আহমদ মোহম্মদের ঘটনাটা আমার কাছে খুব বড় একটা ইস্যু। আর আমেরিকার মতো দেশে এ রকম একটা ঘটনা তো রীতিমতো হাস্যকর! যে দেশ নাকি সৃষ্টিশীলতাকে এত নেকনজরে দেখে, সেই দেশই একটা বাচ্চা ছেলেকে ঘড়ি বানানোর অপরাধে গ্রেপ্তার করল! কোথায় তার পিঠ চাপড়াবে তা নয়। আসলে দেশটা এখন ‘ইসলামোফোবিয়া’ আর ‘জেনোফোবিয়া’তে ভুগছে। বিশেষ করে ৯/১১-র ঘটনার পর থেকে।
আহমেদের বানানো ঘড়িটার গঠনশৈলী দেখে ক্লাস টিচার নাকি ভয় পেয়ে রিপোর্ট করেন। কোনও যুক্তি আছে এই বক্তব্যের? ঘড়ির যে ছবিগুলো সোশ্যাল মিডিয়ায় ঘুরে বে়ড়াল, দেখে মনে হল ঠিক যেন হলিউডি ভার্সানের ‘স্যুটকেস বম্ব’। ঘড়িটা আসলে তৈরি হয়েছিল বাচ্চাদের পেন্সিল বক্স দিয়ে। কর্তৃপক্ষও জানত সেটা। স্কুলে সবাই জানত ছেলেটা একটা ঘড়ি বানিয়েছে। আহমেদের সায়েন্স টিচার ঘড়িটা দেখে প্রশংসা করেছিলেন। বলেছিলেন ব্যাগে ঢুকিয়ে রাখতে। কিন্তু আরেকজন শিক্ষক ঘড়িটা ব্যাগ থেকে বের করে আনেন। ঝামেলার শুরু সেখান থেকেই। তবে এটাকে শুধু স্কুল কর্তৃপক্ষের সামান্য গাফিলতির ঘটনা হিসেবে দেখলে চলবে না। ব্যাপারটা অনেকটাই গুরুতর।
প্রথমত স্কুল কর্তৃপক্ষের এ হেন উদ্ধত আচরণ নিয়ে প্রশ্ন তোলাই যায়। এত সুন্দর সৃষ্টিশীল কাজের প্রশংসা করার বদলে ওরা ছেলেটাকে অ্যারেস্ট করল। আবার কোনও ক্ষমাও চাইল না। নিজেদের কাজের সপক্ষে যুক্তি খাড়া করতে লাগল। এত সবের পরেও মার্ক জুকারবার্গ, রাষ্ট্রপতি বারাক ওবামা, নাসা এবং অন্যান্য বেশ কিছু প্রতিষ্ঠানের অভূতপূর্ব সাড়া থেকে বোঝা যায় আমেরিকার যুক্তি-বুদ্ধির ধারটা এখনও নষ্ট হয়ে যায়নি।
দ্বিতীয়ত, এ রকম ঘটনার পিছনে বর্ণবিদ্বেষেরও একটা বড় ভূমিকা থেকে যায়। আহমেদকে রাষ্ট্রপতি ওবামা হোয়াইট হাউসে যাওয়ার নিমন্ত্রণ জানিয়েছেন। অথচ সেই ওবামাই গত দশ বছরে মুসলমানদের পরিস্থিতি নিয়ে সম্পূর্ণ নীরব। কিছু গোষ্ঠীর কাজকর্ম নিয়ে চুপচাপ থাকা তবু মেনে নেওয়া যায়। কিন্তু একটা সমগ্র জাতিকে এ ভাবে নীরবে অগ্রাহ্য করা! প্রশ্ন থেকেই যায়। মুসলমান মানেই ‘রগ’, খারাপ। টিভিতেও যে ভাবে দেখানো হয় মুসলমানদের, তাতে তাদের আতঙ্কবাদী ছাড়া কিছু ভাবার উপায় নেই। অনেকেই বলতে পারেন এটা একটা জাতির বিরুদ্ধে সূক্ষ্ম ভাবে, ছদ্মবেশে প্রচার চালানোর একটা চেষ্টা। যাদের নাকি ওপর থেকে খুব ভাল দেখানো হয়। কিন্তু আকারে-ইঙ্গিতে ততটাই নীচে নামানো হয়। ছোট জায়গার এই যে নোংরা রাজনীতি, সেটা তো আসলে ফেডারেলেরই কারসাজি।
তা বলে আমি এটা বলতে চাইছি না মুসলিমরা এ ব্যাপারে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত। কালো মানুষদের বিরুদ্ধে বর্ণবৈষম্য এই দেশের সবচেয়ে জঘন্য অপরাধ। আমেরিকানরা খুব খোলা মনের। কিন্তু একই সঙ্গে কিছু বিষয়ে বেশ কঠোরও। নিজেদের অধিকার, স্বাধীনতা রক্ষার বিষয়ে তারা যথেষ্ট সোচ্চার। কিন্তু কখনও কখনও চাপের মুখে মাথা নোয়াতে হয় তাদেরও। মেনে না নেওয়ার অধিকার এখন আমেরিকার মতো দেশেও আক্রান্ত। ৯/১১-র ঘটনার পর থেকে আমেরিকায় বেশির ভাগ বাদামি চামড়ার মানুষকেই সন্দেহের চোখে দেখা হয়। যদিও এখন ততটা খারাপ অবস্থা নয়। বা এমনও নয় সেই সব মানুষ এখানে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। শিখ বা অন্যান্যদের ওপর আক্রমণ হওয়া সত্ত্বেও সেটা পুরোপুরি মেনে নেওয়া যায় না। বা এমনও বলা যাবে না বর্ণবৈষম্য ট্রেন্ড হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে ‘ব্ল্যাক’দের ওপর হওয়া অনেক পুলিশি নির্যাতনের ঘটনাই কিন্তু এখনও আড়ালে থেকে যায়। আহমেদের ঘটনাটা যে জায়গায় ঘটেছিল, তার থেকে অল্প দূরত্বেই ঘটেছিল সান্ড্রা ব্ল্যান্ডকে নিয়ে এক ঘটনা। ১০ জুলাই টেক্সাসের ওয়ালার কাউন্টিতে একটা খুব ছোট ট্রাফিক সমস্যাজনিত ঘটনায় তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়। দিন তিনেক বাদে জেলের সেল-এর ভেতর তাঁকে পাওয়া যায় ঝুলন্ত অবস্থায়। কাউন্টি কোরোনার আর পুলিশ এটাকে আত্মহত্যার ঘটনা বলে চালিয়ে দেয় সঙ্গে সঙ্গে। এই ঘটনাগুলো থেকে আশা করি একটা আন্দাজ পাওয়া যায় পরিবেশটা ঠিক কেমন হলে এ ধরনের নির্যাতনের ঘটনা ঘটে? তবে আমেরিকার মানুষদের ধন্যবাদ দিতে চাইব যে এ ধরনের ঘটনা ইদানীং আর বড় একটা ঘটছে না।
আহমেদের খবরটা পড়ে খুব রাগ হয়েছিল। রাগ কমে যাওয়ার পর একজন বাবা হিসেবে গর্ব হচ্ছিল। কী সাহসী ছেলেটা! ওকে হ্যান্ডকাফ পরিয়ে থানায় নিয়ে গিয়েছিল। ওর সাংবিধানিক অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়েছিল। ওর বাবা-মাকে ফোন পর্যন্ত করতে দেওয়া হয়নি। স্কুলে বোমা নিয়ে আসার অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয়েছিল ওকে। কিন্তু ও মাথা ঠান্ডা রেখে ওদের সব প্রশ্নের উত্তর দিয়েছিল। চাপের মুখে একবারের জন্যেও ভেঙে পড়েনি। এই প্রজন্মকে সাধুবাদ। যে ওরা নিজেদের জায়গাটা শক্ত ভাবে ধরে রাখতে জানে। একজন অভিভাবক হিসেবে কর্তৃপক্ষকে আমি কড়া ভাষায় একটা চিঠি লিখতেই পারতাম। আমার নাগরিক অধিকার লঙ্ঘন হচ্ছে— এই মর্মে কেস-ও করতে পারতাম।
আমেরিকায় আমি বসবাস করছি ১৯৮৬ সাল থেকে। ব্যক্তিগত ভাবে কখনও এ ধরনের বর্ণবৈষম্যের শিকার আমাকে হতে হয়নি। হয়তো সব সময় বড় বড় শহরে থেকেছি বলেই। তবে আমার বেশ কিছু বন্ধুবান্ধব এমন সব ঘটনার মুখোমুখি হয়েছে যে ওদের আত্মবিশ্বাস তলানিতে এসে ঠেকেছে। এক বান্ধবীর গাড়িকে ফলো করা হয়েছিল। সঙ্গে জুটেছিল অবিরাম কুৎসিত ব্যবহার। আরেক বন্ধুকে এক সুপারমার্কেটে বর্ণবৈষম্যের ইঙ্গিতে ব্যঙ্গ করে নানা নামে ডাকা হয়েছিল। হয়তো ঘটনা হিসেবে এগুলো খুব বড় কিছু নয়। কিন্তু যাঁরা এই অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছেন, তাঁরাই জানেন তখন কতটা অসহায় লাগে।
এখানে সবচেয়ে বড় ভয় হল পুলিশ যদি আপনাকে আটকায়। ওদের একটা হাত সব সময়ই বন্দুকে থাকে। ভারতে ট্রাফিকজনিত কোনও সমস্যা হলে পুলিশ আপনাকে গাড়ির ওপর ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেবে না। ট্রেনিং চলাকালীন এখানকার পুলিশদের ‘ব্ল্যাক’দের প্রতি নিষ্ঠুর হতে শেখানো হয়। বাল্টিমোরের এক প্রাক্তন পুলিশকর্মী মাইকেল উড কিছু দিন আগেই তাঁর ট্রেনিংয়ের অভিজ্ঞতা নিয়ে মুখ খুলেছিলেন। জানিয়েছিলেন কতটা নিষ্ঠুর এবং বর্ণবিদ্বেষী হতে শেখানো হয়েছিল তাঁকে। ১১ বছরের কর্মজীবনে স্বচক্ষে দেখা কিছু ভয়ঙ্কর ঘটনা নিয়ে ট্যুইট করেছিলেন তিনি। তা নিয়ে ভার্চুয়াল দুনিয়ায় রীতিমতো শোরগোল পড়ে যায়। বা ফ্রেডি গ্রে-র ঘটনাটাও চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় পুলিশি নির্যাতন বা বর্ণবৈষম্যের দিকটা।
আহমেদের ঘটনাকে হয়তো আমেরিকার মতো দেশে আর ব্যতিক্রমী বলা যায় না। কিন্তু একটা কথা বোঝা দরকার। বিক্ষিপ্ত কিছু ঘটনা কিন্তু কখনওই প্রমাণ করে না সাদা চামড়ার সব মানুষই কালো চামড়ার বিরুদ্ধে। হয়তো গায়ের রং কোনও ব্যাপারই নয়। মূল সমস্যা কর্তৃপক্ষ এবং তাদের ব্যবহার নিয়ে।
এই সব ঘটনার প্রেক্ষিতটা যে সব সময় ওপর মহল থেকেই শুরু হয়।