ঋতু বলেছিল, ‘‘না চশমা সারা ক্ষণ পরে থাকতে হবে। চরিত্রটা এ রকমই। আর শটের মধ্যে চশমা খুলবে কেন, তুমি কি উত্তমকুমার নাকি!’’
এমনিতেই তখন আমি নতুন, আগে দু’একটা অভিনয় করেছি, কিন্তু দেবশ্রী, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে অভিনয় করতে অস্বস্তি হচ্ছে। মনে হচ্ছে হঠাৎ কোথায় একটা এসে পড়েছি! দেবশ্রী খুব সাহায্য করেছিল। তখন ওর আকাশছোঁয়া খ্যাতি, তবু আমার সঙ্গে খুব সহজে মিশেছিল।
তো যাই হোক, চশমাটায় অসুবিধ হচ্ছিল বলে বার বার সাজঘরে গিয়ে চশমাটা খুলে রাখছিলাম। শটের সময় আবার পরে নিচ্ছিলাম। একটা শট ছিল, যেখানে দেবশ্রী ঘুমের ওষুধ খেয়ে নেবে। এ রকম সময় আমার ওর কাছে পৌঁছনোর কথা। দারুণ শট হল, সকলে প্রশংসা করল। আমি ফিরে গেলাম সাজঘরে।
ঢুকেই প্রথম যেটা চোখে পড়ল, সেটা আমার সেই চশমাটা। অর্থাৎ, চশমা ছাড়াই একটা দারুণ শট দিয়ে এসেছি। কী হবে এ বার! ভাবতে ভাবতে ঋতুর কাছে গিয়েই বলে ফেলছি কথাটা। খুব সহজ ভাবে, প্রায় হাসতে হাসতে বলেছি, বিষয়টার গুরুত্ব বুঝতে পারিনি হয়তো।
ঋতু প্রচণ্ড চিৎকার করে উঠল। খুব বাজে প্রতিক্রিয়া দিল। তখন ফিল্মে শুট হত। ঋতু বলতে শুরু করল, ‘‘এটা অভিনেতার দায়িত্ব। ক্রম বজায় রাখা তোমার দায়িত্ব। সৌমিত্রদা এখনও এ সব দিকে খেয়াল রাখেন, তুমি কে?’’
আমি থ হয়ে গিয়েছি, আমার সঙ্গে এই ভাবে কথা বলছে! আমার ভাই, বাবা, মা কারও ক্ষমতা নেই আমার সঙ্গে এই ভাবে কথা বলার। পৃথিবীতে কোনও লোক আমার সঙ্গে ওই ভাবে কথা বললে আমি তার গলাটা টিপে ধরব।
কিন্তু আমি চুপচাপ শুনে গেলাম। তারপর ঝুমদির কাছে গিয়ে বললাম, আমি ছবিটা করব না। আমার বিরক্ত লাগছে। এ ভাবে কথা বলবে কেন আমার সঙ্গে? আমিও তো বাজে ভাবে কথা বলতে পারতাম। আমি ওর থেকেও বাজে ভাবে কথা বলতে পারি। ঝুমদিকে বললাম, আমি তো প্রশিক্ষিত অভিনেতা নই, উনি জানেন। আমার ভুল হয়েছে, আমি সততার সঙ্গে সেটা স্বীকার করেছি। তার পরও সেটে সকলের সামনে এ ভাবে কথা বলবেন!
আমার খারাপ লেগেছিল এটা, যে পরিচালক নিজে দেখছেন, সেটে কাজ করছেন তাঁর ৮ জন সহযোগী, সিনেমাটোগ্রাফার, তাঁর সহযোগী, আমার সহ-অভিনেতারা, তাঁরা কেউ খেয়াল করলেন না। এমনকি, আমি যদি বিষয়টা স্বীকার না করতাম, তা হলে তো আর কিছু করার থাকত না। একেবারে শেষে গিয়ে ওঁরা জানতে পারতেন আমার চোখে চশমাটা ছিল না। আমি বলেছিলাম এত কিছুর পরও শুধু আমার উপর চিৎকার!
ঝুমদি বললেন, ‘‘তুই তো জানিস ঋতু কী রকম মাথা গরম করে ফেলে।’’ আমি তখন মনে মনে বলছি, ঋতু তো জানে না আমি কী রকম মাথা গরম করি!
তো যাই হোক, শেষ পর্যন্ত ঝুমদিই আমাকে বুঝিয়ে শান্ত করে। সত্যিই মানুষ হিসেবে তো একটা দায়িত্ব থাকে। একটা শুট এতখানি হয়ে যাওয়ার পর কাজ ছেড়ে দিয়ে কাউকে বিপদে ফেলা উচিত নয়। ছবিটা নষ্ট হয়ে যাবে। পরে অবশ্য সব ঠিক হয়ে গিয়েছিল।