নতুন রূপে নতুন প্রভাত। সংগৃহীত চিত্র।
দক্ষিণ কলকাতার এক রেস্তরাঁয় রবিবারের সন্ধ্যা, টলিউডের প্রায় সব তারা সেখানে উপস্থিত। প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়, ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত, হরনাথ চক্রবর্তী, শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, জিনিয়া সেন, সুদেষ্ণা রায়, অভিজিৎ গুহ, জয়দীপ মুখোপাধ্যায়, প্রেমেন্দু বিকাশ চাকী, অভিজিৎ সেন, ইন্দ্রাণী দত্ত-সহ আরও অনেকে। মধ্যমণি খ্যাতনামী পরিচালক প্রভাত রায়। নীল শার্ট আর ট্রাউজারে ৭৮-এর যুবকের চোখ-মুখে চাপা আনন্দ। উত্তেজনা তাঁর মেয়ে একতা ভট্টাচার্যেরও। পিতৃদিবসে তাঁর ‘বাবি’কে নতুন রূপে টলিউডকে উপহার দিলেন তিনি।
এত দিন প্রভাত রায় প্রযোজক, চিত্রনাট্যকার, কাহিনীকার ছিলেন। এ দিন মুকুটে বাড়তি পালক— তিনি প্রযোজক এবং আত্মজীবনীকারও! মেয়ের সহযোগিতায় তাঁর আত্মজীবনী ‘ক্ল্যাপস্টিক’-এর মলাট প্রকাশের পাশাপাশি ঘোষিত হয় বাবা-মেয়ে জুটির প্রযোজনা সংস্থা প্রভাত প্রোডাকশনসের নাম। কমবেশি দেড় বছরের পরিশ্রম এ দিন প্রকাশ্যে আসতেই হাসিমুখ প্রবীণ পরিচালকের। আনন্দবাজারকে বললেন, ‘‘চিরঞ্জিৎ চক্রবর্তী, প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়রা কত বার বলেছিল, ‘দাদা তুমিও প্রযোজনা করো’। তখন শুনিনি। যাই হোক, মেয়ের ইচ্ছায় সেই ইচ্ছেও পূর্ণ হল।’’ তার পরেই রসিকতা, ‘‘এ বার প্রযোজক নন্দিতা রায়-শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়দের সমকক্ষ হলাম।’’
আত্মজীবনী লেখা সহজ, না পরিচালনা করা? প্রশ্ন রেখেছিল আনন্দবাজার অনলাইন। শুনে হেসে ফেলেছেন প্রভাত। বলেছেন, ‘‘কোনওটাই সহজ নয়। দুটোই দুটোর মতো করে শক্ত।’’ সেটা বই লিখতে লিখতে বুঝতে পেরেছেন। একতা সহযোগিতা না করলে হয়তো ‘ক্ল্যাপস্টিক’ লিখে উঠতে পারতেন না। মুম্বই থেকে বাংলায়। শক্তি সামন্ত থেকে নিজের পরিচালনা। উত্তমকুমার থেকে প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়। প্রভাতের জীবন মোটেই সাদা-কালো নয়। তাতে ঘটনাপ্রবাহ অনেক, প্রচুর স্তর, রং, অনেক অভিজ্ঞতা। সবটাই বইয়ের পাতায় পাতায় ছড়িয়ে দিয়েছেন। জানিয়েছেন তিনি। গোপনতম গল্পও কি প্রকাশ্যে এসেছে? বলা হয়, আত্মজীবনীতে কিচ্ছু লুকোতে নেই...! সঙ্গে সঙ্গে অকপট স্বীকারোক্তি, ‘‘কিচ্ছু লুকোইনি। কাউকে আঘাত না করে যা যা ঘটেছে তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। ’’ ‘বাবি’র বইয়ের মলাট এঁকেছেন তাঁর সৃজনশীল মেয়ে একতা। তাঁর কথায়, ‘‘কাকতালীয় ভাবে বাবির বইয়ের মলাট আমার ৩০০ তম কাজ। আমি তো খুশিই। বেশি খুশি ওঁকে ব্যস্ততা ফিরিয়ে দিতে পেরে। দেড় বছর ধরে আমরা পরিশ্রম করেছি। তবে আপনাদের সামনে এক সঙ্গে দুটো ঘোষণা করতে পারলাম। আমার পিতৃদিবস সার্থক।’’
প্রভাত রায়, প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়, ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত। ছবি: সৃংগৃহীত।
একতা আসার আগে স্ত্রী জয়শ্রী রায় ছেড়ে গিয়েছেন নিঃসন্তান প্রভাতকে। শরীর-মনের দিক থেকে ক্রমশ ভেঙে পড়ছিলেন প্রবীণ পরিচালক। তবু স্বপ্ন দেখতেন, তাঁর মেয়ে থাকলে তাকে নিয়ে পাহাড়ের উঁচু শিখরে বসে কাগজের প্লেন ওড়াতেন! একতাকে তেমন একটি লাল টুকটুকে প্লেন বানিয়েও দিয়েছেন। যা যত্ন করে সারা ক্ষণ সঙ্গে নিয়ে ঘোরেন একতা।
একই ভাবে, এই স্বপ্ন একতারও। বাবা-মেয়ের সেই স্বপ্ন প্রভাত প্রোডাকশনসের টিজ়ার ধারণ করেছে। একতা জানিয়েছেন, আপাতত শুধু বিজ্ঞাপনী ছবিই বানাবে নতুন প্রযোজনা সংস্থা। সেই অনুযায়ী একটি ছবি তাঁরা বানিয়ে ফেলেছেন। যার গল্প, চিত্রনাট্য, সংলাপ লেখার পাশাপাশি ক্রিয়েটিভ ডিরেক্টর প্রভাত। দ্বিতীয় ছবির বরাতও পেয়েছেন তাঁরা। সব ঠিক থাকলে খুব শিগগিরি শুটিং শুরু করবেন।
মধ্যমণি প্রভাত, তাঁকে ঘিরে টলিউড। সংগৃহীত।
প্রভাতের কিডনির সমস্যা বহু বছরের। প্রতি সপ্তাহে তিনটি ডায়ালিসিস নিতে হয় তাঁকে। তার পরেও তাঁর উদ্যম দেখে মুগ্ধ টলিউড। প্রসেনজিৎ থেকে হরনাথ চক্রবর্তী— প্রত্যেকে স্বীকার করেছেন, শুধুই ছবি নয়, নিজের জীবনেও জাদু দেখাচ্ছেন প্রভাত। বাংলা বিনোদন দুনিয়া সব সময় তাঁর পাশে। ঋতুপর্ণার কথায়, ‘‘আমায় ঘিরে সংবাদমাধ্যমের এত আগ্রহ, প্রচারের এত আলো, এত জনপ্রিয়তা— সব প্রভাতদার জন্য। দাদা সুযোগ না দিলে এত কিছু পেতাম না।’’ শিবপ্রসাদ আনন্দবাজার অনলাইনকে বলেছেন, ‘‘আমাদের প্রথম ছবি ‘ইচ্ছে’ নন্দনে দেখানো হয়েছিল। প্রথম দিন দেখতে গিয়েছিলেন প্রভাতদা। উনি সে দিন উঠে দাঁড়িয়ে অভিনন্দন জানিয়েছিলেন।’’ প্রভাত একই ভাবে শংসাপত্র দিয়েছিলেন উইন্ডোজ় প্রযোজনা সংস্থার গত বছরের পুজোমুক্তি ‘রক্তবীজ’কেও। শিবুকে বলেছিলেন, ‘‘বাড়িতে সর্ষের তেল আছে? থাকলে নাকে ঢেলে ঘুমোও। আর সপ্তমীর বিকেলে ফোন কোরো প্রেক্ষাগৃহে ‘হাউজ়ফুল’ বোর্ড ঝোলার পর।’’ প্রযোজক-পরিচালক-অভিনেতার দাবি, প্রভাত রায় ‘অ্যাসিড টেস্টার’। ওঁর একটা কথা আজ পর্যন্ত ভুল হয়নি।