‘হামি টু’ কি ‘হামি’র মতোই জোরদার? ছবি: সংগৃহীত।
২০১৮ সালের শহরের একাধিক সত্য ঘটনা ঘিরে একটি সংবেদনশীল গল্প বলেছিল ‘হামি’। শিশুদের উপর যৌন হেনস্থার প্রেক্ষিতে স্রোতের বিরুদ্ধে গিয়ে স্কুলে সিসিটিভি ক্যামেরা বসানোর বিপক্ষে মতপ্রকাশ করা হয়েছিল এই ছবিতে। তা-ও দর্শকের মনে ধরেছিল এই গল্প। এবং বক্স অফিসে বিপুল ব্যবসা করেছিল ‘হামি’। চার বছর পর শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় এবং নন্দিতা রায় নিয়ে এসেছেন ‘হামি ২’।
প্রথমেই বলে রাখা ভাল, ‘হামি ২’ কিন্তু আগের ছবির সিক্যুয়েল নয়। এ গল্পেও লাল্টু-মিতালি আছে ঠিক-ই। কিন্তু এই ছবির গল্প আগের ছবির চেয়ে সম্পূর্ণ অন্য। চিনু আর ভেপুকে নিয়ে সংসার লাল্টু আর মিতালির। ভেপু জিনিয়াস। স্মৃতিশক্তি যেমন তুখড়, তেমনই সে অঙ্কে ভাল। মনে মনে যে কোনও কঠিন অঙ্কের সমাধান করে দিতে পারে। তাই ট্যালেন্ট হান্ট রিয়্যালিটি শোয়ে সে খুব সহজেই অংশ নিতে পারে। ছবির গল্পে রয়েছে অনেক কিছু। রিয়্যালিটি শোয়ের ভাল-খারাপ, মধ্যমিত্তের স্বপ্ন বনাম নিম্নবিত্তের টিকে থাকার তাগিদ, বাচ্চাদের বন্ধুত্ব বনাম প্রতিযোগিতা, এক ভাই জিনিয়াস হলে অন্য ভাইয়ের হীনম্মন্যতা, বাংলা মিডিয়াম স্কুল বন্ধ হয়ে যাওয়া, সরকারি চাকরি জন্য হাপিত্যেস করে অপেক্ষা করা— অনেক কিছু।
কিন্তু পরিচালকদ্বয় এ বার যেন একটু নিরাপদে ব্যাটিং করলেন। আগের ছবির গল্প অনেক বেশি সাহসী ছিল। এ ছবির চিত্রনাট্য সে ভাবে ধাক্কা দিতে পারল না। কারণ, রিয়্যালিটি শো যে বাচ্চাদের পক্ষে ক্ষতিকর, তা প্রতিযোগীদের বাবা-মা আর চ্যানেল কর্তৃপক্ষ ছাড়া মোটামুটি সকলেই মানবেন। গল্প এগিয়েছে দর্শককে কিছু পাঠ পড়ানোর উদ্দেশ্যেই। রয়েছে বেশ কিছু সাব প্লটও। কিন্তু গল্পে চিনু যেমন অবহেলিত, প্লট পয়েন্টগুলিই যেন তেমনই। এক একটি সাব প্লট যেন শুধু ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাওয়া হয়েছে। একটি প্রতিযোগিতায় দুই ফাইনালিস্টের মধ্যে এতটাই বন্ধুত্ব হল যে, তারা ঠিক করে ফেলল, ‘বন্ধুত্বে নো কম্পিটিশন’। কিন্তু এত গভীর বন্ধুত্ব কী করে তৈরি হল? পরিচালকেরা একটি গানের মাধ্যমে শর্ট কাটে সেটা দেখিয়ে দিলেন। তার বদলে কিছু সুন্দর দৃশ্য হয়তো ভাবা যেত। আরও একটু মজবুত করা দেখানো যেতে পারত এই বন্ধুত্বের ভিতটা। বেশ কিছু সাব প্লটই এ রকম সামান্য খাপছাড়া লাগতে পারে।
নেতাই জ্যাঠার চরিত্রে অঞ্জন দত্তকে আরও কিছু দৃশ্য পাওয়া গেলে ভাল লাগত। ছবি: সংগৃহীত।
তবে এ বার ছবির চরিত্ররা আগের ছবির মতো ততটা চড়া নয়। যে কোনও মুহূর্ত নাটকীয় করে তোলার জন্য চড়া অভিনয়ের চেয়েও বেশি ভরসা করা হয়েছে আবহসঙ্গীতের উপর। লাল্টুর চরিত্রে শিবপ্রসাদ এবং মিতালীর চরিত্রে গার্গী রায়চৌধুরীকে দর্শক এত দিনে ভালবেসে ফেলেছেন। ছবিতে হাস্যকৌতুকের জন্য ভরসা লাল্টুর ক্যারিকেচারিশ চরিত্রায়নই। পাশাপাশি তাঁর একটি গভীর সংবেদনশীল দিকও দেখানো হয়েছে। অভিনেতা শিবপ্রসাদ খুব সহজেই সকলের মন জিতে নিতে পারেন। মধ্যবিত্ত পরিবারের স্বপ্ন দেখা মায়ের চরিত্রে গার্গীও যেন বার বার মিলেমিশে যান। তবে বাচ্চাকে জ্বর গায়ে রিয়্যালিটি শোয়ে ঠেলে পাঠানো, না হয় লোভী মায়ের লক্ষণ। কিন্তু বাচ্চার পড়াশোনা, জন্মদিনের পার্টির ব্যবস্থা করাও কি খালি মায়েরই দায়িত্ব? সেটা ঠিক মানা গেল না। নেতাই জ্যাঠার চরিত্রে অঞ্জন দত্তকে আরও কিছু দৃশ্য পাওয়া গেলে ভাল লাগত। রিয়্যালিটি শোয়ের সঞ্চালক হিসাবেও প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায় যত ক্ষণ পর্দায় ছিলেন, তত ক্ষণ যেন প্রত্যেকটি দৃশ্যে আলাদা এক ধরনের প্রাণ পাওয়া গিয়েছিল।
তবে ছবির আসল মায়া শিশুশিল্পীদের সঙ্গে জড়িয়ে। ভেপু-চিনু-রুকসানার দৃশ্যগুলিই মনে থেকে যাবে দর্শকের। দুই ভাইয়ের মধ্যে ভাব-ভালবাসা, জিনিয়াসের ভাই হওয়ার জন্য ছোট ভাইয়ের হীনম্মন্যতা, খারাপ লাগা, হিংসা, রুকসানা-ভেপুর নির্ভেজাল বন্ধুত্ব— সবই মনে থেকে যাবে শিশুশিল্পীদের অভিনয় গুণেই। চিত্রনাট্যে আরও কিছু দৃশ্য যদি বাচ্চাদের নিয়েই থাকত, তা হলে বোধ হয় গল্প দর্শকের মন আরও গভীরে গিয়ে ছুঁয়ে যেতে পারত।
শিবপ্রসাদ-নন্দিতার ঘরানার নিয়ম মেনেই এই ছবির গল্প বলার ধরনও ছিমছিম। গল্প কোথাও অহেতুক লম্বা লাগবে না। পরিচালকদ্বয় আসলে খুব ভাল করে জানেন তাঁরা কোন ছবি থেকে কী চাইছেন। এই ছবি তাঁরা বানিয়েইছেন সপরিবারে দেখার মতো করে। তাই ছবিমুক্তির সময়ও বেছেছেন বড়দিনের আগেই। এই সপ্তাহান্তে অবশ্য আরও বেশ কয়েকটি বড় ছবি মুক্তি পেয়েছে। রয়েছে দেব-মিঠুনের ‘প্রজাপতি’ আর সন্দীপ রায়ের নতুন ফেলুদা ‘হত্যাপুরী’ও। ছবির ভিড়ে এ বারও কি শিবপ্রসাদ-নন্দিতা ছক্কা হাঁকাবেন? তা সময়ই বলবে।