‘বাবলি’ ছবির একটি দৃশ্যে আবীর চট্টোপাধ্যায় এবং শুভশ্রী গঙ্গোপাধ্যায়। ছবি: সংগৃহীত।
বুদ্ধদেব গুহ বাঙালির প্রিয় লেখকদের একজন। তাঁর সমসাময়িক লেখকেরা সবাই স্বকীয়, সকলেরই বিশেষ ধরন ছিল লেখালেখির। বিষয় বেছে নেওয়ার ক্ষেত্রে তাঁদের মধ্যে বুদ্ধদেব গুহ বেশ খানিকটা আলাদা ছিলেন। আসলে জঙ্গল এবং প্রেমের এমন অসাধারণ মেলবন্ধন আর কারও লেখায় তেমন ভাবে আজও আসেনি। বুদ্ধদেবের মতো এমন জঙ্গল-চষা, শিকার করে বেড়ানো লেখক, ‘হিরোইজ়ম’ যাঁর লেখায় মজ্জাগত, তিনি যখন প্রেমের কথা লেখেন, সে প্রেমও অবশ্যই দামাল এবং অভিচারী হয়ে ওঠে— বাংলা সাহিত্যে এমন প্রেমের উদাহরণ খুব বেশি পাওয়া যায় না। স্বাভাবিক ভাবেই বুদ্ধদেব দারুণ জনপ্রিয়। ‘বাবলি’ তাঁর জনপ্রিয় উপন্যাসগুলির অন্যতম, ‘বেস্ট সেলার’। এ হেন উপন্যাস নিয়ে আর এক ‘রোম্যান্স গুরু’, যাঁর ভাষা চলচ্চিত্রের, সেই রাজ চক্রবর্তী যখন সিনেমা বানান, তখন তা অবশ্যই স্মার্ট এবং এন্টারটেনিং একটি উপস্থাপনা হয়ে ওঠে।
রাজ ‘বাবলি’ বানিয়েছেন এমন এক জনপ্রিয় উপন্যাস নিয়ে, যার একটি নিটোল বাঁধুনি বা সুচারু কাঠামো রয়েছে। স্বভাবতই, ছবিটিরও প্রথম গুণ একটি টানটান নিটোল কাঠামো— ঝরঝরে গল্প বলা। সে ভাবে দেখতে গেলে ‘বাবলি’র প্লট একটি সহজ ত্রিকোণ প্রেমের। ‘বাবলি’র গল্প বাবলি বা শুভশ্রী গঙ্গোপাধ্যায়, নিজেই বলতে শুরু করেন আমাদের। টাইমলাইন ধরে কখনও এগিয়ে, কখনও পিছিয়ে দর্শক পৌঁছে যান একটি দারুণ মজার, বেশ বুদ্ধিমতী এবং গোলগাল, পেটুক মেয়ের জীবনের সেই মাহেন্দ্রক্ষণে, যখন প্রেম এসে প্রবল নাড়া দিয়েছে তাকে। ‘অভি’ বা আবীর চট্টোপাধ্যায়, যাকে বলে ‘পারফেক্ট হিরো’। যেমন স্মার্ট, তেমন সুপুরুষ, চৌখস, সাকসেসফুল, গান গায়, সাঁতার কাটে, জঙ্গলে জিপ চালিয়ে ঘুরে বেড়ায়— বুদ্ধদেব গুহের নিজের মতোই। সেই ছায়াতেই অবশ্য তাঁর বেশির ভাগ হিরো গড়ে উঠেছে।এই দু’জনের প্রেমের মধ্যবর্তিনী নারী ‘ঝুমা’ সৌরসেনী মৈত্র, সুন্দরী, তন্বী, শ্যামা, শিখরীদশনা দারুণ ঝকঝকে এক বিমানসেবিকা। এই তিন জনের সম্পর্কের প্রেক্ষাপটে গহীন, মেঘবিলাসী উত্তর-পূর্ব ভারতের জঙ্গল— এমন সজল, সবুজ পাহাড়িয়া অরণ্য বাবলি আর অভির ভালবাসায় ইন্ধন জোগায় তীব্র ভাবে।
ছবির একটি দৃশ্যে আবীর চট্টোপাধ্যায় ও শুভশ্রী গঙ্গোপাধ্য়ায়। ছবি সংগৃহীত।
ছবিটির দ্বিতীয় গুণ হিসাবে বলা যায়, রাজ তাঁর নিজস্ব কায়দায় বেশ কিছু ছক ভেঙেছেন বিষয়বস্তুর; এক— দুর্ধর্ষ নায়ক প্রেমে পড়ে নাদুসনুদুস, চারটি শিঙাড়া খাওয়া নায়িকার। দুই, এই নায়িকা পৃথুলা এবং পেটুক হলে কী হবে, একই সঙ্গে সে সৎ ও সাহসী সরকারি আমলা। সে পাহাড়ি রাস্তায় জিপ চালানো মেয়ে, যে চুমু খেতে লজ্জায় রাঙা হয়ে ছুটে পালায় না, প্রেমিক কাছে এলে ‘যাহ্’ বলে ঠেলে দেয় না, প্রেমের প্রথম পদক্ষেপ সে নিজেই করে, জঙ্গলের হাড়কাঁপানো ঠান্ডায় সে শরীরের উষ্ণ তাপে জড়িয়ে রাখে পুরুষ সঙ্গীটিকে, নিতান্ত প্রয়োজনেই। এককথায় বাবলি বেশ ‘বোল্ড’। মজা হল, এই ‘বোল্ড’ মেয়েই আবার হিংসেয় জ্বলেপুড়ে যায় ঝুমা আর অভির মেলামেশায়, সন্দেহে জেরবার হয়ে প্রথমে প্রবল ঝগড়া করে। তার পর ভ্যাঁ-ভ্যাঁ করে কাঁদতে বসে, তারই বান্ধবী ঝুমাকে নিয়ে চারটি বাজে কথাও বলে— ঠিক যেমন হয়ে থাকে আর কি! অর্থাৎ, বাবলি খুব বাস্তবও বটে।
আরও একটি ছক ভাঙেন রাজ, ঝুমার স্মার্টনেস, তার বেহিসেবি জীবনযাপন এবং অবশ্যই আগুনের মতো রূপ একটি ‘স্টিরিয়োটাইপ’ তৈরি করে মানুষের মনে— এ রকম মেয়েদের খুব সহজেই পুরুষতান্ত্রিক সমাজ দাগিয়ে দেয় ‘মন্দ মেয়ে’ হিসেবে। অথচ ঝুমার চরিত্রটি রাজ গড়ে তুলেছেন সেই গতানুগতিকতার বিপরীতে গিয়ে।গল্পে শেষ অবধি কী হয়, সেটা দেখার জন্য হলে যাওয়াই ভাল। তবে ভাল লাগে যখন অভি বাবলিকে পরিষ্কার বলে, “আমার ঝুমাকে ভাল লাগে, ওর মধ্যে একটা প্রাণ আছে।”
আপাত-সাধারণ এই ত্রিকোণ প্রেমকাহিনির আর একটি ছকভাঙা দিক হল, এই গল্পে কোনও অপরাধবোধের জায়গা নেই। যে কোনও ত্রিকোণ প্রেমের গল্পেই মিলেমিশে যায় ‘ঠিক-ভুল’, ন্যায়-অন্যায়ের প্রসঙ্গ। কিন্তু এই ত্রিকোণের তিন বিন্দু তাদের নিজেদের এবং পরস্পরের আকর্ষণ, প্রেম, চাওয়া-না-চাওয়ার বিষয়ে বেশ বলিষ্ঠ।
রাজের সিনেমা ‘আপাদমস্তক’ বিনোদনমূলক। তিনি তাঁর গল্প বলার ধরনে সিদ্ধহস্ত এবং বিশ্বাসী। সেই জায়গা থেকে ‘বাবলি’ ছবিটিকে কিছু বলার নেই।কিন্তু উপন্যাসটি মনে করলে, সত্যিই মিস্ করি জঙ্গলের রহস্যময়, সাঙ্কেতিক, কবিতাময় উপস্থিতি আর সেই আলো-ছায়া, কুয়াশায় জড়িয়ে থাকা সম্পর্কের সূক্ষ্ম টানাপড়েন আর গভীরতা।
ক্যামেরার কাজ সুন্দর। ঘন সবুজ খুব গোলমেলে রং, ক্যামেরায় তা সামলে ওঠা সহজ নয়। সে কাজটি দিব্য করেছেন রাজের বহু বছরের ডিওপি মানস গঙ্গোপাধ্যায়। একই সঙ্গে সাধুবাদ প্রাপ্য ডিআই অর্টিস্ট পিভি মণিকুমারের, যত্ন নিয়ে কালার কারেকশন করেছেন তিনি। অনেকগুলি গান রয়েছে এই ছবিতে। রাজের কথায়, ‘‘‘বাবলি’ একটি মিউজ়িক্যাল জঁরের ছবি।’’ আমার মতে, ‘মিউজ়িক্যাল’-এর মিউজ়িক আরও মনমাতানো হওয়া উচিত ছিল। শীর্ষসঙ্গীতটি বাদ দিলে বাকি সুর বা কথা মনে থাকে না, গুনগুন করা যায় না। অবশ্যই বলতে হবে, শব্দ-পুনর্যোজক বা সাউন্ড ডিজ়াইনার দিব্যর কথা। লোকটাক হ্রদের দৃশ্যাবলি আর শব্দের কারিকুরি মাথায় ঘুরপাক খায়, ক্রমগত। আবীর চট্টপাধ্যায় যে ভাল অভিনেতা, দুষ্টু-মিষ্টি চরিত্রে যে তিনি ভীষণ আকর্ষণীয়, সে কথা সকলেই জানেন। কিন্তু আবীরকে যে এমন আবেদনময় পুরুষ চরিত্রে দেখা যেতে পারে, সেটা রাজের উপহার।
গ্রাফিক: সনৎ সিংহ।
রইল বাকি বাবলির কথা। দ্বিতীয় বার মা হওয়ার পর শুভশ্রী অভিনয় করেছেন এই ছবিতে, তিনি এখানে সত্যিই পৃথুলা। যে তন্বী চেহারা সময় বাংলা ছবির জগৎ কাঁপিয়ে দিয়েছিল, সেই চেহারা এই ছবিতে দূরবিন দিয়েও খুঁজে পাওয়া যাবে না। তার উপর তাঁর পোশাক পরিচ্ছদ, বিশেষ কিছু দৃশ্য বাদ দিলে, বেশ আলুথালু, কিছুটা কমিক রিলিফও বটে— শুভশ্রী দারুণ ভাবে উপস্থাপন করেছেন নিজেকে। রূপটান ছাড়া, গালে ব্রণ নিয়ে বাণিজ্যিক ছবির নায়িকা অভিনয় করছেন, এ ভাবা যায় না! ইংরেজিতে যাকে বলে, ‘বডি-কনফিডেন্ট’, অর্থাৎ, চেহারা যেমনই হোক না কেন, যে কোনও আকার বা আকৃতির, শরীর নিয়ে সাবলীল এবং আত্মবিশ্বাসী হওয়া। সেই শরীরের ভাষা এবং আবেদন নিয়েই গর্বিত হওয়া। না, এই ভাবনার প্রকাশ বুদ্ধদেব গুহের ‘বাবলি’ উপন্যাসে ছিল না, রাজও তাঁর ছবিতে এই ধরনের কোনও ভাবনা তুলে ধরেননি বিশেষ ভাবে। কিন্তু শুভশ্রী একজন অভিনেতা হিসাবে এই সময়ে দাঁড়িয়ে এই ধারণার কথাও যেন তুলে ধরলেন।
এর বাইরেও রয়েছে আর একটি বিষয়। প্রেমের গল্প হলেও, বিয়ের চক্করে ঢোকেননি রাজ। হালকা করে এক বার তুলেছেন সে কথা। কিন্তু বাবলির প্রেম, ভালবাসা, মিলন নিয়ে কোনও ছুতমার্গ দেখাননি পরিচালক। বিষয়টি সহজ নয়, বিশেষত একজন আপাদমস্তক বাণিজ্য়িক চিত্রপরিচালকের পক্ষে। কারণ বেশির ভাগ সময়েই পরিচালকদের শুনতে হয়, এটা দর্শক নেবে না, ছবির ব্যবসা হবে না ইত্যাদি ইত্যাদি…। একটি মিষ্টি, মনোজ্ঞ, বিনোদনমূলক বাণিজ্যিক ছবির ক্ষেত্রে এই প্রাপ্তবয়স্ক ঝুঁকিটুকু নেওয়ার জন্য স্বাধীন প্রযোজক সংস্থা ‘রাজ চক্রবর্তী এন্টারটেনমেন্ট’কে বিশেষ নম্বর দেওয়াই যায়।