সে দিন হাসতে হাসতে কথাটা বলছিলেন মীর।
এটাই নাকি টালিগঞ্জের সবচেয়ে ‘পুরাতন’ জোক।
কী সেটা?
রসিকতাটা এ রকম, টালিগঞ্জ ইন্ডাস্ট্রিতে নাকি কান পাতলে শোনা যায় এখনকার প্রায় প্রত্যেক অভিনেতা-অভিনেত্রীর প্রথম ছবি নাকি তাঁর সঙ্গে।
কিন্তু রসিকতা যে এখানেই থেমে থাকে না।
তাঁদের বক্তব্য কানন দেবীর প্রথম ছবিতেও নাকি অভিনয় করেছিলেন ৪৭ বছর বয়সী এই অভিনেতা।
রজতাভ দত্ত। ইন্ডাস্ট্রির ‘রনি’।
বহু বছর বাণিজ্যিক ছবিতে নানা রকম চরিত্র করার পর ‘ওপেন টি বায়োস্কোপ’য়ের মতো নিউ এজ ছবিতেও লাইমলাইট এখন তাঁর উপর।
ক’দিন আগে বন্ধুবান্ধবদের নিয়ে আর এক বার ‘ওপেন টি বায়োস্কোপ’ দেখতে গিয়েছিলেন। বাড়ির কাছেই সল্ট লেক সিটি সেন্টারে। ভেবেছিলেন কেউ টের পাবে না। ‘‘শো শেষ হলে সবার পরে হল থেকে বের হই। সে দিন বেরিয়ে চমকে গেলাম। ওই শীতের রাতে সওয়া দশটার সময় রাস্তায় অপেক্ষা করছেন অসংখ্য মানুষ যাঁরা তক্ষুনি ছবিটা দেখেছেন। অপেক্ষা করছেন শুধু আমাকে কনগ্র্যাচুলেট করবে বলে। আবেগে গলা আটকে গেল। পাতি ‘থ্যাঙ্ক ইউ’য়ের বেশি কিছু বলতে পারিনি সে দিন,’’ সল্ট লেকের বাড়িতে বসে যখন এই কথাগুলো বলছিলেন রজতাভ দত্ত, তখন আবেগ ঝরে পড়ল তাঁর গলায়।
কেরিয়ারের ফার্স্ট ইনিংস প্যারালাল সিনেমা দিয়ে শুরু করলেও, শেষ দশ বছর কিন্তু তিনি ইন্ডাস্ট্রির নম্বর ওয়ান ভিলেন। আর ছবির স্ট্রাইক রেটও তেমনই। তুলনায় আসতে পারেন আফ্রিদি বা সহবাগ। সতেরো বছরে ১৪৭টা ছবি, ৬০টা টেলিফিল্ম, অগণিত মেগাসিরিয়াল আর পঁচিশেরও বেশি নাটক।
তবে এই স্বপ্নের উড়ান মোটেই ঝাঁকুনিহীন ছিল না। পনেরো বছর বয়সে পিতৃহারা। শুধু দাদার উপার্জন আর মায়ের সামান্য হাতখরচের টাকায় দিনযাপন। কাজ করা শুরু করেছিলেন এক মার্কেন্টাইল ফার্মে। কিন্তু অভিনয় করে জীবনধারণ করবেন বলে হুট করে একদিন ছেড়েও দিলেন সে চাকরি। ব্যাঙ্কে তখন জমানো মাত্র বারো হাজার টাকা। ‘‘সেই টাকা দিয়ে আমার সাত বছর চলেছিল। আর চলা! দেরিতে ঘুম থেকে উঠতাম যাতে জলখাবারের পয়সাটা বেঁচে যায়। একের পর এক কাজ করে গিয়েছি। মাসে আড়াইটে ছবি করা অভ্যেস করেছি। একটা কথাই মাথায় ছিল, যে অভাব অনটনের মধ্যে দিয়ে আমি গিয়েছি, সেটা যেন আমার বৌ মেয়েকে না দেখতে হয়,’’ ফিশফ্রাইয়ে একটা কামড় দিয়ে বলেন রজতাভ।
স্ট্রাগল তো চলতেই থাকে। শুধু তার চেহারা বদলে যায়। না হলে, হঠাৎ একদিন এমন একটা রোল কেন আসবে যার পূর্ববর্তী কোনও অভিজ্ঞতাই নেই তাঁর! হাসতে হাসতে বলছিলেন, ‘‘ছোটবেলা থেকে পায়ের চোটের জন্য ফুটবল তো খেলিইনি কোনও দিন। আর ‘ওপেন টি...’তে আমাকে দিয়েছে ফুটবল কোচের রোল! যত দূর মনে পড়ে একবার নেহরু কাপ দেখেছিলাম। ফুটবলের সঙ্গে আমার সম্পর্কর ওখানেই ফুলস্টপ। সুজিত (সরকার) আর অনিন্দ্য (চট্টোপাধ্যায়) না থাকলে হয়তো হতও না। সুজিত ফুটবল-পাগল। কলকাতা এলে তো সাইয়ের মাঠে ফুটবল না খেলে ব্রেকফাস্টটা পর্যন্ত করে না।’’
শ্যুটিংয়ের আগে প্রযোজক সুজিত সরকার তাঁকে কতগুলো কোচসুলভ মুভমেন্ট দেখিয়ে দিয়েছিলেন। সেই শরীরী ভাষা প্রয়োগ করেই ধীরে ধীরে তৈরি হয়েছিল কোচ গোপেশ্বরের চরিত্রটা। রজতাভর উদ্দেশ্য ছিল একটাই। যাতে হাঁটা চলা আর একটা ড্রিবল দিয়েই বোঝানো যায় লোকটা অনেক দিন ফুটবলের সঙ্গে যুক্ত।
এই ভাবেই সেরা অভিনয়-পারফর্ম্যান্স দিয়ে বার বার নিজেকে প্রমাণ করেছেন রজতাভ। তা সে ‘এক আকাশের নীচে’ মেগা সিরিয়াল হোক বা ‘আশ্চর্য প্রদীপ’য়ের জিনের চরিত্র— সর্বত্র তিনি সব্যসাচী। সত্যি এটাই যে, খুব কম শিল্পীই আছেন বাংলা ইন্ডাস্ট্রিতে যিনি রজতাভ দত্তের সঙ্গে অভিনয় করেননি। কিন্তু রজতাভ দত্তের প্রথম ছবি কী, সেটা কি কেউ মনে রাখেন? হয়তো রাখেন, হয়তো বা রাখেন না। যেমন, বলিউডি ছবি ‘কামিনে’ বা ‘এক থা ডায়েন’য়ে তাঁর অভিনয় করার কথা উইকিপেডিয়া সার্চ করলে পাওয়া যায়। কিন্তু রণবীর কপূরের সঙ্গে এই যে ‘জগ্গা জাসুস’য়েও অভিনয় করে এলেন, সে খবর ক’জন জানেন? নিজের ঢাক নিজে পেটানোর এই ইন্ডাস্ট্রিতে কেন এই ব্যতিক্রম?
প্রশ্নটা যে উঠবে সেটা তিনিও জানতেন। তাই সটান জবাব দিলেন, ‘‘আমি আসলে খুব ভিতু। এবং পিআর করা বলতে যা বোঝায় তা করতে পারি না। জানি প্রযোজক-পরিচালকদের চোখের সামনে থাকাটা রোল পাওয়ার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। তবে আমার মনে হয় চিত্রনাট্যে যদি আমাকে দরকার মনে হয়, তা হলে নিশ্চয়ই আমি ফোনটা পাব।’’ নিজেই বলছিলেন প্রত্যেকটা ছবির প্রত্যেকটা শট যত বারই টেক করা হোক না কেন, তিনি সমান ভাবে নার্ভাস থাকেন। ‘পারমিতার একদিন’ ছবিতে অভিনয় করার সময় অপর্ণা সেন তাঁকে বলেছিলেন, ‘‘তুই প্রতিটা শটই এমন টেনসড ভাবে দিস যেন মনে হয় সামান্য ত্রুটিবিচ্যুতি হলে তোকে ইন্ডাস্ট্রি থেকে বের করে দেওয়া হবে। আর একটু রিল্যাক্সড ভাবে শট দিলে অভিনয়টা ভাল হবে।’’
কিন্তু রিল্যাক্সড হওয়া বললেই কি আর তা সম্ভব! জীবনের প্রথম বাণিজ্যিক বাংলা ছবি ‘বারুদ’য়ে তাঁর বিপরীতে যে স্বয়ং মিঠুন চক্রবর্তী। আর প্রথম শটেই ভিলেন রজতাভকে তড়পাতে হবে হিরো মিঠুনকে। যাঁর ‘ডিস্কো ডান্সার’ দেখতে গিয়ে জামা খুলে মাথার উপর ঘুরিয়েছিলেন, সেই মিঠুন চক্রবর্তীকে ধমকানো! ‘‘আমি তো ভয়ে ভয়ে মিঠুনদাকে গিয়ে বললাম, ‘স্যর, ডায়লগ বলার সময় আপনার মুখের সামনে একটা তুড়ি মারতে পারি?’ মিঠুনদা বলেছিলেন, ‘একটা তুড়ি কেন মারবি বে? দুটো মারবি। তোকে আমার লেভেলে না তুললে, লাস্ট সিনে তোকে মেরে আমি হিরো হব কী করে?’ কমার্শিয়াল ছবিতে অভিনয়ের গাঁটটা সে দিনই খুলে গিয়েছিল।’’ লোকে যতই বাণিজ্যিক ছবির অভিনয় ‘লাউড’, ‘রংচড়া’ বলুক না কেন, তিনি মনে করেন সেখানে যে রূপকথার গল্প বলা হয়, তাতেও অভিনয়ের দক্ষতা দরকার। একসঙ্গে বহু লোককে হাসানো, কাঁদানো, ভয় পাওয়ানো— এই সব করতে গেলেও কিন্তু মানুষের মনস্তত্ত্ব জানা দরকার।
রজতাভ ‘গোপেশ্বর’ দত্ত। ছবি: বিপ্লব সান্যাল।
আর সেটা রজতাভ শিখেছেন অনেকটাই থিয়েটার থেকে। বলছেন, ‘‘আমি মনে করি থিয়েটারটা মন দিয়ে করে গেলে যে কোনও শিল্পীই একদিন নজরে পড়ে যাবে।’’ থিয়েটার তাঁকে অনেক দিয়েছে। ‘যদুবংশ’ নাটক দেখে তাঁকে তপন সিংহ ‘হুইলচেয়ার’য়ের জন্য নিয়েছেন। ‘প্রথম পার্থ’ নাটক দেখে ‘আজব গাঁয়ের আজব কথা’র জন্য বেছেছিলেন। আবার সোহাগ সেন পরিচালিত ‘পাপ’ নাটক দেখে ‘পারমিতার একদিন’য়ের জন্য নিয়েছিলেন অপর্ণা সেন। তাই নিজের ব্যস্ত রুটিনের মধ্যেও নাটকের জন্য সময় বার করে নিয়েছেন বরাবর। এই বছরও তিন-তিনটে নাটকে অভিনয় করছেন রজতাভ। তাঁর মতে অভিনয়ের জন্য যখন যা শেখার সুযোগ আসবে, তাই শিখে নিতে হবে। তা সে ঘোড়ায় চড়া হোক কী বন্দুক চালানো, টেনিস খেলা হোক বা পুকুরে জাল ফেলা।
তবে থিয়েটারের প্রতি যতই ভালবাসা থাক, রজতাভ অকপটে স্বীকার করেন, পয়সা তাঁকে সিনেমাই জুগিয়েছে। তাই ‘ওপেন টি...’ যে ভাবে ব্যবসা করছে, তাতে তিনি উচ্ছ্বসিত। বিশেষ করে বক্স অফিস যে ভাবে তার আগে তিন-তিনটে গোয়েন্দা ছবি মাতিয়ে এসেছে। কিন্তু নিজে যে কোনও গোয়েন্দা চরিত্র করতে পারলেন না, তা নিয়ে কোনও মনখারাপ নেই?
বিশেষ করে বন্ধু শাশ্বত যখন শবর দাশগুপ্তর ভূমিকায় অভিনয় করেছেন? ‘‘না, একেবারে কোনও মনখারাপ নেই। আরে আমি জুনিয়র আর্টিস্ট হিসেবে ইন্ডাস্ট্রিতে ঢুকেছিলাম। আমার নাকি ‘হরর শো’তে যাওয়া উচিত! এক পরিচালক বলেছিলেন, সিনেমায় অভিনয় করতে হলে অত বড় হাঁ করে যেন কথা না বলি। শুনেছি আমাকে নাকি ‘ব্যাঙ’য়ের মতো দেখতে,’’ প্রাণ খোলা হাসি হাসতে হাসতে বলছিলেন রজতাভ। যাঁরা তাঁকে ‘ব্যাঙ’য়ের মতো দেখতে বলেছিলেন, ‘ওপেন টি...’র বিগ ব্যাং দেখে কী বলছেন তা না হয় নাই বা জানা গেল।
‘ওপেন টি বায়োস্কোপ’য়ের সময়ই রিলিজ করেছিল ‘লড়াই’। সেখানে আর এক ফুটবল কোচের ভূমিকায় অভিনয় করেছেন প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়। রিলিজের আগে ভেবেছিলেন প্রসেনজিতের সঙ্গে তাঁর তুলনা হতে পারে? ‘‘বুম্বাদার সঙ্গে আমার কোনও কম্পিটিশনের প্রশ্নই ওঠে না। উনি দীর্ঘ পঁচিশ বছর ধরে ইন্ডাস্ট্রিতে রাজত্ব করছেন। আমার সিনেমার সাফল্য-ব্যর্থতা তো আর একা আমার নয়। সে দিক থেকে বুম্বাদার চাপটা চিন্তা করুন। আমি কখনও ভাবিনি গোপেশ্বর আর সেবেস্টিয়ান রায়ানের কেউ তুলনা করতে পারে,’’ উত্তরে বললেন রজতাভ। অন্য কেউ তুলনা করল কি না সেটা নিয়ে একেবারেই ভাবতে চান না রজতাভ। ‘‘পরিচালক একশ শতাংশ চাইলে, একশ কুড়ি দিতে হবে। না হলে আমাকে পরের বার ডাকবে কেন!’’ বলেন রজতাভ। এ বছরই তাঁর অভিনীত সাতটা ছবি মুক্তি পাবে। তার মধ্যে রয়েছে ‘নাটকের মতো’, ‘কলকাতার কিং কং’, ‘ষড়রিপু’, ‘সাহেব বিবি জোকার’, ‘বিনয় বাদল দীনেশ’য়ের মতো ছবি।
বাণিজ্যিক মশলা ছবি আর নিউ এজ ছবির তফাতটা ঠিক কেমন ইন্ডাস্ট্রির রনির কাছে? প্রশ্নের উত্তরে তিনি বললেন, ‘‘আমার কাছে এ দুয়ের তফাত ফুটবল খেলা আর দাবা খেলার মতো। দুটোতেই মস্তিষ্ক লাগে, শরীর লাগে। কিন্তু একটায় মগজটা চোখে পড়ে, অন্যটায় শরীর।’’ এই ভাবে দু’ধারার ছবিতে অভিনয়ের ডাক যেমন পেয়েছেন, তেমনই কিন্তু ডাক এসেছে নানা রাজনৈতিক দলের থেকেও। তবু কোনও ডাকেই সাড়া দেননি রজতাভ। কোনও দলে নাম না থাকার কারণটা কী? ‘‘দেখুন, আমাকে ডাকছে তো আমি অভিনয় করি বলে। খানিকটা হলেও পাবলিক ফিগার। কিন্তু যেটা আমার প্রধান কাজ নয় তাতে আমি যাব কেন? ওখানে তো আমার থেকে অনেক যোগ্য লোক আছেন। তাঁরাই থাকুন,’’ স্পষ্ট উত্তর তাঁর।
শুধু রাজনীতি নয়, পার্টিতে তিনি যান না। তথাকথিত পিআর করার ছকেও বিশ্বাসী নন। তাই পেজ থ্রিতেও বিশেষ দেখা যায় না তাঁকে। শ্যুটিংয়ের পরের বেশির ভাগ সময়টাই কাটে সল্ট লেকের বিএ ব্লকের বাড়ির তিন তলায়। সেটাই এখন তাঁর স্টাডি। এক দিকে দেওয়াল ঠাসা বই। তাতে ফেলুদা থেকে মার্ভেল কমিক্স, কোয়েলহো থেকে ম্যাড ম্যাগাজিন— কী নেই!
এক সময় দক্ষিণীতে গান শিখলেও, এখন আর রেওয়াজ করেন না। কারণ সেই এক: একশো ভাগ দিতে না পারলে, তাতে তাঁর সায় নেই। সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে বলছিলেন, ‘‘সব সময় মনে হয়েছে জীবন আমায় দু’হাত ভরে দিয়েছে। চেয়েছিলাম অভিনয় করে জীবনধারণ করব। তাও পেরেছি। এখন পুরনো দিনের কথা ভাবলে মজাই লাগে। সংগ্রাম আমাকে সমৃদ্ধই করেছে। আর সংগ্রামটাকে তো সেই সময় সংগ্রাম বলে মনেই হয়নি।’’
বাংলা কমার্শিয়াল ছবির এক নম্বর ভিলেন নন। বছরে সাতটা ছবি রিলিজ করা তারকা নন। সাফল্য-ব্যর্থতার সব হিসাব পেরিয়ে রজতাভ দত্ত সেই মানুষ, যাঁকে ফোনে ‘কেমন আছেন’ জিজ্ঞেস করলে অবধারিতভাবে উত্তর আসে একটাই— ‘আমি তো সব সময় ভালই থাকি’।