একলা বাড়ি। ছড়িয়ে পড়া সংসার। একটা ঘটনা। সবার আসা, সবার ফিরে যাওয়া। মাঝখানের সময়টুকুতে, কিছু সময়ের জন্য কিছু মানুষের কাছে আসার বা দূরে সরে যাওয়ার মধ্যে, সময়ের ঘাটে ঘা দিয়ে যায় ব্যক্তিগত বা সামূহিক কিছু ঢেউ। সেই নিয়েই এই ছবি। মঞ্চ, টিভি ও চলচ্চিত্রের অভিনেত্রী সীমা পহওয়ার প্রথম পরিচালনা— ৫৮ বছর বয়সে!
আর কী ছবিই না বানিয়েছেন সীমা! পেয়েছেন দুর্দান্ত এক ঝাঁক অভিনেতা (নাসিরুদ্দিন শাহ এই ছবিতে অতিথি শিল্পী), যাঁরা নিখাদ নিভাঁজ অভিনয়ে মাত করেছেন। হাঁ করে দেখতে হয় রামপ্রসাদের বড় ছেলের চরিত্রে মনোজ পহওয়ার অভিনয়। ছোট ছেলে আর পুত্রবধূর জুটিতে পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়-কঙ্কণা সেন শর্মা বেশ ভাল। পরমের সহজাত বাঙালিয়ানাকে ছবির অবাঙালি পারিবারিকতার মধ্যেও দারুণ ব্যবহার করেছেন পরিচালক। বরং বিনয় পাঠক আর বিক্রান্ত মেসির চরিত্র দুটোর কাছে চাহিদার তুলনায় জোগান কম, আর একটু ঘন হলে জমে যেত। মায়ের চরিত্রে সুপ্রিয়া পাঠকও খুব ভাল। তবে ভাল শিল্পীর ভাল অভিনয়েও ছবি খারাপ হওয়া আটকায় না, এ ছবি ব্যতিক্রম— কারণ তার চিত্রনাট্য। বাবার মৃত্যুতে ছেলেমেয়েরা বাড়ি ফিরেছে, তেরো দিনের দিন শ্রাদ্ধ, তাদের জীবনের সম্পর্ক, অভিমান, ঝগড়া, ব্যর্থতাগুলো সব হাট করে খুলে যায় এর মধ্যে। এই ছকটা নতুন নয়, উপলক্ষের উনিশ-বিশে বিশ্বের বিভিন্ন পরিচালকের এক গুচ্ছ ছবি মনে পড়তে পারে, ঘরের কাছেই ‘উৎসব’ ছবিটাও। ছবির ব্যাকরণ-প্রকরণ জানা যে কেউ জানেন, অঁসম্বল কাস্ট সামলানো সহজ কাজ নয় আদৌ। আর ছবিটা যদি হয় নিতান্ত বাস্তববাদী আর ক্যামেরা প্রায় প্রতিটা শটেই ক্রমাগত ঘুরতে থাকে এক জন দু’জন নয়, অন্তত আট-দশ জন অভিনেতার সংলাপ আর না-সংলাপকে চোখ-মুখ-মনের খুঁটিনাটি সমেত রেকর্ড করতে, সে এক মস্ত চ্যালেঞ্জ। সুদীপ সেনগুপ্তের ক্যামেরা, বিশেষত প্রথম দিকের দীর্ঘ শটগুলো আর ছবি জুড়ে-থাকা নরম আলো সেই চ্যালেঞ্জকে মাঠের বাইরে হাঁকড়ে পরিচালকের ভাবনাকে সার্থক রূপ দিয়েছে। এবং এতটাই যে, আবহসঙ্গীত আর গানকেও বাহুল্য মনে হয়— সুন্দর হলেও।
রামপ্রসাদ কী তেরভি
পরিচালনা: সীমা পহওয়া
অভিনয়: নাসিরুদ্দিন, সুপ্রিয়া, বিনয়, মনোজ, পরমব্রত, কঙ্কণা
৭/১০
পরিচালক মাত্রেই প্রথম ছবিতে মনপ্রাণ আর যাবতীয় শিল্পকৌশল নিংড়ে দেন। সেই দেওয়ায় খামতি না থাকলেও, সব প্রথম ছবিই রসোত্তীর্ণ হয় না। ‘বোধ’ একটা অন্য ব্যাপার। অভিনয়-সংলাপ-দৃশ্যায়ন-আবহসঙ্গীতের অস্ত্রে ঠিক সময়ে শুধু চোখে আনলেই হল না, ছবি দেখতে দেখতে, এবং দেখার পরেও মগজে হাতুড়ি পেটাবে, মনে আদর বোলাবে— সেটাই বোধ। বাবার দেনা শোধ নিয়ে ছেলেদের অসহায় ব্যর্থতা, পুত্রবধূদের ঘরোয়া কানাকানি, স্ত্রীর একাকিত্ব, পরের প্রজন্মের আলগা ভালবাসা মিলেমিশে সেই অবিমিশ্র বোধটা জাগিয়ে দেয় বলেই ‘রামপ্রসাদ কী তেরভি’ একটা সার্থক প্রথম ছবি।