ঋজু মেরুদণ্ডেই সেরা বাঙালির উদ্ভাস

দশকপূর্তিতে বাংলা তথা ভারতীয় ইতিহাসের পাপক্ষালন করল সেরা বাঙালি। নিঃশব্দে সুকুমার সেনকে মনে পড়িয়ে দিল। সুকুমার সেনের জন্য এ দেশে কোনও পুরস্কার ছিল না। অথচ পঞ্চাশের শুরুতে এই বাঙালি আইসিএস অফিসারকে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যসচিবের পদ থেকে ডেপুটেশনে দিল্লি নিয়ে যান প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু।

Advertisement

গৌতম চক্রবর্তী

কলকাতা শেষ আপডেট: ২৮ জুলাই ২০১৪ ০৩:৩১
Share:

রাজনীতির বাইরে...। রবিবার এবিপি আনন্দের ‘সেরা বাঙালি’ অনুষ্ঠানে আলিঙ্গনে ধরা দিলেন দুই সাংসদ। ছবি: বিশ্বনাথ বণিক।

দশকপূর্তিতে বাংলা তথা ভারতীয় ইতিহাসের পাপক্ষালন করল সেরা বাঙালি। নিঃশব্দে সুকুমার সেনকে মনে পড়িয়ে দিল।

Advertisement

সুকুমার সেনের জন্য এ দেশে কোনও পুরস্কার ছিল না। অথচ পঞ্চাশের শুরুতে এই বাঙালি আইসিএস অফিসারকে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যসচিবের পদ থেকে ডেপুটেশনে দিল্লি নিয়ে যান প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু। ১৯৫২ সালে দেশে প্রথম সাধারণ নির্বাচন, সুকুমার সেনকে হতে হবে মুখ্য নির্বাচনী কমিশনার।

বিশাল দেশ, আশি শতাংশের বেশি নিরক্ষর। ভোট নিয়ে কারও ধারণা নেই। তামাম আন্তর্জাতিক মিডিয়া ভারতের ভোট নিয়ে হাসাহাসিতে ব্যস্ত। প্রেসিডেন্সি কলেজের অঙ্কের ছাত্র সুকুমারবাবু নিঃশব্দে কয়েকটি ব্যবস্থা নিলেন। কয়েক মাস ধরে ভোট হবে, প্রথম দিকে হিমাচলের দুর্গম গ্রামে। লোকে পড়তে পারে না, তাই বিভিন্ন ব্যালট পেপারে থাকবে বিভিন্ন প্রতীক। ভোটার লিস্টে নিরক্ষর মহিলাদেরও অমুকের মা, তমুকের বউ বলে লেখা যাবে না। পুরো নাম লিখতে হবে।

Advertisement

দুনিয়ার বৃহত্তম গণতন্ত্রে সে দিন পথিকৃতের কাজ করেছিলেন বিস্মৃত এই বঙ্গতনয়। আমলার চেয়ারে বসে তাঁর সেই দেশসেবা তথা সমাজসেবার সুফল আজও আমরা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে ভোগ করে যাচ্ছি।

বন্ধনের অধিকর্তা চন্দ্রশেখর ঘোষ এবং বিজ্ঞানী শুভেন্দু গুহর হাতে সেরার সেরা পুরস্কার
তুলে দিচ্ছেন আনন্দবাজার সংস্থার প্রধান সম্পাদক অভীক সরকার। ছবি: বিশ্বনাথ বণিক।

সুকুমারবাবুর চ্যালেঞ্জ ছিল এক। আর কালো পাড়-সাদা শাড়ির চ্যালেঞ্জ ছিল আর এক।

পাঁচ দশক আগে সুকুমারবাবুকে ক্ষমতার সঙ্গে লড়তে হয়নি। কিন্তু সাদা শাড়ি? তাঁকে তো এই বাংলার মানুষ যাতে নির্দিষ্ট সময়ে ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারেন, তার জন্য ক্ষমতাবানের বিরুদ্ধে নিরুচ্চারে লড়তে হয়েছে, আদালতেও যেতে হয়েছে। রবিবার সন্ধ্যায় এবিপি আনন্দের ‘সেরা বাঙালি’ অনুষ্ঠানে বোধহয় সবচেয়ে বেশি হাততালি বরাদ্দ ছিল ওই সাদা শাড়ির জন্যই। আইটিসি সোনার-এর বলরুমে প্রাক্তন বিচারপতি চিত্ততোষ মুখোপাধ্যায়ের হাত থেকে তখন পুরস্কার নিচ্ছেন সমাজসেবায় এ বারের সেরা বাঙালি: মীরা পাণ্ডে।

সদ্যস্বাধীন সেই দেশে সুকুমারবাবুর মতোই আরও অনেক বাঙালি ছিলেন। পাঁচের দশকেই কলকাতায় বাঙালি উদ্যোগে গড়ে উঠেছিল ইউনাইটেড ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়া। তার আগে দ্বারকানাথ ঠাকুর থেকে রবীন্দ্রনাথ, অনেকেই ব্যাঙ্ক তৈরি করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথের তৈরি ব্যাঙ্ক তো পাতিসরের গ্রামে, চাষি ও প্রান্তিক মানুষদের ঋণ দেওয়ার জন্য। সারদা-অধ্যুষিত রাজ্যে সেই ইতিহাসই মনে পড়িয়ে দিলেন এ বারের সেরার সেরা। ‘বন্ধন’-এর চন্দ্রশেখর ঘোষ। অনিল অম্বানীর ‘রিলায়্যান্স ক্যাপিটাল’, কুমারমঙ্গলম আদিত্য বিড়লার ‘বিড়লা নুভো’কে হারিয়ে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক যে তাঁকেই দিয়েছে ব্যাঙ্কিং লাইসেন্স, সে এত দিনে সকলের জানা। কিন্তু সন্তোষপুরের সার্ভে পার্কের এই বাসিন্দার পরিশ্রম? ২০০২ সালে বাগনানে ছোট্ট অফিসে শুরু হয়েছিল যে ক্ষুদ্রঋণ সংস্থা, আজ ২২টি রাজ্যে তার ২১১৬টি শাখা। ৫৫ লক্ষ উপভোক্তার বেশির ভাগই গ্রামের গরিব মহিলা। কয়েক মাস আগেও বলেছেন, “আমাদের দেশে ৬০ শতাংশ লোকই ব্যাঙ্কে যেতে পারেন না। ফলে চিটফান্ড এবং নানা পনজি স্কিমে টাকা রাখতে বাধ্য হন। আমরা এঁদের কাছেই পৌঁছব।”

আলাপে ব্যস্ত
সুমন-স্বস্তিকা।—নিজস্ব চিত্র

‘সেরা বাঙালি’ অনুষ্ঠানে
মীরা পাণ্ডে। —নিজস্ব চিত্র।

এ দিন অনুষ্ঠানের প্রারম্ভে আনন্দবাজার সংস্থার প্রধান সম্পাদক অভীক সরকারও এই দু’জনের কথাই যেন তুলে ধরলেন, “আমরা খুঁজে পেয়েছি এমন এক বাঙালি রাজপুরুষ, যাঁর মেরুদণ্ড আছে। এ এক অতি আশ্চর্য ঘটনা! বাঙালি, তার আবার মেরুদণ্ড!...টাকাকড়ি লেনদেন করেন, কিন্তু চোর নন! অবাক হতে হয়, এমন বাঙালিও আছেন।” সম্ভবত অন্ধকারের পাশে আলো থাকে। আর ‘সারদা’র রাজ্যে ‘বন্ধন’!

চন্দ্রশেখরবাবুর পাশাপাশি ‘সেরার সেরা’ আরও এক জন। প্রবাসী বিজ্ঞানী শুভেন্দু গুহ। আমেরিকার ‘ইউনাইটেড সোলার ওভোনিক’ সংস্থার প্রাণপুরুষ। আগে সোলার ব্যাটারিতে হাইড্রোজেন-ঋদ্ধ সিলিকন গুঁড়ো ব্যবহার করা হত। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্র শুভেন্দুবাবুর আবিষ্কার দেখাল, এর বদলে সিলিকন গ্যালিয়াম বা ন্যানোক্রিস্টালাইন সিলিকন ব্যবহার করলে সূর্যালোকের ফোটনকে শক্তিতে রূপান্তরের মাত্রা বাড়ে। এখন আমেরিকা থেকে অস্ট্রেলিয়া বিভিন্ন দেশের বাড়িতে, রাস্তার আলোয় মায় গাড়ির ব্যাটারিতে তাঁর দেখানো পথেই সৌরশক্তির উৎপাদন। আম বাঙালি যখন রাজনৈতিক বিবাদে শক্তিক্ষয়ে ব্যস্ত, তখন এক বঙ্গসন্তানের উদ্ভাবনী নৈপুণ্যেই বাঁধা পড়ছে সৌরশক্তি। এ-ও কি নয় আর এক আশ্চর্য?

কিংবা বাঙালির উড়ান! গত মাসে ‘এয়ার এশিয়া’ এ দেশে অভ্যন্তরীণ উড়ান চালুর পরই তাদের কর্তা টোনি ফার্নান্ডেজ টুইট করেছিলেন, “ইন্ডিগো যত চেষ্টাই করুক, আমাদের দমাতে পারবে না।” যে ‘ইন্ডিগো’ বাণিজ্যের আকাশে উড়ান দিয়েছে তার বাঙালি কর্তা আদিত্য ঘোষের হাত ধরে। আগে কম খরচের উড়ান বলতে ছিল ক্যাপ্টেন গোপীনাথের ‘এয়ার ডেকান’ বা সুব্রত রায়ের ‘এয়ার সাহারা’। আইনজীবী আদিত্যর প্রথাগত ভাবে উড়ান-ব্যবসায় আসার কথাও নয়। কিন্তু ‘ইন্ডিগো’তে এসে তিনিই খেলার নিয়ম পাল্টে দেন। সহকর্মীদের বলেছিলেন, বিমান সময় মতো উড়বে, হোল্ডে জায়গা বেশি থাকবে। সস্তার টিকিট বলে অন্য সুবিধার সঙ্গে আপস নয়। আর সেখান থেকেই তাঁর নেতৃত্বে ‘ইন্ডিগো’ আজ এ দেশের বৃহত্তম বিমান সংস্থা। এয়ার এশিয়াও তাকে প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে ডরায়! রবিবারেই ছিল তাঁর জন্মদিন, ‘সেরা বাঙালি’ খেতাব যেন তারই উপহার।

দিল্লিতে বেড়ে ওঠা এই বাঙালির পাশেই ছিলেন লখনউয়ে বেড়ে ওঠা অমিতাভ ভট্টাচার্য। ‘ভাগ ডি কে বোস’ (দিল্লি বেলি), ‘বদতমিজ দিল’ (ইয়ে জওয়ানি হ্যায় দিওয়ানি) বা ‘ওফ্ হো’ (টু স্টেট্স)-এর মতো হিন্দি গানে নিয়ে এসেছেন তারুণ্যের মেজাজ এবং মুখের কথা। গুলজারের ভক্ত লোখান্ডওয়ালার কফিশপে বসে লিখেছিলেন ‘দেব ডি’-র সেই গান: ইমোসনাল অত্যাচার। বাঙালির সিনেমার গান গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার-পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়দের তথাকথিত স্বর্ণযুগে শেষ হয়ে যায়নি। সে এখন আত্মবিশ্বাসে হিন্দি সিনেমায় ঢুকে পড়ে। বাবুল সুপ্রিয় তাঁর হাতে তুলে দিলেন পুরস্কার। সৃজিত মুখোপাধ্যায় পুরস্কার তুলে দিলেন আর এক মুম্বইজয়ীর হাতে। ব্যারাকপুরের সন্তান সুজিত সরকার। ‘ভিকি ডোনর’ বা ‘ম্যাড্রাস কাফে’ ছবির পরিচালকই এ বার নির্দেশনায় ‘সেরা বাঙালি’।

মঞ্চে সব সেরা আদিত্য ঘোষ, শুভেন্দু গুহ, চন্দ্রশেখর ঘোষ, দেবশঙ্কর হালদার, সুজিত সরকার,
অমিতাভ ভট্টাচার্য, শাহিন আখতার, ঋতুপর্ণা দাস এবং মীরা পাণ্ডে। রয়েছেন প্রধান সম্পাদকও। —নিজস্ব চিত্র

সেরা বাঙালি মানে তাই অতীত-আচ্ছন্নতার উদ্ভ্রান্ত ঘুরপাক নয়, তারুণ্যকে কুর্নিশ। যে ভাবে বছরের সেরা আবিষ্কার: ব্যাডমিন্টনের অষ্টাদশী কন্যা ঋতুপর্ণা দাস। জুনিয়র পর্যায়ে জাতীয় চ্যাম্পিয়ন। অতঃপর সাইনা নেহাওয়ালরা যেখানে তৈরি হন, হলদিয়ার মেয়ে এখন সেই কারখানায়। বেঙ্গালুরুতে গোপীচন্দের স্কুলে। তাঁর হাতে পুরস্কার তুলে দিলেন দেব এবং কোয়েল। মঞ্চে সেরা এবং তারুণ্য এ ভাবে একাকার বলেই কি দর্শকাসনেও সংক্রামিত হচ্ছিল তার রেশ? নইলে কেনই বা পরস্পরকে জড়িয়ে ধরলেন বাবুল সুপ্রিয় এবং দেব নামের দুই সাংসদ? পার্টিতে স্বস্তিকা এবং সুমন মুখোপাধ্যায় যে ভাবে গল্প করছিলেন, সেখানেও কি ছিল না প্রতিবাদী মেরুদণ্ড? মাস দুয়েক আগের অনভিপ্রেত হয়রানিকে পিছনে ফেলে এ দিনই স্বস্তিকা ফের প্রকাশ্যে, সঞ্চালকের ভূমিকায়।

সাহিত্যে সেরা বাংলাদেশের নতুন প্রজন্মের লেখিকা শাহিন আখতার। তাঁর ‘তালাশ’ উপন্যাস মুক্তিযুদ্ধে ধর্ষিতা নারীর চোখে দেখা ইতিহাস। সেখানে ভাষা ও সময়ের চলন নিয়ে হরেক পরীক্ষানিরীক্ষা। এই জাতীয় উপন্যাসে মুক্তিযোদ্ধা জাতীয় চরিত্ররা প্রায় দেবতা এবং অন্যরা দানব হয়ে থাকেন। কিন্তু শাহিন এ দুয়ের মাঝে ধূসরতাটা দেখান। নায়িকা মেরিকে মুক্তিযোদ্ধা আবেদ ব্যবহার করে। আবার ভিন্ন গোষ্ঠীর রামিজ শেখ তাকে জীবনের কথা শোনায়। শাহিন তাঁর গল্পে-উপন্যাসে বারেবারেই দেখান, ক্ষমতার আসনে নারীও পুরুষের মতো আচরণ করে, লিঙ্গভেদ থাকে না। সেলিনা হোসেন, রাবেয়া খাতুনদের পরবর্তী প্রজন্মে শাহিন নতুন কথা বলার চেষ্টা করছেন বলেই তো সেরার শিরোপা তাঁর হাতে।

এবিপি আনন্দের ‘সেরা বাঙালি’ অনুষ্ঠানে ‘সেরা আবিষ্কার’ ঋতুপর্ণা দাস।
তাঁকে পুরস্কার দিলেন দেব ও কোয়েল মল্লিক। ছবি: বিশ্বনাথ বণিক।

শাহিন না-হয় বাংলাদেশের মেয়ে। কিন্তু ‘সেরার সেরা’ শুভেন্দু গুহ থেকে সুজিত সরকার, অমিতাভ ভট্টাচার্য, আদিত্য ঘোষ, মায় ঋতুপর্ণাও এখন বাংলায় থাকেন না। সেরা নয় জনের পাঁচ জনই বাংলার বাইরে। সিন্ডিকেটের দেশে এ রকমই হওয়ার কথা! কলকাতার তরুণ বাঙালির প্রতিনিধিত্ব করেছেন এক জনই। নাটকের দেবশঙ্কর হালদার। কয়েক মাস আগেও দিনে তিনটি আলাদা মঞ্চে আলাদা তিন নাটকে নেমেছেন, দেরি হয়ে যাওয়ায় রবীন্দ্রসদনের পাঁচিল টপকেও গ্রিন রুমে ঢুকেছেন।

কে না জানে, অভিনয়ের ‘সেরা বাঙালি’ নাটকের মঞ্চেই বাঁচেন! স্বজন-পরিজনদের ছাতায় নয়!

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement