প্রথমে অনেকেই ভেবেছিলেন ‘এপ্রিল ফুল’ করছে কেউ। আবার, কেউ বা ভেবেছিলেন, অন্য কোনও প্রত্যুষার কথা বলা হচ্ছে। তাই জামশেদপুরের সোনারি এলাকা প্রথম যখন প্রত্যুষা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মৃত্যুর খবর শোনে, তখন বিশ্বাসই করতে পারেনি যে, তাঁদের আদরের ‘তিতান’ এ ভাবে চলে যাবে। কারণ, প্রত্যুষাকে ‘তিতান’ নামেই চেনে জামশেদপুরের সোনারি এলাকা। এখানেই যে বড় হয়েছেন প্রত্যুষা।
প্রত্যুষার ছোটবেলার বন্ধু থেকে পাড়ার কাকা, দাদারা শুধুই বলছেন, ‘‘এত উচ্ছল, মিশুকে মেয়েটার মনে কী এমন ঝড় বইছিল যে কারও সঙ্গেই তা ভাগ করে নিল না।’’
আর সোনারি এলাকার চেনা তিতানের রহস্যজনক মৃত্যুতে উঠছে নানা রকম প্রশ্নও। প্রাথমিক ভাবে মনে করা হচ্ছে, আত্মহত্যাই করেছেন প্রত্যুষা। আর সম্পর্কের টানাপড়েনই তাঁর অস্বাভাবিক মৃত্যুর কারণ।
প্রযোজক বিকাশ গুপ্ত বলেন, ‘‘আগে প্রত্যুষার সঙ্গে দেখা হতো। ইদানীং প্রত্যুষার ব্যক্তিগত জীবনে সমস্যা হচ্ছিল। তার জন্য আমাদের থেকেও দূরত্ব বাড়িয়েছিল ও। তাই ঠিক কী হয়েছিল, বলতে পারব না।’’
কেউ কেউ আবার খুনের আশঙ্কাও উড়িয়ে দিচ্ছেন না। প্রত্যুষার ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও অভিনেত্রী কাম্য পঞ্জাবি সংবাদমাধ্যমকে জানান, প্রত্যুষার নাক ও চোখের তলায় ক্ষতের চিহ্ন রয়েছে। এমনকী, প্রমাণ হিসেবে সেই ছবিও দেখিয়েছেন তিনি। প্রায় একই অভিযোগ তুলেছেন অভিনেতা এজাজ খানও।
প্রত্যুষার রহস্যজনক মৃত্যুতে প্রেমিক রাহুল রাজ সিংহকে আজ জিজ্ঞাসাবাদ করেছে পুলিশ। যদিও এখনও তাঁকে আটক করা হয়নি।
পুলিশের এক কর্তা জানিয়েছেন, রাহুলকে ডেকে পাঠিয়ে তাঁর বয়ান নেওয়া হচ্ছে। পাশাপাশি, দু’জনের মধ্যে কী এসএমএস চালাচালি হয়েছে, তা-ও খতিয়ে দেখা হবে। আর শেষ বার তাঁদের মধ্যে কী কথাবার্তা হয়েছে, তার জন্য প্রত্যুষার ফোনের কল ডিটেলসও খতিয়ে দেখবে পুলিশ।
পুলিশ আরও জানিয়েছে, হাসপাতাল থেকে পাওয়া প্রাথমিক রিপোর্টে জানা গিয়েছে, শ্বাসরুদ্ধ হয়েই মৃত্যু হয়েছে প্রত্যুষার। ভিসেরা পরীক্ষার জন্য অপেক্ষা করা হচ্ছে।
মেয়ের অস্বাভাবিক মৃত্যুতে ভেঙে পড়েছেন প্রত্যুষার মা। এখন তিনি একটাই কথা বলে চলেছেন, ‘‘আমি জানি না, কেন ও এমন করল।’’
আজ সন্ধেয় মুম্বইয়েই প্রত্যুষার অন্ত্যেষ্টি হয়েছে। ছিলেন বলিউড ও টেলিদুনিয়ার অভিনেতা-অভিনেত্রীরা।
আর যে পাড়া প্রত্যুষাকে ‘তিতান’ থেকে ‘আনন্দী’ হতে দেখেছে, সেখানকার বাসিন্দারা হাতড়ে বেড়াচ্ছেন প্রত্যুষার ছোটবেলার স্মৃতি।
জামশেদপুরে প্রত্যুষার পরিচিতরা জানাচ্ছেন, ছোট থেকেই তার যে অভিনয়ের দিকে খুব ঝোঁক ছিল, তা নয়। রোড শোয়ে নাটক করত। স্কুলের নাটকেও অভিনয় করেছে। হাসিখুশি ও মিশুকে স্বভাবের জন্য সবার প্রিয় ছিল। প্রত্যুষার মা, বাবাও ওর কোনও কাজে বাধা দিত না।
জামশেদপুরের টেগোর সোসাইটির শিক্ষক বাণীবাবুর কথায়, “ও টেগোর সোসাইটিতে সেভেন পর্যন্ত পড়েছিল। টিফিনে ওর সঙ্গে দেখা হতো। কত আবদার করত! এই সে দিনও করেছে।’’ তাঁর কথায়, ‘‘বলতাম, তুই এখন সেলিব্রিটি। এখনও আবদার! বলেছিল, তোমাদের কাছে তো সেই তিতানই।” প্রত্যুষার মৃত্যুর খবর শুনে বাণীবাবুর চোখের সামনে ভাসছে নানা স্মৃতি। বলেন, “ওর বয়স তখন সাত কী আট হবে। বলত, ‘সুস্মিতা সেনের মতো হতে চাই।’ তাঁর মতো চুল বাঁধা প্র্যাকটিসও করত।”
পাড়ার আর এক বাসিন্দা ও প্রত্যুষাদের পরিবারের ঘনিষ্ঠ কুন্তল সেন বলেন, “খবরটা কাল বিকেলে
শুনি। বিশ্বাস না করেই ওর বাড়িতে ছুটে যাই। ওর বাবা-মা কাল রাতেই মুম্বইয়ের জন্য রওনা হয়ে গিয়েছিলেন। তিতানের মৃত্যু সংবাদ শুনে কেমন অসহায়ের মতো লাগছিল। ও তো নিজের মেয়ের মতোই ছিল।”
প্রত্যুষার এক আত্মীয়, কিংশুক মুখোপাধ্যায় বলেন, “খবরটা শুনেই ছুটে গিয়েছি ওদের বাড়ি। ও আমার কাছেই তো সব আবদার করতো।’’ কিংশুকবাবুর কথায়, ‘‘শেষ বার ও যখন এখানে এসেছিল, তখন বলল, ‘কাকু চল ফুচকা খাই। মুম্বইয়ে তো এই সুযোগ হয় না।’ আমরা রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে ফুচকা খেলাম। পরের দিন আমাদের বাড়িতে এল ওর প্রিয় খাবার, আলু পোস্ত খেতে।”
পেশায় ম্যাজিশিয়ান কিংশুকবাবু বলেন, “কত কথাই তো মনে পড়ছে। ম্যাজিক শোতে ওকে নিয়ে যেতাম। ও বলত, কাকু ম্যাজিক শিখিয়ে দাও। কত বিষয়েই যে ওর উৎসাহ ছিল।’’ তাঁর প্রশ্ন, এত জীবনমুখী একটা মেয়ে কী ভাবে আত্মহত্যা করতে পারে?
আর এখন এই প্রশ্নটাই ঘুরপাক খাচ্ছে প্রত্যুষার বন্ধু ও ঘনিষ্ঠদের মনে। কিন্তু, ঝড়ের আভাসটা কি গোড়া থেকেই ছিল?
কারণ, হোয়াটস অ্যাপে যে শেষ স্টেটাস— ‘মরকে ভি মুহ্ না তুঝসে মোড়না’ (মরার পরেও তোমার থেকে মুখ ফেরাব না)। সঙ্গে একটা স্মাইলি!