Chanchal Chowdhury in Padatik

চঞ্চলের সঙ্গে একদিন, প্রতিদিন সৃজিতের সঙ্গে, ‘পদাতিক’-এর শুটিংয়ে আনন্দবাজার অনলাইন

মৃণাল সেনের বায়োপিক তৈরি করছেন সৃজিত মুখোপাধ্যায়। নামভূমিকায় চঞ্চল চৌধুরী। শুটিং সেটে একটি দিন কাটাল আনন্দবাজার অনলাইন।

Advertisement

পৃথা বিশ্বাস

শেষ আপডেট: ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ০৮:১৫
Share:
Set visit of Srijit Mukherjee’s new film on Mrinal Sen’s biopic Padatik starring Chanchal Chowdhury

‘পদাতিক’-এর সেটে অভিনেতা চঞ্চল চৌধুরী। — নিজস্ব চিত্র।

সকাল ১০.০০

Advertisement

পরিচালক সৃজিত মুখোপাধ্যায় তখন তাঁর টিমের লোকজন নিয়ে বেচু চ্যাটার্জি স্ট্রিট ঘুরে ঘুরে দেখছেন। মধ্য কলকাতার সরু গলি। তার মধ্যেই লোকজনের ভিড়, সাইকেল, গাড়ি, ঠ্যালাগা়ড়ি— বাদ নেই কিছুই। ভিড়ের মাঝেই গলির মাথায় ঠিক হল শট নেওয়ার লোকেশন। প্রপ এল, ক্যামেরা বসল, লাইট-রিফ্লেক্টরের যাবতীয় সরঞ্জাম এল। তার পর জ়োন ব্লক করার ব্যবস্থা শুরু হল। কিন্তু সে কি আর মুখের কথা! অহরহ গাড়ি চলছে। মানুষের আনাগোনা। গলির মুখেই বেশ কয়েকটা মুদিখানার দোকান। সকালবেলা, তাই ক্রেতাও প্রচুর। নুন-তেল কিনতে লোকে আসছেন। তার মধ্যেই যাঁরা বুঝে যাচ্ছেন এখানে শুটিং হবে, তাঁরা দাঁড়িয়ে পড়ছেন কিসের শুটিং দেখার জন্য।

সকাল ১০.৪৫

Advertisement

শট রেডি। আর্টিস্টকে ডাকা হচ্ছে। তার মধ্যেই প্রচুর ভিড় জমে গিয়েছে। কেউ কেউ আবার সৃজিতের পাশে গিয়ে এই সুযোগে নিজস্বী তুলতে চাইছেন। এত ব্যস্ততায়ও কিন্তু তাঁদের ফেরাচ্ছেন না পরিচালক। খুব ঠান্ডা মাথায় বলছেন, ‘‘নিশ্চয়ই। রাস্তার ও পারে চলুন, তা হলেই পাবেন, এখানে ক্যামেরা বসছে তো।’’

সরু গলির আর এ পার, ও পার! ভিড়ের মধ্যেই কোনও রকমে দাঁড়িয়ে ইউনিটের লোকজন। একটি মুদিখানার দোকানে পুরনো আমলের রিসিভার ফোন বসানো হয়েছে। পিছনে কিছু হাতে আঁকা পোস্টার লাগানো হল। বেজায় কোলাহলের মাঝেই দেখা গেল এক লম্বা সাদা পায়জামা-পাঞ্জাবি পরা ব্যক্তি। এক মাথা চুল, চোখে মোটা কালো ফ্রেমের চশমা। চারপাশে হাজার ব্যস্ততার মাঝেও তিনি যে নিজের জগতে ব্যস্ত, তা এক ঝলক দেখলেই বোঝা যায়। সিনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন তিনি, নিজের মতো করে।

মুহূর্তের মধ্যেই শুটিং শুরু হয়ে গেল। পরিচালক পারফেকশনিস্ট। তিনি জানেন, ঠিক কোন শটটা তাঁর লাগবে। তাই সাত-আটটা টেক নিলেন। তত ক্ষণে জমে থাকা ভিড়ও একটু উৎসাহ হারিয়ে নিজেদের কাজে ফিরে যাচ্ছে। কিন্তু অভিনেতার কোনও রকম ক্লান্তি নেই। তিনি প্রত্যেকটা টেকেই একই রকম স্বতঃস্ফূর্ত। রাস্তার লোক সৃজিতকে যতটা চিনতে পারছেন, ততটা তাঁকে হয়তো পারছেন না। আবার কেউ কেউ নাম মনে করতে পারছেন না, কিন্তু বলে দিচ্ছেন তিনি বাংলাদেশি অভিনেতা। পাশাপাশি ভাল গানও গাইতে পারেন। যাঁরা সেটুকুও পারছেন না, তাঁরাও কিন্তু তাঁর দৃঢ় কণ্ঠ আর আন্তরিক অভিনয় দেখে দাঁড়িয়ে পড়ছেন। এমনই জোর তাঁর অভিনয়ের। তিনি চঞ্চল চৌধুরী। মৃণাল সেনের বায়োপিকে নামভূমিকায়।

অবিকল। মৃণাল সেনের বায়োপিকে নামভূমিকায় চঞ্চল চৌধুরী। ছবি: সংগৃহীত

সকাল ১১.১৫

বেচু চ্যাটার্জি স্ট্রিট থেকে আরও একটি সরু গলি ঢুকে গিয়েছে। দু’পা হাঁটতেই একটি পুরনো চার তলা বাড়ি। তার এমনই ভগ্নদশা যে, বাড়িতে ওঠা কতটা নিরাপদ তা নিয়ে মনে সংশয় জাগবে। সেট বসেছে তিন তলায়। সরু সিঁড়ি। তার মধ্যেই ইউনিটের লোকজন ওঠানামা করছেন। আগের শট চলাকালীনই এই শটের লাইট কত দূর এগিয়েছিল, খোঁজ নিয়েছিলেন পরিচালক। তাই লাইটের লোকও মন দিয়ে কাজ করে সেট পুরো তৈরি করে রেখেছেন।

উপরে পৌঁছে বোঝা গেল, জায়গাটা বেশ ছোট। তার মধ্যে এত লোক, এত যন্ত্রপাতি, হাঁটাচলা করাই দায়। চঞ্চল তার মধ্যেই একটি ঘরে বসে পরের দৃশ্যের সংলাপ ঝালিয়ে নিচ্ছেন। সে ঘরে ফ্যান নেই। পরিচালকের সহকারীরা আমতা আমতা করছেন চঞ্চলের গরম লাগবে বলে। চঞ্চলের অবশ্য সেই নিয়ে কোনও মাথাব্যথা নেই।

যেখানে ক্যামেরা বসেছে, সেখানে ইতিমধ্যেই মনামি ঘোষ কস্টিউম পরে তৈরি। মৃণাল সেনের স্ত্রী গীতা সেনের চরিত্রে অভিনয় করছেন তিনি। পরিচালক তাঁকে তাঁর পজ়িশন বোঝাচ্ছেন। ঘরের মধ্যেই নিজের মনে খেলা করে বেড়াচ্ছে এক শিশুশিল্পী। এত লোক, এত আলো নিয়ে তার কোনও মাথাব্যথা নেই।

শট শুরু হল। বেশ কয়েকটা টেকের পর ক্লোজ় নেওয়ার পালা। বাচ্চা ছেলের আর প্রয়োজন নেই। তাকে ছেড়ে দেওয়া হল। কিন্তু সে তত ক্ষণে দৌড়ে পৌঁছে গিয়েছে মনিটরের কাছে। সেটের দিদিরা তাকে যে চকোলেট দিয়েছে, সেটা গলে গিয়েছে কেন? সোজা পরিচালককে নালিশ! সৃজিত অবশ্য ক্লোজে মনামি-চঞ্চল কোথায় দাঁড়াবেন, ক্যামেরায় কেমন দেখাচ্ছে তাঁদের, কোথায়ও অ্যাক্সিস জাম্প হচ্ছে কি না, কারও উপর ফোকাস সফ্‌ট কি না— এ সব দেখার মাঝেই অনর্গল বাচ্চাটির সঙ্গে গল্প করে যাচ্ছেন। কিউ দিতে দিতেই বেশ কয়েকটি টেক নিলেন পরিচালক। প্রত্যেক বারই অভিনেতাদের স্পষ্ট ভাবে বুঝিয়ে দিচ্ছেন, ঠিক কোন ধরনের অভিব্যক্তি চান। যত বার টেক হল, তত বার নিজেই কিউ দিলেন, কোনও এডি (সহকারী পরিচালক) নয়। যা চাইছেন, তা পেয়ে যেতেই বলে উঠলেন, ‘‘লোকেশন চেঞ্জ’’।

মৃণাল সেন আসলে কলকাতাকে ভীষণ ভালবাসতেন। এলডোরাডো বলতেন। সেই এলডোরাডো আজ মৃণাল সেনকে ভুল গিয়েছে, বলে মনে করেন সৃজিত।

দুপুর ২.৩০

মধ্য কলকাতা থেকে গোটা ইউনিট পৌঁছে গিয়েছে দেশপ্রিয় পার্ক। একটি তিন তলা বাড়িতে পরের লোকেশন। অনেকেই ব্যস্ত লাঞ্চ করতে। চঞ্চলও একটু মেকআপ রুমে জিরিয়ে নিচ্ছেন। তিন তলায় সাজানো হচ্ছে পরের দৃশ্যের সেট। পরিচালক তাঁর টিমকে প্রপ নিয়ে খানিক বকাঝকা করলেন। তার পর হেসে বললেন, ‘‘এই ছবিটা আসলে একদমই ভালবাসার জায়গা থেকে বানানো। কোনও রকম স্ট্র্যাটেজি বা টাকা কামানোর লক্ষ্য থেকে নয়। মৃণাল সেন আসলে কলকাতা শহরটাকে ভীষণ ভালবাসতেন। এলডোরাডো বলতেন। সেই এলডোরাডো আজ মৃণাল সেনকে ভুল গিয়েছে। কোনও রাস্তার নাম, পার্কের নাম, মেট্রো স্টেশনের নাম, কোথাওই তিনি নেই। তাই কলকাতাকে মনে করিয়ে দেওয়া এই ট্রিবিউটের মাধ্যমে।’’ সৃজিতের গল্প বলার স্টাইল দেখে কখনও মনে হয়নি, তিনি মৃণাল সেনের এত ভক্ত। শুনে অবশ্য পরিচালক সঙ্গে সঙ্গে বললেন, ‘‘সত্যজিৎ রায়, তপন সিংহ এবং মৃণাল সেন— এই তিন জনের কাজই আমায় যথেষ্ট প্রভাবিত করেছে। আমি মনে করি প্রত্যেক পরিচালকের তাঁর নিজস্ব স্টাইল থাকা বাঞ্ছনীয়। তাই মৃণাল সেনের সিনেমার আর আমার ছবির মধ্য তফাত থাকলেও ওনার ফিল্মমেকিংয়ের অনেক ছোট ছোট এলিমেন্ট কিন্তু আমার অনেক ছবিতে ব্যবহার করেছি।’’

মৃণাল সেনের স্ত্রী গীতা সেনের চরিত্রে অভিনয় করছেন মনামি ঘোষ। ছবি: সংগৃহীত।

পরিচালক আবার সেটের খুঁটিনাটি ঠিক আছে কি না দেখতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। তাই দোতলায় মেকআপ রুমে ঢুঁ মারা গেল। সৃজিত আগেই বলেছিলেন, এ ছবির চিত্রনাট্য তাঁর ২০২১ সালেই লেখা হয়ে গিয়েছিল। ‘আয়নাবাজি’তে দেখা থাকলেও ‘কারাগার’ এবং ‘তকদির’ দেখার পরই তাঁর প্রথম মনে হয়, চঞ্চলই ‘পদাতিক’-এর মুখ। তবে শুধু চেহারায় মিল থাকা শেষ কথা নয়, বরং ব্যক্তিত্বের নির্যাসকে ধরতে পারবেন, এমন অভিনেতাকেই কাস্ট করায় বিশ্বাসী স়ৃজিত। সব ভেবেই তিনি চঞ্চলকে বেছে নিয়েছিলেন। সৃজিতের মৃণাল সেনকে দেখতে ঢোকা গেল মেকআপ রুমে। ধৈর্য ধরে মেকআপ নিচ্ছেন তিনি। ইউনিটের অনেকে লাঞ্চ করে নিলেও চঞ্চলের খাবার এসে পৌঁছয়নি তখনও। এ দিকে উপরে পরিচালক তাড়া দিচ্ছেন শটের জন্য। চঞ্চল অবশ্য বললেন, ‘‘আমি না খেয়েও শটটা দিয়ে আসতে পারি।’’ কিন্তু প্রোডাকশনের ছেলেরা তত ক্ষণে সযত্নে টেবিল পেতে খাবার সাজিয়ে ফেলেছেন। এ দিকে পরিচালক শেষ মুহূর্তে বলেছেন এই দৃশ্যে মনামিকেও লাগবে। তাই অভিনেত্রীও মেকআপে বসেছেন। তাই চঞ্চলও চট করে ভাত-ডাল-আলুভাজা খেতে বসে পড়লেন। সেই সুযোগে একটু আড্ডা মেরে নেওয়া গেল অভিনেতার সঙ্গে।

সৃজিতকে কেমন দেখছেন? প্রশ্ন শুনে এক মুহূর্তও অপেক্ষা করলেন না অভিনেতা, ‘‘ওর অনেক ছবি তো আগেই দেখেছিলাম। তাই জানতাম কী ধরনের সিনেমা ও বানায়। এখন কাজ করতে গিয়ে বুঝলাম, পরিচালক হিসাবে ওর ভাবনাটা কতটা পরিষ্কার।’’ চঞ্চল জানালেন, তিনি খুব বেছে ছবি করেন বলেই এই ছবিতে রাজি হয়েছেন। তিনি চেয়েছিলেন তাঁর টলিউ়ডের প্রথম ছবি কোনও বিশেষ কাজ দিয়েই হোক। তাঁর কথায়, ‘‘মৃণাল সেনের চরিত্রটি যে কোনও শিল্পীর জন্য অনেক বড় একটি চ্যালেঞ্জ। যে কোনও বায়োপিকেই দর্শক হুবহু মেলানোর চেষ্টা করে। কিন্তু আরও এক জন মানুষের সঙ্গে হুবহু মিলে যাওয়া তো সম্ভব নয়। প্রথম দিকে একটু ভয় লাগছিল। কিন্তু স়ৃজিত খুব সাহায্য করেছে। আমায় অনেক মেটিরিয়াল দিয়েছে দেখার জন্য। তখন আমি আগ্রহটা বেশি পাই।’’

চঞ্চলও পরিচালকের সঙ্গে একমত। তিনি মৃণাল সেনের সঙ্গে নিজের চেহারার খানিক মিল পেলেও, সেটাই যে শেষ কথা নয়, তা জোর দিয়ে বললেন, ‘‘আদল মেলালে দেখতে কাছাকাছি লাগে। কিন্তু একটা মানুষের ব্যক্তিত্ব, দর্শন, আদর্শের জায়গাটা ধরতে গেলে তাঁকে নিয়ে গবেষণা করতে হয়। মৃণাল সেন নিজের ছবির মধ্যে দিয়েই নিজের পরিচয়টা দিয়ে গিয়েছেন। তাই সেগুলো ভাল করে বোঝার চেষ্টা করেছি।’’

সৃজিত জানালেন, মৃণাল সেনের জীবনটাকে ধরার চেষ্ট করছেন এই ছবির মাধ্যমে। এবং শুধু তাঁর জীবনের গল্প বলা নয়, তাঁর সিনেমার অনেক স্টাইলই থাকবে এই ছবির মধ্যেও। ছবি মুক্তির যদিও এখনই কোনও নির্দিষ্ট সময় ঠিক করেননি নির্মাতারা।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement