‘পেয়ারার সুবাস’ ছবির পোস্টারে জয়া আহসান এবং আহমেদ রুবেল। ছবি: সংগৃহীত।
এ এক পাষাণ পৃথিবীর রূপকথা।
‘পেয়ারার সুবাস’ ছবি হিসেবে তাই বুনে চলে এমন এক পরাবাস্তব জগতের মুহূর্তমালা, যেখানে রাজকন্যার পাশপাশি আছে দানবের হুঙ্কার। আছে ব্যাঙ্গমা-ব্যাঙ্গমীর মতো কপোত-কপোতী। তেপান্তরের মাঠ হয়ে গিয়েছে প্রবল বর্ষাবাদলে প্লাবিত আদিগন্ত জলাভুমি। জটিল সম্পর্ক আর সহজ ভালবাসা আঁকা হয়েছে একই চালচিত্রে।
এক গঞ্জের বাসিন্দা, বিপত্নীক বৃদ্ধ আয়নাল মুন্সি (তারিক আনম খান) তার অর্থবলে গ্রাম থেকে বিয়ে করে আনে এক অনাথ সুন্দরী যুবতীকে। যার নাম পেয়ারা। এই পেয়ারার ভুমিকায় অভিনয় করে মন্ত্রমুগ্ধ করেছেন জয়া আহসান।
কেমন করে বৃদ্ধ মুন্সির কদর্য লালসার শিকার হয় তার কুসুমকোমল দ্বিতীয়া স্ত্রী পেয়ারা, সমস্ত ছবি জুড়ে রয়েছে তার বিভীষিকাময় অজস্র রূপকল্প। বৈধ বিবাহজনিত ধর্ষণ যে কী নিষ্ঠুর আকার নিতে পারে, সারা পৃথিবী জুড়ে তার নজির ছড়িয়ে আছে। এই দাম্পত্য ধর্ষণ প্রসঙ্গটি ‘পেয়ারার সুবাস’ ছবিতে জন্ম দিয়েছে বীভৎস রসের। দাম্পত্যের পরতে পরতে নির্যাতন, ক্রূরতা আর দুর্গন্ধ। স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের মাধুর্য বলতে কিছু নেই। মুন্সির প্রতি পেয়ারার ক্রোধ, প্রতিহিংসা তাঁর আশ্চর্য জীবনবোধ দিয়ে ফুটিয়ে তুলেছেন জয়া।
গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
এখানে বলতেই হয়, চিত্রপরিচালক নুরুল আলম আতিকের কাহিনি-চিত্রনাট্য-পরিচালনা এতটাই নিপুণ এবং বাঙ্ময় যে, রুদ্ধশ্বাসে ছবিটি দেখতে হয়। প্রতি পদে নিষ্ঠুর জিঘাংসাময় বাস্তবের সঙ্গে বোঝাপড়া করে রক্তাক্ত হতে হয়। ছবির নাম ‘পেয়ারার সুবাস’ হলেও, আসলে খুলে যায় নানা রূপকল্পে পূতিগন্ধময় নরকের সিংহদুয়ার। সেই খোলা দরজা ছবির অনেকটা জায়গা দখল করলেও, রয়েছে করুণ রসে স্নাত একটি প্রায় নির্বাক প্রেমকাহিনি।
পেশায় কফিন বানানোর ব্যবসায়ী মুন্সির ঘরে প্রতীকী ভাবে থাকে একটি কফিন। সেই মৃতদেহ বহনকারী কফিনের দিকে তাকিয়ে ক্ষণে ক্ষণে ভীত পেয়ারাবেগমের রুক্ষ জীবনে প্রেমের হাত বাড়িয়ে দিতে আসে হাসেম নামে এক কফিন মিস্ত্রি (আহমেদ রুবেল)। যে কিনা পেয়ারাবেগমের ফেলে আসা গ্রামের মানুষ। নির্মম এই ছবিতে হাসেম এক মানবতাময়, সংবেদী নায়ক-পুরুষ। বিবর্ণ বিষণ্ণ অন্ধকারগ্রস্ত কুরূপকথায় এই কফিন মিস্ত্রি যেন তারুণ্য, সততা, আর ভালবাসার প্রতীক। অন্ধকার এক জগতের মধ্যে সে বসন্তের প্রতীক, হলুদ রঙের জামা পরে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। তার হাতে জোড়া সাদা পায়রা যেন শান্তির দূত। মুক্ত আকাশে সে শান্তির দূতকে মুক্তি দেয়। ঠিক এই ভাবেই সে মুক্তি দিতে চায় প্রায় কফিনবন্দিনী পেয়ারাকে। মুন্সি আর পেয়ারার কদর্য, দুর্গন্ধময় ঘরের দরজায় এই নায়ককে পরিচালক গড়েছেন অনেকটা রবীন্দ্রনাথের ‘রক্তকরবী’ নাটকের রঞ্জনের আদলে। নতুন মিস্ত্রি আসার পর নিয়তি কোন দিকে নিয়ে যায় মুন্সি আর পেয়ারার অভিশপ্ত জীবনকে, সেই পরিণাম এই লেখায় না-বলাই থাক।
ছবির একটি দৃশ্যে জয়া আহসান। ছবি: সংগৃহীত।
কারণ, এই ছবির গল্প বাজারচলতি আর পাঁচটা ছবির আদলে বয়ে যায় না। ‘পেয়ারার সুবাস’ ছবির রূপ, রস, ভাষা, চিত্রকল্পের ব্যবহার সিনেমার একটি ভিন্ন ধারার ইঙ্গিত দেয়। বিদেশি ছবিতে এই ধরনের চলন বা ‘ট্রিটমেন্ট’ দুর্লভ নয়। কিন্তু বাংলা ছবিতে এমন ভাষার পরাবাস্তব ছবি ক্বচিৎ নজরে আসে। তাই এ ছবি দেখতে হলে কাহিনির বাঁক-ঝোঁক যেমন দেখা দরকার, তেমনি দেখতে হয় সিনেমার অভিনব ভাষা।
ছবির দৃশ্যকল্প কখনও লিরিক কবিতার মতো তরল, কখনও বা যেন মেদহীন গদ্য। প্রথম দৃশ্যকল্পটির কথা ধরা যাক। সেখানে দেখা যায়, এক বৃদ্ধ কাছিমের অবয়ব, যে হাজার হাজার বছর ধরে পিঠের ওপর বয়ে চলেছে এক সুবিশাল পৃথিবী। সেই পৃথিবী ভরে গিয়েছে মানুষের পাপে, অহংকারে, হিংসা, লালসায়। এই সব অমানবিকতার ভার বইতে বইতে বুড়ো কাছিম ক্লান্ত, বিধ্বস্ত। এই রকম আরও অনেক রূপকল্প রয়েছে ছবি জুড়ে। যা দেখে মন ভরে যায়! প্রবল বর্ষায় বানভাসি হয়ে যাওয়া পৃথিবী, ভেসে যাচ্ছে মানুষের ঘড়বাড়ি-সংসার, জলের তোড়ে মারা যাচ্ছে অগণিত শিশু, অসহায় মানুষ। এ সবই মানুষের পাপের বিরুদ্ধে প্রকৃতির প্রতিশোধ।
মূল তিনটি চরিত্র ছাড়াও আরও অসংখ্য চরিত্র ছবিতে রয়েছে, যাদের প্রেম-অপ্রেম, কাম, ক্রোধ, মোহ, যৌনতা, মান-অভিমান ছড়িয়ে আছে ‘পেয়ারার সুবাস’ ছবির রূপসজ্জা হয়ে। মুন্সির বাড়ির পরিচারিকা সরলা বা মুন্সির মেয়ের চরিত্রে আসমার রাগ-অনুরাগ, নিরুপায় অসহায়তার অভিনয় আলাদা ভাবে নজর কাড়ে।
ছবিতে লং-শটের বদলে বেশির ভাগই ‘ক্লোজ় ট্রিটমেন্ট’ ব্যবহার করা হয়েছে, যাতে চরিত্রের গভীর মাত্রা ও ব্যঞ্জনা ধরা পড়ে। তবে একটা বিচ্যুতির কথা না বললেই নয়। কাহিনির দর্শনগত ভাবে অন্ধকার জায়গাগুলিতে ম্লান আলোর ব্যবহার বেশ মানিয়ে গেলেও, ‘পজ়িটিভ’ অংশগুলিতে রং এবং খুশির মেজাজ তৈরি করা উচিত ছিল।
সব মিলিয়ে বলা যায়, ‘পেয়ারার সুবাস’ ছবিটি দেখতে হলে এক ধরনের মানসিক প্রস্তুতি দরকার। ছকভাঙা এই ছবিটি দেখা যাচ্ছে ‘চরকি’ ওটিটি প্ল্যাটফর্মে। সময়সীমা দেড় ঘণ্টা।