‘অ্যানিম্যাল’ ছবিতে রণবীর কপূর। ছবি: সংগৃহীত।
ইদানীং সংবাদ শিরোনামে সন্দীপ রেড্ডি বঙ্গা পরিচালিত ‘অ্যানিম্যাল’ ছবি। সম্প্রতি ওটিটি প্ল্যাটফর্মে ছবিটি মুক্তি পেয়েছে এবং সেই সূত্রে উঠে আসছে একই প্রসঙ্গ, যা গত ডিসেম্বরের গোড়ায় ছবিটির প্রেক্ষাগৃহে মুক্তির সময় শোরগোল তুলেছিল। প্রসঙ্গটি ‘টক্সিক ম্যাসকুলিনিটি’ বা ‘বিষাক্ত পৌরুষ’ সংক্রান্ত। আলোচকদের বক্তব্য, এই ছবিতে পরিচালক এমন ভাবে পৌরুষকে ব্যবহার করেছেন, যা সার্বিক অর্থেই ‘বিষময়’।
এই ‘আলোচক’দের মধ্যে সাধারণ নেটাগরিক থেকে গীতিকার, চিত্রনাট্য, সংলাপ লেখক জাভেদ আখতারের মতো ব্যক্তিত্বও রয়েছেন। পাল্টা পরিচালক বঙ্গাও ছবির সমর্থনে মুখ খুলেছেন। সম্প্রতি তিনি তাঁর ছবির বিরূপ সমালোচকদের ‘অশিক্ষিত’ বলেও দেগে দিয়েছেন। তাঁর মতে, নীতি নিয়ে সিনেমা বানানো যায় না। নীতি দ্বারা চালিত হয়ে সিনেমা নয়, কার্টুন বানানো যায়। বঙ্গা বলেছেন, ‘‘আমি এমনই ছবি আবার বানাব। অন্য কারও মতামতের প্রয়োজন নেই।’’
‘ম্যাসকুলিনিটি’ বা ‘পৌরুষ’ বলিউডি ছবির এক অপরিহার্য উপাদান। অশোক কুমার অভিনীত ‘কিসমত’ (১৯৪৩) থেকে সত্তরের দশকের রাগী যুবকদের পর্দায় উত্থান পর্যন্ত এবং তার পরেও বলি-জগতে ‘পৌরুষ’ই বিভিন্ন অবতারে দেখা দিয়েছে এবং ভারতীয় মূলধারার চলচ্চিত্রের উপর প্রভুত্ব করেছে। এমন নয় যে, রাতারাতি হিন্দি ছবি পৌরুষ দেখতে পেয়ে হতবাক হয়ে গেল। কিন্তু এমন কী ঘটল যে, এই ‘অ্যানিম্যাল’ ছবিটিকে ঘিরে ‘টক্সিক ম্যাসকুলিনিটি’ নিয়ে কলরব শুরু হল?
‘গদর২’-এও পৌরুষ কিছু কম উগ্র ছিল না। ছবি: সংগৃহীত।
‘অ্যানিম্যাল’-এর কাহিনির কেন্দ্রে রয়েছে শিল্পপতি পরিবারের এক তরুণ, যে আশৈশব তার বাবাকে আদর্শ হিসেবে মানে এবং এমন এক নীতিবোধকে আঁকড়ে বাঁচতে চায়, যার মধ্যে যোগ্যতম বা বলবান পুরুষের টিকে থাকা বা প্রভুত্ব বিস্তারই মূলকথা। কৈশোরে সে তার দিদির উপর র্যাগিং-চালানো যুবকদের ‘শিক্ষা দিতে’ ক্লাসরুমেই বন্দুক-সহ হাজির হয়। পরে তার বাবার উপর হামলা চালানোর বদলা নিতে এবং নিজেকে বাঁচাতে গোটা ছবি জুড়ে (৩ ঘণ্টা ২৪ মিনিট) হত্যার তুফান তোলে। ছবির শেষ দৃশ্য পর্যন্ত রক্তপাত অব্যাহত থাকে। পাশাপাশি, অব্যাহত থাকে নারীদের প্রতি তার ও অন্যান্য পুরুষের বৈষম্যমূলক আচরণ। যা তুঙ্গে ওঠে ছবির এক নারীচরিত্রকে নায়ক তার জুতো চাটতে বলায়।
সমস্যা শুধু ‘অ্যানিম্যাল’কে নিয়ে নয়। বঙ্গার আগের ছবি ‘কবীর সিংহ’ ঘিরেও একই প্রশ্ন উঠেছিল। গত বছর মুক্তি পাওয়া ‘গদর ২’-এর মতো ছবিতেও নায়কের পেশি-আস্ফালন কিছু কম ছিল না। আর ‘পাঠান’ বা ‘জওয়ান’-এর মতো ব্লকবাস্টারের মধ্যে কখনও খোলাখুলি, কখনও বা খানিক ঢাকাচাপা দিয়ে ‘পৌরুষ’-এরই জয়গান গাওয়া হয়েছে। তা হলে কি ধরতে হবে, বলিউডি ছবির পুরুষ চরিত্রায়নে সর্বদাই একমাত্রিক পৌরুষ খেলা করেছে?
১৯৪৩-এর ‘কিসমত’ ছবি থেকে হালের ‘অ্যানিম্যাল’— যাত্রাপথটি মোটেই সরল নয়। ‘কিসমত’-এর নায়ক পকেটমার। সে আইন ভাঙে, কিন্তু নৈতিকতা ভাঙে না। এই কল্পটি সত্তরের দশক পর্যন্ত বজায় থেকেছে। কিন্তু আইনভঙ্গকারী অশোক কুমার আর ‘দিওয়ার’-এর বেপরোয়া আত্মবিনাশী অমিতাভ বচ্চনের মধ্যে কি কোনও ফারাক ছিল না? সমাজবিদ মানস রায় কাজ করেছেন বলিউডি ছবির সমাজতাত্ত্বিক প্রেক্ষিত নিয়ে। তাঁর কথায়, “অমিতাভ ও তাঁর পূর্বসূরি রাজেশ খন্নার ছবিতে পৌরুষ একই ছাঁদে উঠে আসেনি। রাজেশ খন্নার চরিত্রগুলিতে কোমলতার একটা আবরণ ছিল। কিন্তু পরবর্তীতে আর সেই আবরণটি থাকেনি।” মানস জানালেন, বলিউডের আদি জমানায় ছবির ব্যাকরণ নির্ধারিত হয়েছিল বাঙালি প্রযোজক-পরিচালকের হাতে। ফলে বাঙালির সনাতনী ধারণার ‘নায়ক’ সেখানে ছায়া ফেলেছিল। উত্তমকুমারের মতো মৃদুভাষী সুরসিক নায়ক পঞ্চাশের দশকের ‘বোম্বাই’ ছবিতে আকছার। সে যদি আইন না-ও মানে, তার মধ্যে জেগে থাকে রসবোধ, মমত্ব। সে ‘বঞ্চিত’ হলেও ‘রাগী’ নয়।
এই কল্পটিই বদলাতে শুরু করে ষাটের দশকের শেষ দিক থেকে। হিন্দি ছবি বরাবরই রাষ্ট্রযন্ত্রের মুখপাত্রগিরি করে এসেছে। নেহরু-ভাবনায় যখন দেশের প্রগতির কথা উঠে আসছে, তখন কোমল-কঠোর নায়ক ন্যায়পরায়ণ। দুষ্টের হাতে পড়লে আইন বেপথু হয়, কিন্তু ন্যায় আর নীতিবোধই তাকে আবার ঘরে ফেরায়— এই বিশেষ ধারণাটি নেহরু জমানার পরেও টিকে থাকে। কিন্তু তত দিনে পাকিস্তান বা চিনের সঙ্গে তার রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম ঘটে গিয়েছে। ‘শত্রু’ শুধু দেশের ভিতরে নয়, বাইরেও। এই পর্ব থেকেই বোম্বাই থেকে বাঙালি পুঁজি পিছু হটে, উত্থান ঘটে উত্তর ভারতীয় অধ্যুষিত প্রযোজক সংস্থাগুলির। শুধু মৃদুভাষী প্রায়-বাঙালি নায়কের ‘পিয়াসা’ বা ‘চৌদভি কা চাঁদ’ নয়, খানিক মারকুটে বা ক্ষ্যাপাটে ‘জংলি’ বা ‘ব্রহ্মচারী’র আবির্ভাব ঘটে। সেখান থেকে দেশের অন্দরের গ্লানিকে তুলে ধরতে ‘মেরা গাঁও মেরা দেশ’-এর মতো ছবি তৈরি হতে বেশি সময় লাগেনি। পাশাপাশি, সীমান্তে ন্যায়রক্ষাকারী সেনাবাহিনীর জয়গান গাওয়াও অব্যাহত থেকেছে। এই দুই ঘরানার ছবিতেই কিন্তু ‘পৌরুষ’ই শেষ কথা বলে। নারী সেখানে গৌণ। মানসের কথায়, “এখানে যে ম্যাসকুলিনিটি দেখা গিয়েছিল, তা কিন্তু হলিউডের পেশল পৌরুষের নকল নয়। তা উত্তর ভারতের মাটির সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত।”
সত্তরের রাগী যুবকের পৌরুষ নায়িকাকে প্রায় নিষ্ক্রিয় রাখলেও সেখানে এক জন নারীই প্রাধান্য পেতেন। তিনি মা। ‘মা’ মানে গর্ভধারিণী, ‘মা’ মানে দেশজননীও। ‘দিওয়ার’-এর নায়ককে ‘বীরের মৃত্যু’ বরণ করতে হয়। কারণ, তার ‘মা’ তাকে সমর্থন করেনি। তার উপর সে আইন ভেঙেছে। তার ‘পৌরুষ’-এর অনিবার্য পরিণতি তার মৃত্যু। কিন্তু সত্তরের দশকে বলিউডে অন্য রকমের পৌরুষও ছিল। অমল পালেকর বা ফারুখ শেখ অভিনীত চরিত্রগুলি তার প্রমাণ। কিন্তু তাদের সংখ্যা নগণ্য।
যে জাভেদ আখতার ‘অ্যানিম্যাল’-এ উগ্র পৌরুষের উপস্থাপন এবং নারী-চরিত্রায়ন নিয়ে প্রতিবাদ করেছেন, তাঁর লেখা সংলাপ-সমৃদ্ধ ‘শোলে’ বা ‘দিওয়ার’-এ কি পৌরুষ কিছু কম ছিল? চলচ্চিত্র আলোচক শান্তনু চক্রবর্তী দীর্ঘ দিন কাজ করছেন জনপ্রিয় ছবি নিয়ে। তাঁর মতে, সত্তরের দশকের ছবিতে পুরুষ নারীর ‘রক্ষক’। নারীর সেখানে আলাদা কোনও জায়গা ছিল না। শান্তনুর কথায়, “৮০ শতাংশ দর্শকই যেখানে পুরুষ, সেখানে পৌরুষের দাপাদাপি থাকাটাই স্বাভাবিক।”
‘দিওয়ার’-এর রাগী যুবক অমিতাভ। ছবি: সংগৃহীত।
এ কথা অনস্বীকার্য যে, ভারতের মহানাগরিক পরিসরের বাইরের সিনেমাহলগুলি ছিল পুরুষ-অধ্যুষিত। ফলত, আবেগগত জায়গা থেকেই চাহিদা ছিল ‘পৌরুষ’-এর। এই পৌরুষ মূলত উত্তর ভারতীয় ছাঁদের। দক্ষিণী ‘ম্যাসকুলিনিটি’র উত্তর বিজয় তখন বহু দূরে। সত্তরের দশকের দেশব্যাপী রাজনৈতিক ডামাডোল ও তার অনুষঙ্গে বেকারত্ব, গ্রামজীবন থেকে স্বনির্ভর মানুষের উচ্ছিন্ন হওয়া— এ সব বার বার দেখা দিয়েছে অমিতাভ বচ্চন অভিনীত ছবিতে। এর ফলে অনিবার্য ভাবেই ‘রাগী যুবক’টি প্রতিষ্ঠান-বিরোধী। এই হাওয়া একটা চড়াইয়ে উঠতে উঠতে গিয়ে ঠেকে আশির দশকে সানি দেওল অভিনীত ছবিগুলিতে। ‘ক্রোধ’ সেখানে অনেক বেশি বিস্তৃত, ‘দুশমন’ প্রায়শই রাষ্ট্রের শত্রুরা। সানির ‘একাই একশো’ চরিত্রগুলি ছিল উগ্র পৌরুষের প্রকৃষ্ট উদাহরণ। সেগুলির এক পরত নীচেই খেলা করছিল জাঠ বা শিখ জাতিসত্তার দ্বারা নির্ধারিত ‘পুরুষ’-এর সংজ্ঞা। ‘গদর’ (২০০১)-এ গিয়ে সেই পৌরুষ বিস্ফোরিত হয়।
তবে এখনকার ‘অ্যানিম্যাল’ বা ‘কবীর সিংহ’-এর সঙ্গে সে সবের পার্থক্য ছিল। শান্তনুর কথায়, “অ্যানিম্যাল শব্দটার ভিতরেই কোথাও যেন যা খুশি করার সিদ্ধতা দেওয়া হচ্ছে।” সময়ের সঙ্গে সঙ্গে গণহত্যা, ‘আগ্রাসন’, ঘৃণাভাষণ এখন নৈমিত্তিক ব্যাপার। সেখানে এই ‘টক্সিক পৌরুষ’-এর দাপাদাপি এমন কিছু আশ্চর্যের ব্যাপার নয়। সম্প্রতি বহু আলোচিত ওয়েব সিরিজ় ‘ছোটলোক’-এর পরিচালক ইন্দ্রনীল রায়চৌধুরীর যেমন মনে হচ্ছে, “এই বিষময়তা এখন রাজনৈতিক সংস্কৃতির অংশ। একে ‘লেজ়িটিমাইজ়’ করা হয়ে গিয়েছে। ভায়োলেন্স এখন নৈতিক ভাবেও সিদ্ধ।”
সম্প্রতি ওয়েব সিরিজ় ‘পি আই মিনা’ তৈরি করে হিন্দি ছবির বলয়ে কদম রেখেছেন ‘শ্রীস্বপনকুমারের বাদামী হায়নার কবলে’ ছবির পরিচালক দেবালয় ভট্টাচার্য। হিন্দি কাহিনিচিত্র নির্মাণ করলে তিনি এই ‘উগ্র’ পৌরুষকে কতখানি প্রাধান্য দেবেন? দেবালয়ের জবাব, এই পৌরুষের ব্যাকরণের সঙ্গে তাঁর কোনও পরিচয় নেই। এই ধরনের ছবি আক্ষরিক অর্থেই ‘পাশবিকতার উদ্যাপন’। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে নাৎসি পার্টির কাজকর্মে মুগ্ধ হয়েছিলেন জার্মানরা। মোহভঙ্গ হতে প্রবল রক্তক্ষয় আর যন্ত্রণা সইতে হয়েছিল তাঁদের। দেবালয়ের মতে, “এখন এ দেশে বোধ হয় সেই মুগ্ধ হওয়ার পর্বটিই চলছে। দগ্ধ হওয়ার পর্ব কেমন হবে আমরা জানি না। এ-ও জানি না যে, পরবর্তী প্রজন্মকে কী পোহাতে হবে।”
‘অ্যানিম্যাল’-এর নায়ক যথেচ্ছ হত্যালীলা চালিয়ে গেলেও আইন তাকে ছুঁতে পারে না। ‘দিওয়ার’-এর নায়কের মতো তার জন্য মৃত্যু অপেক্ষা করে না। বরং মৃত্যুর মুখ থেকে সে ফিরে আসে। তার পৌরুষময় প্রতিশোধস্পৃহা তাকে ফিরিয়ে নিয়ে আসে। ‘অ্যানিম্যাল’ বা ‘গদর ২’ কি শুধু ঝলক? এর পরে কী? এই উদগ্র পৌরুষের বক্স অফিস যে জমজমাট, তা প্রমাণিত। এই উগ্রতা কি আগামীতে উগ্রতর হয়ে উঠবে? ভাবতে বসলে আতঙ্ক হতে পারে। আর ভয় পাওয়া মানে ‘পৌরুষ’ থেকে পিছিয়ে আসা। পিছিয়ে পড়লে তো চলবে না!