বন্ধুদের সঙ্গে খেলাধুলোর অবসর তাঁর কেটেছিল ক্যামেরার সামনে। সংসারের অভাব তাঁকে বাধ্য করেছিল ছবিতে অভিনয় করতে। পরে পূর্ববঙ্গের সেই মেয়ের বাঙ্ময় চোখই জয় করল এ পারের চলচ্চিত্র মহল। সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়ের মতো সহজাত, স্বচ্ছন্দ অভিনেত্রী বিরল বাংলা ছবির জগতে।
সাবিত্রীর জন্ম ১৯৩৭ সালে, বাংলাদেশের কুমিল্লা জেলায়। তাঁর বাবা ছিলেন স্টেশনমাস্টার। ১০ বোনের মধ্যে সাবিত্রী ছিলেন সবথেকে ছোট। পরবর্তীতে ঢাকায় বাগান-সহ বাড়ি তৈরি করেছিলেন তাঁর বাবা। শৈশবের সেই স্মৃতি এখনও সজাগ তাঁর মনে।
দেশভাগের পর পরই সাবিত্রী চলে এসেছিলেন কলকাতায়। তাঁর এক বিবাহিত দিদির পরিবার কলকাতায় এসেছিল। তাঁদের সঙ্গেই ছোট্ট সাবিত্রী পা রেখেছিলেন এই শহরে। তখন তাঁর কাছে কলকাতা মানেই অপার বিস্ময়। কলকাতাতে ছিল তাঁর মেজদির শ্বশুরবাড়ি। মেজদি তাঁর ছেলের কর্মস্থল জলপাইগুড়িতে থাকলেও তাঁর পরিবারের অন্যান্যরা থাকতেন কলকাতায়। সেখানেই ঠাঁই হল সাবিত্রীর।
আশ্রয় জুটল নতুন শহরে। ভর্তি হলেন স্কুলেও। শৈশবেই সঙ্গী হল অভাব। তাঁর বাবা ঢাকা থেকে অর্থসাহায্য পাঠাতে পারছেন না। এ দিকে নতুন শহরে কুটুমবাড়িতে আশ্রিতা সাবিত্রী পড়লেন মহা বিপাকে। বাধ্য হয়ে বিভিন্ন জায়গায় নাচের অনুষ্ঠান করতেন তিনি।
সে রকম একটা সময়েই তাঁর পরিচয় ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে। অভিনেতা নিজে এসে আলাপ করেছিলেন সাবিত্রীর সঙ্গে। তখন অবশ্য সাবিত্রীর কাছে তিনি ‘ভানু’ নন, বরং সাম্যময় বন্দ্যোপাধ্যায়। সাবিত্রীর মুখে বাঙাল টানে কথা তাঁর ভাল লেগেছিল। সে সময় ‘নতুন ইহুদি’ নাটকের জন্য নতুন মুখ খুঁজছিলেন ভানু। তিনি সরাসরি সাবিত্রীর বাবার কাছে অভিনয়ের প্রস্তাব দিলেন। সে সময় সাবিত্রীর বাবা এসেছিলেন কলকাতায়।
ঘটনাচক্রে দেখা গেল, ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় আত্মীয় হন সাবিত্রীর। তাঁর মেজদি ছিলেন সম্পর্কে ভানুর মামি। ক্রমে ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ই হয়ে উঠলেন অভিনয় জগতে সাবিত্রীর অভিভাবক। তাঁর বোনের চরিত্রে ‘নতুন ইহুদি’ নাটকে কাজই ছিল সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়ের প্রথম অভিনয়। পূর্ববঙ্গের উদ্বাস্তুরাই ছিলেন নাটকের বিষয়। নাটকের সঙ্গে জড়িত ছিলেন ছিলেন অভিনেতা কানু বন্দ্যোপাধ্যায়ও। তিনি-ই সত্যজিতের ‘পথের পাঁচালী’-র ‘হরিহর’।
ক্রমে সাবিত্রীর বাবা এবং পরিবারের অন্য সদস্যরাও ঢাকা থেকে চলে এলেন কলকাতায়। টালিগঞ্জের একটি এক কামরার বাড়িতে মাথা গুঁজেছিলেন পরিবারের সব সদস্য। সংসারের হাল ধরতে সে সময় অভিনয়ের পাশাপাশি নাচের অনুষ্ঠানও করতেন সাবিত্রী। নাচের অনুষ্ঠানে অংশ নেবেন বলে পাড়ি দিতেন অন্য শহরেও। বেশির ভাগ সময়েই মহড়ায় যেতেন পড়শিদের কাছ থেকে ধার করা শাড়ি পরে। সংসারে এতই অভাব, আটপৌরে পোশাকের বাইরে ভাল শাড়িও ছিল না।
১৯৫১ সালে প্রথম ছবিতে অভিনয় করেন সাবিত্রী। অগ্রদূত পরিচালিত সেই ছবির নাম ছিল ‘সহযাত্রী’। নায়ক ছিলেন উত্তমকুমার। ছবিতে পার্শ্বনায়িকার চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন সাবিত্রী। অভিনয়ের আগেই অবশ্য দেখেছিলেন নায়ককে। তাঁকে প্রথম বার দেখার স্মৃতি এখনও মনে অমলিন।
কিছু দিন বিরতির পরে সাবিত্রী আবার অভিনয় শুরু করেছিলেন ‘নতুন ইহুদি’ নাটকে। তার মহড়ায় এক দিন গিয়েছিলেন উত্তমকুমার। তাঁকে দেখবেন বলে তাড়াহুড়ো করে যেতে গিয়ে পোশাক রাখার ভাঙা ট্রাঙ্কে হোঁচট খেয়ে পড়েছিলেন সাবিত্রী। তার ফলে পা কেটে রক্তারক্তি কাণ্ড। জখম পা নিয়ে তিনি ভুগেছিলেন অনেক দিন। তবে সব কষ্ট দূর হয়ে গিয়েছিল ধুতি পাঞ্জাবীতে সুদর্শন উত্তমকুমারকে দেখে। তখনও অবশ্য তিনি ইন্ডাস্ট্রিতে অরুণকুমার। তাঁকে প্রথম-দর্শনের স্মৃতি একাধিক সাক্ষাৎকারে রোমন্থন করেছেন সাবিত্রী।
নায়িকার ভূমিকায় তাঁকে প্রথম দেখা গিয়েছিল ১৯৫২ সালে, ‘পাশের বাড়ি’ ছবিতে। এর পর ‘শুভদা’, ‘বসু পরিবার’, ‘অন্নপূর্ণার মন্দির’, ‘গোধূলি’, ‘রাত ভোর’, ‘পুনর্মিলন’-এর মতো ছবিতে অভিনয় করে টালিগঞ্জ ইন্ডাস্ট্রিতে নিজের জায়গা মজবুত করে নেন সাবিত্রী। সকলের কাছে তিনি ছিলেন ‘সাবু’।
উত্তমকুমারই তাঁর জীবনের প্রথম প্রেম। স্বীকার করতে দ্বিধাহীন সাবিত্রী। অভিনয়ের সেরা সময়ে তাঁদের বিয়ে নিয়েও গুঞ্জন রটেছিল। কিন্তু তা রয়ে গিয়েছে গুজবের স্তরেই। সবরকম গুঞ্জনের বাইরে উত্তম-সাবিত্রী বন্ধুত্ব রয়ে গিয়েছে উজ্জ্বল।
উত্তম-সুচিত্রা, উত্তম-সুপ্রিয়ার মতো উত্তম-সাবিত্রীও ছিল সুপারহিট জুটি। ‘লাখ টাকা’, ‘কল্যাণী’, ‘অনুপমা’, ‘রাইকমল’, ‘নবজন্ম’, ‘মরুতীর্থ হিংলাজ’, ‘রাজা সাজা’, ‘দুই ভাই’, ‘ভ্রান্তিবিলাস’, ‘মোমের আলো’, ‘নিশিপদ্ম’, ‘রাতভোর’, ‘উপহার’, ‘মৌচাক’ এবং ‘ধন্যি মেয়ে’-এর মতো ছবিতে নস্টালজিয়ার আকর হয়ে আছে তাঁদের অভিনয়।
জীবন নিয়ে সাবিত্রী সবসময়েই অকপট। গৌরীদেবীর সঙ্গে সম্পর্ক ভেঙে সংসার ছেড়ে উত্তমকুমারের চলে আসা তাঁর ভাল লাগেনি। সে কথা জানিয়েওছিলেন মহানায়ককে। বলেছিলেন, কাউকে কাঁদিয়ে জীবনে সুখী হওয়া যায় না। শেষ দিকে উত্তমের জীবনের টানাপড়েন তাঁকেও কষ্ট দিত। মহানায়কের প্রতি সহমর্মিতা থেকেই গাঢ় হয়েছিল ভালবাসা।
অন্যের ঘরভাঙা তাঁকে কষ্ট দিলেও নিজে কোনও দিন সংসার পাতেননি। বাবা, মা এবং দিদিরাই ছিলেন তাঁর পরিবার। তাঁদের জন্য করে গিয়েছেন আজীবন। নিজের জন্য আলাদা সংসারের নিভৃত কোণ তৈরি করা হয়ে ওঠেনি।
আটের দশক থেকে অভিনয় করা কমিয়েই দিয়েছিলেন সাবিত্রী। পরে আবার ফিরে আসেন স্বমহিমায়। দাপটের সঙ্গে কাজ করেন পরবর্তী প্রজন্মের কুশীলব এবং পরিচালকদের সঙ্গে। মূলধারার বাণিজ্যিক ছবির পাশাপাশি তাঁর অনায়াস উপস্থিতি ‘প্রাক্তন’, ‘পদক্ষেপ’, ‘হেমলক সোসাইটি’, ‘মাটি’-র মতো ছবিতেও।
মঞ্চ, বড় পর্দা জয় করার পরে তাঁর অভিনয় থেকে বঞ্চিত হননি টেলিভিশনের দর্শকরাও। ‘সুবর্ণলতা’-য় জাঁদরেল শ্বাশুড়ি থেকে ‘জলনূপুর’-এর সোনা ঠাম্মা, সাবিত্রী বাজিমাত করেছন তাঁর সাবলীল অভিনয়ে। কুসুমদোলা’, ‘টাপুর টুপুর’, ‘চোখের তারা তুই’, ‘অন্দরমহল’-এর মতো ধারাবাহিকের সাফল্যের অন্যতম উপাদান তাঁর উপস্থিতি।
৭০ বছরেরও বেশি সময় ধরে তিনি সমৃদ্ধ করেছেন অভিনয় জগতকে। ট্রামের ভাড়া বাঁচানোর জন্য স্কুল থেকে লম্বা পথ হেঁটে বাড়ি ফেরা সে দিনের ‘বাঙাল মাইয়্যা’ আজ নিজেই একটি প্রতিষ্ঠান, স্বতন্ত্র ঘরানা। ২০১৪ সালে তিনি সম্মানিত হন পদ্মশ্রী সম্মানে।
বহু ঘটনার বিভঙ্গে জীবনটা আজও তাঁর কাছে রঙিন। ঠিক যেন সেই মিষ্টি পানের রুপোলি তবকের মতো। ছোটবেলায় যে পানের প্রতি তাঁর আকর্ষণ ছিল দুর্বার। প্রতিকূল জীবন পাড়ি দিয়েও আজও তিনি ভালবাসেন কৌতুক চরিত্রে অভিনয় করতে। চোখের জল লুকিয়ে দর্শকের মুখে হাসি ফোটাতে তাঁর ভাল লাগে। (ছবি: আর্কাইভ এবং সোশ্যাল মিডিয়া)