Maradona

Maradona: Blessed Dream: স্বপ্নের ময়নাতদন্ত

যুদ্ধ এবং সামরিক শাসন-পীড়িত আর্জেন্টিনাকে একার দক্ষতায় বিশ্বকাপ এনে দেওয়াকে গন্তব্যে পৌঁছনো বলতে যদি অসুবিধে না থাকে!

Advertisement

সন্দীপন চক্রবর্তী

কলকাতা শেষ আপডেট: ১০ নভেম্বর ২০২১ ০৭:৫৬
Share:

ফুটবল পায়ে তখন জাত চেনাতে শুরু করেছে এক বালক। ছোট ক্লাবের জুনিয়র দলে ডেকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে তাকে। সেই সময়ে সাক্ষাৎকার নিতে এসে টিভি চ্যানেল জানতে চেয়েছিল, সামনে তার স্বপ্ন কী? খুদে ‘পেলুসা’র জবাব ছিল, ‘‘আর্জেন্টিনার হয়ে খেলা। তার পরে আর্জেন্টিনার হয়ে বিশ্বকাপে খেলা।’’

Advertisement

ভিলা ফিওরিতো নামক ছোট্ট শহরে রেললাইনের ধারের বস্তি থেকে যে স্বপ্নের উড়ান শুরু, বার বার এয়ার পকেটে পড়ে, নানা দুর্যোগে গোঁত্তা খেয়েও সে উড়ান গন্তব্যে পৌঁছেছিল এক দিন। যুদ্ধ এবং সামরিক শাসন-পীড়িত আর্জেন্টিনাকে একার দক্ষতায় বিশ্বকাপ এনে দেওয়াকে গন্তব্যে পৌঁছনো বলতে যদি অসুবিধে না থাকে! স্বপ্নকে অমর করে রেখেও স্বপ্নের মালিকের ক্ষতবিক্ষত যাত্রা অবশ্য স্তব্ধ হয়ে গিয়েছে গত নভেম্বরে। তার ঠিক এক বছর পরে সেই স্বপ্নের উল্টো পিঠের গল্প নিয়ে এসেছেন আলেজ়ান্দ্রো আইমেত্তা। তাঁর ‘মারাদোনা: ব্লেস্ড ড্রিম’ ওয়েব সিরিজ়ে, যা চলছে অ্যামাজ়ন প্রাইমে।

ফিওরিতোর সেই ‘পেলুসা’ কী ভাবে হয়ে উঠেছিল দিয়েগো আর্মান্দো মারাদোনা নামক এক কিংবদন্তি, সে গল্প বলা হয়েছে অনেক বার। বিশ্ব জুড়ে অজস্র তথ্যচিত্র তৈরি হয়েছে মারাদোনাকে নিয়ে। কিন্তু আইমেত্তার গল্পটার ধরন আলাদা। দেবতার আসনে রেখে মারাদোনার আরাধনায় নামেননি তিনি। বরং, সুপারহিরোর যাবতীয় মোড়ক ছাড়িয়ে মাঠের বাইরে বেপরোয়া মারাদোনার সব রকমের কাণ্ড-কারখানাকে ক্যামেরায় কাটাছেঁড়া করেছেন। দিগ্ভ্রষ্ট এক রাজপুত্রের খেই হারানো জীবনের নির্মোহ ময়নাতদন্ত বলা যেতে পারে আইমেত্তার মারাদোনাকে। সুপারস্টারদের নিয়ে যে ধরনের বায়োপিক দেখতে এখানে আমরা অভ্যস্ত, সেই গৎ থেকে বহু যোজন দূরত্বে অবস্থান এই অসম সাহসী ওয়েব সিরিজ়ের।

Advertisement

মারাদোনা: ব্লেস্ড ড্রিম
(ওয়েব সিরিজ়)
পরিচালনা: আলেজ়ান্দ্রো আইমেত্তা
অভিনয়: হুয়ান পালোমিনো, নাজ়ারেনো কাসেরো এবং নিকোলাস গোল্ডস্মিথ
৭.৫/১০

সিজ়নের পাঁচটি এপিসোড মারাদোনার বিদ্রোহী চরিত্র, তাঁর উদ্দাম যৌন জীবন এবং নেশাতুর রাতের বারুদে ঠাসা। বিস্তর গবেষণা করে তথ্য জোগাড় করলেও পরিচালক অবশ্য এখানে ঝুঁকি এড়ানোর রাস্তাও রেখেছেন। ওয়েব সিরিজ়কে নেহাতই ‘কাহিনি’ বলে উল্লেখ করে ‘সব চরিত্র কাল্পনিক’-এর বোর্ড ঝোলানো রয়েছে। কিন্তু সেই ঢালের পিছনেও এক ফুটবল মহানায়কের অজানা অধ্যায়ে আলো ফেলার চেষ্টা স্পষ্ট পড়া যাচ্ছে। ‘কাল্পনিক’ গল্পেও প্রামাণ্যতা আনার জন্য নির্মিত দৃশ্যের সঙ্গে জায়গায় জায়গায় রিয়্যাল ফুটেজ দেখানো নিশ্চয়ই এমনি এমনি নয়!

মারাদোনাকে নিয়ে সবচেয়ে বিতর্কিত প্রশ্নটাই ধরা যাক। ছিয়াশির মেক্সিকো বিশ্বকাপে পায়ের ইন্দ্রজাল বুনে বাঙালির ঘরে ঘরে বন্দিত নায়ক হয়ে উঠেছিলেন মারাদোনা। মাদক-যোগে তাঁকে নিয়ে মহাবিতর্ক আরও দুটো বিশ্বকাপ পরের ঘটনা। মাদক চক্রের খপ্পরে পড়ে তাঁর উচ্ছন্নে যাওয়াকে, ইটালির নাপোলিতে খেলতে যাওয়ার সঙ্গে মিলিয়েই দেখা হয় সচরাচর। কিন্তু এই সিরিজ়ে বহু আগে থেকেই এই প্রশ্নটা মারাদোনার নিকটজনেরা তুলছেন— মারাদোনা কি ড্রাগ নেন? তাঁর সাঙ্গোপাঙ্গেরা অস্বীকার করছেন। উচ্চকিত কোনও ঘোষণা না করেও ওয়েব সিরিজ় কিন্তু দর্শককে বুঝিয়ে দিচ্ছে, সন্দেহ অমূলক নয়। স্পেনের বার্সেলোনা ক্লাব থেকে তাঁর যে একেবারেই অরাজকীয় বিদায়, তার নেপথ্য কাহিনিও এখানে তুলে ধরা হচ্ছে পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে।

শুধু মারাদোনার নিজের জীবনই নয়। তাঁকে জড়িয়ে আরও কিছু সিক্রেটের পর্দাও ফাঁস হয়েছে এখানে। ছিয়াশির সেই বিশ্বজয়ী আর্জেন্টিনা দলের কোচ কার্লোস বিলার্দো, যে বিশ্বকাপ শুরুর আগে গোপনে মারাদোনার কাছে পৌঁছে তাঁর সমর্থন নিয়ে নিজের জন্য কোচের আসন পাকা করেছিলেন, দেখানো হয়েছে এখানে! মারাদোনার প্রথম জীবনের বন্ধু হর্জ সিটারস্পিলার তাঁর ম্যানেজার থাকার সময়ের ঘটনা আর সেই জায়গায় গিলের্মো কপোলা আসার পরে যা ঘটেছিল, সে সব পাশাপাশি রেখে বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে মহানায়ককে অন্ধকারে টেনে নিয়ে যাওয়ার মুখ্য ভিলেনটি কে!

দিয়েগো মারাদানোর জীবনের নানা পর্ব ফুটিয়ে তোলার জন্য তাঁর চরিত্রে অভিনয় করেছেন তিন জন— হুয়ান পালোমিনো, নাজ়ারেনো কাসেরো এবং নিকোলাস গোল্ডস্মিথ। সকলেই আর্জেন্টিনার। মারাদোনা এবং আর্জেন্টিনা— উভয়ের রক্তে পরস্পরের প্রতি যে আবেগ, তার স্পন্দন বুঝে কাসেরো, পালোমিনোরা চেষ্টার ত্রুটি রাখেননি। তবে ফাঁক রয়েছে অন্যত্র। মাঠের বাইরের উদ্দাম জীবনের পাসপোর্ট মারাদোনা পেয়েছিলেন মাঠে পরিশ্রম করে, অতুলনীয় প্রতিভার ঝলকানি দেখিয়ে। মাঠের চৌহদ্দিতে সেই মারাদোনা, অজস্র পাহাড়প্রমাণ চাপ নিয়ে তাঁর যে যুদ্ধ, এই ওয়েব সিরিজ়ে সে দিকটা যেন গৌণ। অন্ধকারে নজর দিতে গিয়ে আলোটা যেন কেমন নিষ্প্রভ।

পরিচালক কি তা-ই চেয়েছিলেন?

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement