‘অথৈ’ ছবিতে সোহিনী সরকার এবং অর্ণ মুখোপাধ্যায়। ছবি: সংগৃহীত।
শেক্সপিয়র বা রবীন্দ্রনাথ সারা দুনিয়ায় আজও সমান প্রাসঙ্গিক। তাই দুনিয়া জুড়ে তাঁদের ধ্রুপদী নাটক বা সাহিত্য, বার বার সিনেমা বা থিয়েটারে অভিনয় করা হয় নিয়ম করে, আজও। শেক্সপিয়রের নাট্য সাম্প্রতিক ভারতীয় সিনেমায় বারে বারে ধরা দিয়েছে। সিনেমা মাধ্যম আলাদা, তাই গল্পকেও মাধ্যমকে মাথায় রেখে বদলানো হয়েছে বার বার। এ তালিকায় ‘মকবুল’ বা ‘হায়দর’-এর মতো ছবির নাম আসবে। আসবে বাংলা ছবি ‘হেমন্ত’-এর নামও। আরও নানা নাম আসতে পারে। কিন্তু কেন এই বদল? নিজেরা মৌলিক গল্প লিখেই তো পরিচালনা করা যেতে পারত? তাতে তো সমকাল আরও প্রকট হতে পারত? কেন তবে বার বার এই ক্ল্যাসিকের কাছে ফিরে যাওয়ার তাগিদ? অবশ্যই কারণ আছে তার।
সদ্য মুক্তিপ্রাপ্ত ‘অথৈ’ ছবিটির প্রসঙ্গেই কথাগুলো চলে এল। পরিচালক অর্ণ মুখোপাধ্যায়-সহ ছবির অন্যতম দুই প্রধান অভিনেতা-অভিনেত্রী অনির্বাণ ভট্টাচার্য আর সোহিনী সরকারের উত্থান মূলত থিয়েটারের মঞ্চ থেকেই। গত সাত বছর ধরে ‘অথৈ’ একটি মঞ্চসফল প্রযোজনা। এ বারে পর্দায় সেই আখ্যানকে তুলে ধরলেন তাঁরা। নানা সাক্ষাৎকারে তাঁরা জানাচ্ছেন, সমকালের সঙ্গে ভীষণ মিল থাকায় এ নাটকটিকে চলচ্চিত্রায়িত করলেন তাঁরা। সে মিল কোথায়, উত্তর ছবির ট্রেলারে ভেসে উঠছে অনির্বাণের সংলাপে, মানুষ মানুষকে ভালবাসে না। বরং ভীষণ ঘৃণা করে, না হলে ‘ট্রোল’ করত না।
ছবির একটি দৃশ্যে অনির্বাণ ভট্টাচার্য। ছবি: সংগৃহীত।
সমকালের চিহ্নকে ধরতেই ছবির গল্পকে বদলেছেন তাঁরা। যে ভাবে শেক্সপিয়রকে নিয়ে হিন্দি ভাষাতেও বার বার সমকালীন গল্পের কথা একটু আগে বলা হল। বাংলা মঞ্চেও বার বার ক্ল্যাসিককে সমকালীন করার এই ঐতিহ্য রয়েছে। তাই এ ছবির গ্রাম বা চরিত্রগুলির নাম, সবই বদলে গিয়েছে পর্দায়। কাল্পনিক ‘ল্যান্ডস্কেপ’ ব্যবহার করা হয়েছে। শেক্সপিয়রের আদলে বৈষম্য বোঝাতে ছবির মূল দ্বন্দ্বগুলিকেও কল্পদৃশ্যের আশ্রয় নিতে হয়েছে। যদি ধরে নিই, বীরভূম বা বাঁকুড়ায় এই গ্রাম, সেখানে আজ রোজ যে ধরনের জাতপাত সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছেন মানুষ, এ ছবি তাকে গুরুত্ব দেওয়ার বদলে শেক্সপিয়রের আখ্যান-আশ্রিত এক ধরনের কাল্পনিক বর্ণবৈষম্যকে বেশি গুরুত্ব দিতে চেয়েছে। অর্থাৎ সমকালে এনে ফেললেও, সমকালের বদলে ছবির প্রবণতা অনেক বেশি ক্লাসিকের প্রতিই।
অভিনেতা হিসেবে অনির্বাণ, অর্ণ, সোহিনীর রসায়ন আগেই প্রমাণিত। তাঁরা খুবই শক্তিশালী অভিনেতা। সিনেমার লেন্স থিয়েটারের মঞ্চের থেকে অনেকটাই আলাদা। তাই অনেক ‘ডিটেল’কে সুনিপুণ ভাবে বদলে ফেলেছেন তাঁরা। অনির্বাণের ক্লোজ আপের শটগুলোয় যেমন ভিডিয়ো গেম ফরম্যাট ব্যবহার করা ভাল লাগে। গ্রামের ‘ল্যান্ডস্কেপ’-এ নানা রঙের ব্যবহার বা অনুরাগ কাশ্যপের ছবির মতোই চড়া রঙের ব্যবহারগুলো বেশ। শেক্সপিয়রের মূল আখ্যানের রুমালকে ঘিরে সম্পর্কের জটিলতা এখানেও রয়েছে। যেমন বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দ্বন্দ্বগুলো প্রায় একই রকম রয়েছে। সমকালের স্মার্ট ফোনে আবার প্যালেস্টাইনে লক্ষ লক্ষ শিশু মারা যাওয়ার খবর আসার পাশেই রয়েছে আজকের মনস্তাত্ত্বিক রোগের ব্যবহারও।
গ্রাফিক: সনৎ সিংহ।
‘ওথেলো’ থেকে অথৈ। সে বিশ্বাস করতে চেয়েছিল, এ দুনিয়া ভাল। সুন্দর। মানুষ মানুষকে ভরসা করতে, ভালবাসতে পারে। সে বিশ্বাসের গোড়ায় জল দিয়েছিল স্ত্রী ডেসডিমোনা, এখানে দিয়ামনা। সে সরলা। সৎ। কিন্তু ডক্টর অনর্ঘ্য চ্যাটার্জি এসে সে বিশ্বাস ভাঙতে থাকে পর পর। গ্রামের ডাক্তার, প্রায় ভগবান হয়ে ওঠা অথৈকে নানা ভাবে ভাঙতে থাকে সে। সব অসুখের ওষুধ আছে কিন্তু সন্দেহ রোগের ওষুধ নেই, তাই সে অবিশ্বাস ক্রমে ঢুকে যেতে থাকে সম্পর্ক থেকে সম্পর্কে। জড়াতে থাকে সবাইকে। লেজ থেকেই ক্রমশ নিজেকে কামড়াতে থাকে বিষধর সাপ। তার পর কামড়াতে কামড়াতে একের পর এক লাশের শরীর পড়ে থাকে শুধু... জিতে যায় আদিম রিপু, হিংসা!
ওথেলোর সময়ের বিশ্বাস-অবিশ্বাসের এই খেলা আজ বেড়েছে বই কমেনি। মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্কে বিশ্বাস খোঁজার চেয়ে মঙ্গল গ্রহে জল খুঁজে পাওয়া সহজ। অথচ বাইরে বাইরে বেড়েছে সমাজমাধ্যমে শুভেচ্ছা ও মুখে-হাসি সেল্ফি। ভেতরে বেড়েছে শুধুই বিষ। খারাপ চাওয়া। হাতি গর্তে পড়লেই ‘ট্রোল’- ‘ট্রোল’- ‘ট্রোল’। মধ্যযুগীয় বর্বরতা। এই হিংস্রতা অনেক মুখরোচক, অনেক চকচকে, অনেক শীতল, অনেক ধূসর। এর রসায়ন খুবই জটিল, সাইকোটিক, অতি-বাস্তবতায় ভরপুর। এখানে ঘাতক নিজেই নিজের শরীরের মাংস কেটে তার সেল্ফি পোস্ট করে লাইক গোনে হেসে হেসে। এই দানবীয় চোরাগোপ্তা হিংস্রতার যুগে, তাই শেক্সপীয়রের ‘লিয়ার’, ‘ওথেলো’, ‘হ্যামলেট’রাই তো ফিরে ফিরে আসবে আবার। প্যালেস্তাইনে শিশুদের লাশের সঙ্গে যেমন হুবহু মিলে যায় গ্রিক ট্র্যাজেডির নিজের আত্মীয়ের হাতে সন্তান খুনের আখ্যান!
আর, তাই ‘অথৈ’ ভাল লাগলেও প্রশ্ন থেকেই যায়, এত ভাল অভিনয়, এত উন্নত প্রযুক্তি, এত নিপুণ চিত্রনাট্যে কেবল সম্পর্কের মারপ্যাঁচকে আরও কি গভীরে তলিয়ে ভাবা যেত না? অবশ্যই স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের অবিশ্বাস আর এই মহাজাগতিক মহাকাব্যিক প্রযুক্তিগত অবিশ্বাসের মধ্যে দূরত্ব সুদূর। কিন্তু যে হেতু শেক্সপিয়রকে আজকের সময়ে নিয়ে আসছে এ ছবি, তাই দাবি বেড়ে যায়, এ সময়ের ভ্রুণে জড়িয়ে থাকা ডিজিটাল অবিশ্বাস আর চকচকে সন্দেহকে রাং ছাড়িয়ে ঝুলিয়ে দেওয়ার। প্রত্যাশা বেড়ে যায় বলেই, ‘অথৈ’কে দেখতে দেখতে কিছুটা আরও আশা করেছিলাম। আশা রাখি, পরবর্তী সময়ে পেয়ে যাব বাকি দু’আনা।