রণবীর-আলিয়া
গল্পের একটি চরিত্র যখন কাল্পনিক হয়েও তার প্যাশন দিয়ে হয়ে ওঠে পাশের জলজ্যান্ত মানুষটির মতো, ভিতরকার আবেগ তখন গলে গিয়ে দু’ফোঁটা জল হয়ে নামতেই পারে চোখ বেয়ে। রণবীর সিংহের মুরাদ এমনই একটি চরিত্র। আপাদমস্তক এক জন আন্ডারডগ, যার ভিতরের প্যাশন দমচাপা বারুদের মতো! একটা খালি ফুলকি দরকার তাকে জাগানোর... সেখানে জ়োয়া আখতার একটা গোটা ছবি বানিয়ে ফেললেন ওই বারুদে ভর করে! তাই ‘গাল্লি বয়’ নেহাত একটা গল্প নয়। নিশ্ছিদ্র কালো হতাশার মধ্যে জ্বলে ওঠা একটা তুবড়ি।
মুরাদ মুম্বইয়ের ধারাভি বস্তির কলেজ ছাত্র। কিন্তু কবিতা আর ছন্দ তার রন্ধ্রে। বাবা (বিজয় রাজ) পেশায় ড্রাইভার, মুরাদের চেয়ে বয়সে কিঞ্চিৎ বড় এক মহিলাকে দ্বিতীয় স্ত্রী করে বাড়িতে আনে। হতদরিদ্র সংসারে বাবা তাকে খাওয়ার খোঁটা দেয়, পড়ার খোঁটা দেয়, চাকরি করে পয়সা আনার জন্য জোর করে, গায়ে হাত তোলে। এ সবের মাঝে মুরাদের প্রশ্ন, ‘কিঁউ ইয়ে লগতা হ্যায় ইয়ে বস্তি এক অন্ধা কুয়াঁ হ্যায়?’ যে প্রশ্নের কোনও উত্তর হয় না... মুরাদও জানে।
যে কোনও পরিস্থিতিতে মুরাদের ভিতরকার প্যাশন তাকে দিয়ে তৈরি করিয়ে নেয় শব্দ-সুর-কল্প। পরিস্থিতিগুলো ভারী সুন্দর করে চিত্রনাট্যে বুনেছেন রীমা কাগতি। মুরাদ বাবার চাপে পড়ে কোটিপতির বাড়িতে ড্রাইভারের চাকরি নেয়। একটি দৃশ্যে মালিক তাকে জিজ্ঞেস করে, সে কতটা পড়াশোনা করেছে। মুরাদ বলে, সে গ্র্যাজুয়েশনের ফাইনাল ইয়ারে। মালিক মুরাদকে দেখিয়ে তার মেয়েকে বলে, ‘দ্যাখো, এখন সবাই গ্র্যাজুয়েট। তুমিও ড্রাইভারের সমান হতে চাও?’ খুব চট করে শ্রেণিগত ফারাক তৈরি হয়ে যায় ওই দৃশ্যে। এ রকম দৃশ্য অবশ্য ছবিতে একাধিক। অন্য সিকোয়েন্সে আবার মালিকের সেই মেয়েকেই গাড়ির ব্যাকসিটে কান্নারত অবস্থায় বাড়ি পৌঁছে দেওয়ার সময়ে, তার যন্ত্রণার কথা জানতে চেয়েও জিজ্ঞেস করতে পারে না মুরাদ। ওই ফারাকের সুবাদেই... প্রশ্নের বদলে তখন কবিতা তৈরি হয় মুরাদের মনে-মাথায়। গাড়ির চাকার ঘূর্ণির সঙ্গেই শুরু হয় তার র্যাপ-জার্নি।
গাল্লি বয় পরিচালনা: জ়োয়া আখতার অভিনয়: রণবীর সিংহ, আলিয়া ভট্ট, বিজয় রাজ, সিদ্ধান্ত চতুর্বেদী, কাল্কি কেকলাঁ ৭/১০
দারিদ্র্য-হতাশার সঙ্গে মুরাদ লড়ে র্যাপকে অস্ত্র করে। ছবিতে বিভিন্ন শিল্পীর গান ব্যবহার হয়েছে। এবং তার এমনই ক্যারিশমা, র্যাপ সম্পর্কে বিন্দুবিসর্গ না জানা লোকেরও র্যাপ-প্রীতি তৈরি হয়ে যেতে পারে! তার সঙ্গে যোগ হয়েছে রণবীরের এনার্জি। কিছু জায়গায় আবার সেই এনার্জিকে নিয়ন্ত্রণও করেছেন তিনি, মুরাদের বিষণ্ণতার দাবিতে।
তবে এ ছবি যতটা মুরাদের, ততটা সফিনারও (আলিয়া)। পজ়েসিভ প্রেমিকা, যে প্রেমিকের জন্য অন্য মেয়ের মাথায় কাচের বোতলও ভাঙতে পারে— এমন চরিত্রকে কোনও অভিনেত্রী ভালবাসার যোগ্য করে তুলতে জানলে তিনি আলিয়াই। ছবিতে তিনি মেডিক্যালের ছাত্রী। তাঁর চরিত্রের উপস্থিতি যদিও কমই। কিন্তু যতটুকু তিনি আছেন, আপনি চোখ সরাতে পারবেন না! রণবীরের সঙ্গে আলিয়ার প্রেমের সমীকরণেও কোনও ফাঁকফোকর নেই। এতটাই সাবলীল তাঁরা। তুলনায় কাল্কি কেকলাঁর চরিত্রটিকে তেমন যত্ন করে বানানো হয়নি। রণবীরকে যোগ্য সঙ্গত করেছেন সিদ্ধান্ত চতুর্বেদী। বিজয় রাজও বদমেজাজি বাবার চরিত্রে যথাযথ।
কিন্তু র্যাপের মতো একটা জঁর নিয়ে কাজ করলেও ছবিতে ব্যক্তিগত অ্যাংস্টই বেশি। জ়োয়া সযত্নে এড়িয়ে গিয়েছেন সামাজিক-রাজনৈতিক বঞ্চনা প্রসঙ্গ। এক সময়ের জেহাদি স্লোগান ‘আজ়াদি’ গানটিকেও ব্যবহার করা হয়েছে এমন দৃশ্যে, যার সঙ্গে গানের কোনও যোগ নেই! বিতর্কের আঁচ বাঁচানোর এত মরিয়া চেষ্টা কেন!
কিছু জায়গা প্রেডিক্টেবলও। জ়োয়ার বিভিন্ন ছবিতে আগেও দেখা গিয়েছে যে, তিনি ধনী চরিত্রদের বেশ খানিক নিরেট করে বানান। এখানেও মোড়কটা এক। তবে চরিত্রনির্মাণ সপ্রতিভ হওয়ায় তেমন ক্লিশে মনে হয়নি। ঠিক যেমন আন্ডারডগদের বাজি জিতে বেরিয়ে যাওয়ার গল্প ‘জো জিতা ওয়হি সিকন্দর’-এর সময় থেকে বহু বার দেখে এলেও ‘গাল্লি বয়’কে পুরনো মনে হয় না... কারণ ওই, প্যাশন কখনও পুরনো হয় না! এবং ‘গাল্লি বয়’ বেশ কিছু মানুষের প্যাশনের বারুদে একটু হলেও ফুলকি জোগাতে পারে।