২০০৯ সালে মুক্তি পায় ‘অবতার’। ১৩ বছর পর ছবির সিক্যুয়েল মুক্তি পেল শুক্রবার। ছবি: সংগৃহীত।
বক্স অফিসে সবচেয়ে সফল ছবি ছিল ২০০৯ সালে মুক্তি পাওয়া ‘অবতার’। ২০১৯ সালে ‘অ্যাভেঞ্জার্স: দ্য এন্ডগেম’ সাময়িক ভাবে সে-ই সেরার শিরোপা নিয়ে নিয়েছিল বটে। কিন্তু ফের চাইনিজ ভাষায় মুক্তি পাওয়ার পর ‘অবতার’ আবার শীর্ষে উঠে আসে। স্বাভাবিক ভাবেই সেই ছবির সিক্যুয়েলের জন্য আকাশছোঁয়া প্রত্যাশা নিয়ে অপেক্ষা করছিল দর্শক। পাক্কা ১৩ বছর পর ছবির সিক্যুয়েল মুক্তি পেল শুক্রবার। এত বছর পর ‘অবতার: দ্য ওয়ে অফ ওয়াটার’ নিয়ে উত্তেজনা কতটা? শুধু ভারতেই আগাম বুকিং প্রায় ২০ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গিয়েছে লাভের সংখ্যাটা। তা হলেই বুঝে নিন। সকাল ৭.৩০টা থেকে শো দেওয়া হয়েছে বহু মাল্টিপ্লেক্সে! ২৫০০ টাকার আসনও নাকি বিক্রি হয়ে গিয়েছে। কিন্তু যে ছবি নিয়ে এত জল্পনা, সেটা কেমন হল?
এই ছবি দেখার আগে প্রথমটি অবশ্যই আরও এক বার দেখে নেওয়া প্রয়োজন। জেমস ক্যামেরুনের ‘অবতার’ যাঁরা এক বার দেখেছেন, তাঁরা কিছুতেই সেই ভিস্যুয়াল মার্ভেলন ভুলতে পারবে না। প্যান্ডোরার অদ্ভুত পৃথিবী, নাভিদের আদব-কায়দা, ঝুলন্ত পাহাড়, আত্মাবৃক্ষ বা সোল অফ ট্রি— সবই মনের ক্যানভাসে থেকে যাওয়ার কথা। তবে গল্প আরও এক বার ঝালিয়ে নেওয়া যাক। পৃথিবীর এক দল মানুষ প্যান্ডোরা নামের এক উপগ্রহ থেকে উবটোনিয়াম নামে এক বহুমূল্য খনিজ খনন করতে চায়। কিন্তু সেখানকার আদিবাসী না’ভিরা সেই জঙ্গল, সেই বৃহৎ গাছ কিছুতেই কাটতে দেবে না। তাই কিছু মানুষের আত্মাকে সেই না’ভিদের মতো অবতারে ঢুকিয়ে সেখানে বন্ধুত্ব করতে পাঠানো হচ্ছে। যাতে তারা এই উচ্ছেদের প্রক্রিয়া আরও সহজ করতে পারে। বাছাই করা হয়েছে আমেরিকার সৈন্য জেক সালিকে। যে যুদ্ধে পা হারিয়ে, যমজ ভাইকে হারিয়ে জীবনের অর্থ হারিয়ে ফেলেছে। প্যান্ডোরায় গিয়ে সে কী করে নতুন জীবন পায়, তাই ছিল আগের ছবির মূল গল্প। সেই গল্প ছিল প্যান্ডোরাকে চেনার আর জেকের নিজেকে চেনার গল্প।
কেমন হল নতুন ‘অবতার’? ছবি: সংগৃহীত।
দ্বিতীয় ছবির গল্প বরং আরও ব্যক্তিগত। জেক আর নেটিরি বিয়ে করে চার সন্তান নিয়ে সুখে সংসার করছিল। কিন্তু দুষ্টের দমন অত সহজে হয় না। তাই ‘স্কাই পিপ্ল’ বা পৃথিবীর মানুষ ফিরে আসে আবার। এ বার আবার তারা নিয়েছে না’ভিদেরই অবতার। কনোলেন মাইল্স যে আগের ছবিতে মারা গিয়েছিল, তার স্মৃতিগুলি একটি চিপের মাধ্যমে নতুন অবতারের মধ্যে ইনস্টল করে তাকে পুনর্জীবন দেওয়া হয়েছে। এ বার প্যান্ডোরা আক্রমণের লক্ষ্য শুধু খনি তৈরি নয়, রীতিমতো উপনিবেশ তৈরি। যাতে ধ্বংসের দিকে এগিয়ে চলা পৃথিবীর মানুষ নতুন এক থাকার জায়গা পায়। তবে মাইলসের লক্ষ্য একদমই ব্যক্তিগত। তার মিশন শুধুমাত্র জেক এবং তার পরিবারকে শেষ করে দেওয়া।
চিত্রনাট্যে নানা দিক রয়েছে। রয়েছে প্রচুর সাব প্লটও। বিখ্যাত বাবার প্রত্যাশা পূরণের চাপ, ভাই-বোনের মধ্যে প্রতিযোগিতা, ঐতিহ্য বনাম আধুনিকতা, প্রকৃতির সঙ্গে গভীর যোগ, জীবন-মৃত্যুর বৃত্ত— রয়েছে সবই। গল্প বলার সময়ে ন্যারেটার বার বার বদলে যায়। তাই একটু খেই হারিয়ে ফেলতে পারে দর্শক। জঙ্গল ছেড়ে প্যান্ডোরার সমুদ্র চিনবে এ বার দর্শক। জেক যেমন প্রথম বার বিস্ময়ের সঙ্গে জঙ্গল চিনেছিল, তার সন্তানরা এ বার সেই বিস্ময়ের সঙ্গেই সমুদ্রের নীচের জগৎ চিনবে। তাই চিত্রনাট্যের পরতে পরতে নস্ট্যালজিয়া জুড়ে রয়েছে।চিত্রনাট্যে নানা দিক রয়েছে। রয়েছে প্রচুর সাব প্লটও। বিখ্যাত বাবার প্রত্যাশা পূরণের চাপ, ভাই-বোনের মধ্যে প্রতিযোগিতা, ঐতিহ্য বনাম আধুনিকতা, প্রকৃতির সঙ্গে গভীর যোগ, জীবন-মৃত্যুর বৃত্ত— রয়েছে সবই।
এত বছর পর ‘অবতার: দ্য ওয়ে অফ ওয়াটার’ নিয়ে উত্তেজনা কতটা? ছবি: সংগৃহীত।
জেমস ক্যামেরুন যে সাম্প্রতিক সময়ের অন্যতম সেরা পরিচালক, তা নিয়ে কোনও সংশয় নেই। ১৩ বছর যখন তিনি সময় নিয়েছেন ছবির সিক্যুয়েল বানাতে, তখন তিনি খুব ভাল ভাবে জানেন, কী ধরনের গল্প বলতে চান। যে ধরনের মেকিংয়ে তিনি সিদ্ধহস্ত, সেগুলি আবার ব্যবহার করতে তিনি দ্বিধা করেননি। যুদ্ধের দৃশ্য যেমন ‘টার্মিনেটার টু’-এর স্মৃতি উস্কে দেবে। বা ক্লাইম্যাক্স দেখে অবশ্যই পরিচালকের এখনও পর্যন্ত সবচেয়ে জনপ্রিয় ছবি ‘টাইট্যানিক’-এর কথা মনে পড়বে।
দেখতে দারুণ মজা লাগবে, কিন্তু দর্শক চরিত্রদের সঙ্গে নিজেকে মেলাতে পারবে কি? মুখ্যচরিত্ররা ক্লাইম্যাক্সে প্রায় সলিলসমাধির পথে এগোচ্ছে, কিন্তু দর্শক ততটা আবেগপ্রবণ হবে কি? আসলে প্রায় এক যুগ কেটে গিয়েছে প্রথম ছবির পর। গোটা একটি প্রজন্ম বেড়ে উঠেছে। দর্শক নানা রকম মার্ভেলের ছবি দেখে ফেলেছে। নানা রকম কল্পবিজ্ঞান-ডিস্টোপিয়ার গল্প দেখে ফেলেছে। নারীবাদ, প্রান্তিকতা, ইনক্লুসিভিটি, এলজিবিটিকিউ-এর মতো নানা রকম ডিসকোর্স শুরু হয়েছে। সেখানে প্রকৃতি বনাম বিজ্ঞান গল্প বলতে গেলে ব্যক্তিগত গল্পের সাহায্য তো নিতেই হবে। তবে তার মধ্যেও নতুন কিছু বলাই আসল চ্যালেঞ্জ।
ছবিতে সকলের অভিনয় অনবদ্য। আগের ছবির মতো এখানেও রয়েছেন স্যাম ওয়ার্থিংটন, জোয়ি সালডানা, স্টিফেন ল্যাংরা। প্রত্যেকেই যেন পরিচালকের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে প্যান্ডোরাকে চিনেছেন এবং উপলব্ধি করে সেই মতো যথাযথ চেষ্টা করেছেন। এমনকি, তাঁরা নাকি অনেকেই ডিপ ডাইভিং পর্যন্ত শিখেছেন ছবির খাতিরে। রয়েছেন আরও একঝাঁক নতুন তারকা। তাঁদের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য অবশ্যই কেট উইন্সলেট এবং ক্লিফ কার্টিস। তাঁদের চরিত্রগুলির সঙ্গে আরও একটু বেশি পরিচয় করতে পারলে ভাল হত। তবে মনে হচ্ছে, পরের ছবিতে জানা গেলেও যেতে পারে। সুখবর একটাই যে, পরের ছবির জন্য আর এত বছর অপেক্ষা করতে হবে না। নির্মাতারা কথা দিয়েছেন তিন নম্বর ছবি আসছে ২০২৪ সালে। ভূমি আর জলের গল্প হয়ে গেল। এর পর কি তা হলে অগ্নি আর বায়ুর পালা? তা সময়ই বলবে।
অ্যানিমেশন এবং ভিস্যুয়াল এফেক্টসের দুনিয়ায় ঝড় তুলেছিল ‘অবতার’। তার পর অবশ্য অনেক এগিয়ে গিয়েছে এই দুনিয়া। তবে আপনি যতই মার্ভেলের ছবি দেখুন, যতই অত্যাধুনিক ভিস্যুয়াল এফেক্ট দেখে ফেলুন, এ ছবির দৃশ্যায়ন এবং অ্যানিমেশন অবাক করবেই। প্যান্ডোরার পৃথিবীকে যত চিনবেন, তত বিস্মিত হবেন। জলের উপরে দৃশ্যগুলি চেয়েও জলের নীচের জগৎ আরও মনে ধরবে সকলের। নানা রকম জীবজন্তু, গাছপালা, আলো-আঁধারির খেলা আগের ছবির মতোই বহু বছর মনে থেকে যাবে দর্শকের।
ছবির দৈর্ঘ্য মোট ৩ ঘণ্টা ১২ মিনিট। আজকাল এত লম্বা ছবি দেখার ধৈর্য নাকি দর্শক হারিয়ে ফেলেছেন। কিন্তু প্রথম দিনে সকাল ১০টার হাউসফুল হল দেখে মনে হল, সিনেমার ম্যাজিকটা এখনও হারিয়ে যায়নি। ভাল গল্প বলতে জানলে দর্শক ঠিক বসে দেখবে।