জীবনে মাতৃত্বের স্বাদ পাওয়ার বহু আগেই পর্দায় অভিনয় মায়ের ভূমিকায়। বিয়ের পরে অভিনেত্রী হিসেবে যাঁরা জায়গা করে নিতে পেরেছেন বিনোদন দুনিয়ায়, তাঁদের মধ্যে অন্যতম শেফালি শাহ। পরবর্তীতে ব্যক্তিগত টানাপড়েনে প্রভাবিত হয়নি কেরিয়ার।
শেফালির জন্ম মুম্বইয়ে, ১৯৭২ সালের ১৯ জুলাই। সান্তাক্রুজে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়ার আবাসনে বড় হওয়া। তাঁর বাবা সুধাকর শেট্টি ছিলেন আরবিআই-এর কর্মী। মা শোভনা ছিলেন চিকিৎসক।
আর্য বিদ্যামন্দির স্কুলে পড়ার সময় থেকেই অভিনয়ের প্রতি আকর্ষণ। অভিনয় করতেন গুজরাতি নাটকে। কলেজজীবনে অভিনয়ের নেশা আরও অনেকটা জায়গা নিয়ে নেয় শেফালির জীবনে।
মঞ্চে কাজ করতে করতেই সুযোগ দূরদর্শনে। পল্লবী জোশীর পরিচালনায় শেফালির প্রথম ছোটপর্দায় অভিনয় ‘আরোহণ’ সিরিয়ালে। ক্রমে নয়ের দশকে তিনি হয়ে ওঠেন টেলিভশনের সেরা চরিত্রাভিনেতাদের এক জন।
‘নয়া নুক্কড়’, ‘বনেগি আপনি বাত’, ‘হসরতেঁ’-সহ বহু ধারাবাহিকের সাফল্যের কারিগরদের মধ্যে প্রথম সারিতে ছিলেন শেফালি।
টেলিভিশনের সাফল্যে দেরি হয়নি বড় পর্দায় অভিনয়ের সুযোগ আসতেও। প্রথম কাজ ১৯৯৫ সালে, রামগোপাল বর্মার ‘রঙ্গিলা’ ছবিতে। মাত্র কয়েকটি দৃশ্যে দেখা গিয়েছিল শেফালিকে।
পরে সাক্ষাৎকারে শেফালি বার বার জানিয়েছেন, প্রথম ছবিতে অভিনয়ের তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা। শেফালির অভিযোগ, শ্যুটিংয়ের আগে তাঁকে স্পষ্ট করে কিছুই জানানো হয়নি। বলা হয়নি ছবিতে তাঁর উপস্থিতি কতগুলি দৃশ্যে থাকবে।
১৯৯৮ সালে মুক্তি পায় তাঁর দ্বিতীয় ছবি ‘সত্য’। এই ছবিতে মনোজ বাজপেয়ীর স্ত্রীর চরিত্রে শেফালির অভিনয় দাগ কেটে গিয়েছিল দর্শকদের মনে।
এর পর শেফালির নামের পাশে যোগ হয়েছে একের পর এক বড় ছবি। ‘মহাব্বতেঁ’, ‘মনসুন ওয়েডিং’, ‘ওয়ক্ত’, ’১৫ পার্ক অ্যাভিনিউ’, ‘কার্তিক কলিং কার্তিক’, ‘লক্ষ্মী’, ‘দিল ধড়কনে দো’-সহ বিভিন্ন ধরনের ছবিতে নানা ভূমিকায় ধরা পড়ে তাঁর অভিনয় দক্ষতা।
ঋতুপর্ণ ঘোষের পরিচালনায় ‘দ্য লাস্ট লিয়র’-এ অভিনয় শেফালিকে এনে দিয়েছে সেরা সহ অভিনেত্রী বিভাগে জাতীয় পুরস্কার। এ ছাড়াও প্রতিভার স্বীকৃতিস্বরূপ পেয়েছেন আরও বহু পুরস্কার। তুলু, হিন্দি, গুজরাতি, মরাঠি এবং ইংরেজিতে স্বচ্ছন্দ শেফালি কাজ করেছেন শর্ট ফিল্ম এবং ওয়েব সিরিজেও।
অভিনয় সূত্রেই শেফালির সঙ্গে নয়ের দশকে আলাপ অভিনেতা হর্ষ ছায়ার সঙ্গে। দু’জনেরই অভিনয়ের প্রতি আকর্ষণের কারণে আলাপ প্রেমে রূপান্তরিত হতে সময় নেয়নি।
হর্ষকে ১৯৯৭ সালে বিয়ে করেন শেফালি। কিন্তু তাঁদের দাম্পত্য সুখের হয়নি। ৪ বছর পরেই ডিভোর্স হয়ে যায়। বিচ্ছেদ নিয়ে শেফালি কোনও দিন মুখ খোলেননি। কিন্তু হর্ষ কার্যত দায়ী করেছেন নিজেকেই।
এক সাক্ষাৎকারে হর্ষ এ-ও বলেছেন তাঁদের বিচ্ছেদ পর্ব ছিল তিক্ত। ডিভোর্সের পরেও তাঁদের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক নেই। দু’জনে কোনও সম্পর্ক রাখতেও চান না। শেফালির সঙ্গে বিচ্ছেদের পরে হর্ষ বিয়ে করেছেন বাঙালি অভিনেত্রী সুনীতা সেনগুপ্তকে।
অভিনেত্রীজীবনের শুরুতে গুজরাতি নাটকে অভিনয়ের সময়ে শেফালির সঙ্গে আলাপ হয়েছিল বিপুল অমৃতলাল শাহের। পরে বিপুল জানান, তখন থেকেই তিনি শেফালির গুণমুগ্ধ। কিন্তু প্রথম দিকে সাড়া পাননি শেফালির কাছ থেকে।
বরং হর্ষের সঙ্গে বিবাহিত জীবনে অনেক কাছাকাছি আসেন শেফালি-বিপুল। বিবাহিত জীবনের তিক্ততাই হয়তো দু’জনের মধ্যে বন্ধুত্ব গড়তে সাহায্য করেছিল। পরে প্রযোজক-পরিচালক বিপুলকেই বিয়ে করেন শেফালি।
বিয়ে-বিচ্ছেদ-দ্বিতীয় দাম্পত্যের টানাপড়েনের মাঝেও শেফালির অভিনয়ধারা চলেছে স্বাভাবিক ছন্দেই। এখন তিনি ব্যস্ত অভিনেত্রীর পাশাপাশি দায়িত্ববান মা-ও।
শেফালি এবং বিপুলের দুই ছেলে আর্যমান এবং মৌর্য দু’জনেই প্রবাসী। পড়াশোনা নয়, মূলত ফুটবলের প্রশিক্ষণ নিতেই তাঁরা বিদেশে। তাঁদের প্রতিষ্ঠিত ফুটববলার হিসেবেই দেখতে চান শেফালি এবং বিপুল।
দুই ছেলেকেই বিদেশে পাঠিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে কষ্ট হয়েছে। এ কথা স্বীকার করেন শেফালি। কিন্তু ছেলেদের ভবিষ্যতের কথা ভেবেই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বলে জানিয়েছেন তাঁরা।
জীবনের সব গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় শেফালির পাশে থেকেছেন বিপুল। তাঁর সঙ্গে বিবাহিত জীবন অনেক কিছু শিখিয়েছে বলে দাবি শেফালির। শান্ত স্বভাবের বিপুলকে দেখে শেফালিও নিজের রাগ প্রশমিত করতে অভ্যস্ত হয়েছেন।
আদ্যন্ত রোমান্টিক শেফালি এখনও ফিরে পেতে চান পুরনো দিনগুলি। যখন তিনি আর বিপুল রাস্তায় দাঁড়িয়ে খাবার খেতে স্বচ্ছন্দ ছিলেন। বিপুল অবশ্য মাঝে মাঝেই ভুলে যান স্ত্রীর জন্মদিন বা তাঁদের বিবাহবার্ষিকীর তারিখ।
শেফালি কোনও দিন নায়িকা হতে চাননি। চরিত্রাভিনেত্রী হিসেবে নিজের পরিচয় নিয়েই তিনি খুশি। বরং, তিনি সেই কুশীলবদের মধ্যে এক জন, যাঁরা পর্দায় এলে নায়ক নায়িকাদের উপর থেকেও সরে যায় দর্শকদের নজর।
এক জন আদর্শ অভিনেত্রীর শর্ত মেনে ৩২ বছর বয়সি শেফালি ‘ওয়ক্ত’ ছবিতে ৩৭ বছর বয়সি অক্ষয়কুমারের মায়ের ভূমিকায় অভিনয় করেছেন। ছবিতে শেফালির স্বামীর ভূমিকায় ছিলেন প্রায় দ্বিগুণ বয়সি অমিতাভ বচ্চন।
অভিনয়ের পাশাপাশি শেফালির মূল শখ ছবি আঁকা। তিনি স্পেনে ৩ মাস ছবি আঁকার প্রশিক্ষণও নিয়েছেন। তাঁর ছবি প্রায়ই জায়গা করে নেয় বিভিন্ন গ্যালারি এবং প্রদর্শনীতে। নায়িকা হওয়ার ইঁদুরদৌড় থেকে দূরে এ ভাবেই জীবন উপভোগ করেন তিনি।